শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:৪৬

স্বাধীন ভারতে কেমন আছেন মুসলমানরা

স্বাধীন ভারতে কেমন আছেন মুসলমানরা

/ ১৬৭
প্রকাশ কাল: শুক্রবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

“কোন দেশে রাষ্ট্র তার সংখ্যালঘুদের প্রতি কি রকম পক্ষপাতহীন আচরন করে এবং তাদের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে, সেটা তার ন্যায়পরায়নতার একটা আসিড (Asid) মাত্র, কয়েক বছর আগে ভারত সরকার এক বিশেষ কমিটি গঠন করেন। ভারতের মুসলিমদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য। কমিটির সভাপতি ছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার। তাঁর নেতৃত্বে এই কমিটি সারা ভারত জুড়ে মুসলিমদের উপর বিশাল সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষায় যেসকল ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিল তা হল, মুসলমানরা কি ধরণের কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত, তাদের বার্ষিক আয় কেমন, শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন, সরকারী সাহায্য ব্যাংকের ঋণ কেমন পান, কেমন এলাকায় এরা থাকেবন, সেখানে জল, বিদ্যুত, রাস্তাঘাটের অবস্থা কেমন, সম্পত্তি বা জমিজমার পরিমান কত….ইত্যাদি।

প্রায় দের বছর ধরে সমীক্ষা করার পর কমিটি একটি বিশাল রিপোর্ট তৈরি করেন। রিপোর্টটি খুবই বড়। প্রায় ৪৫০ পৃষ্ঠার। নির্ভিক সত্যানুসন্ধানী এই রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর সারা ভারতের সকল পত্রিকা মুসলিম বঞ্চনার কথা তুলে ধরেন। আলোচনার ঝড় উঠে সারা দেশ জুড়ে। এই কমিটির কাছে অবস্থা ভালো কিভাবে করা যায় সে ব্যাপারেও সুপারিশ চেয়েছিল। এই রিপোর্টে মুসলিমদের অবস্থার সাথে সাথে কিভাবে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠা যায় সে সম্পর্কে সুপারিশও ছিল। এই রিপোর্টটির বিশেষ কিছু অংশ পাঠকদের জানাবো আজ।

তার আগে, সর্বভারতীয় উর্দু নিবন্ধকারের একটি মন্তব্য দেখুন, “পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্টি যে ভারতে বাস করে এটা পুরানো এবং বহুল প্রচলিত গল্প। নতুন এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিষয় হল তাদের সামাজীক অবস্থান,আর্থিক শোচনীয়তা, কর্মসংস্থানে অস্তিত্বহীনতা এবং রাজনৈতিক শক্তিহীনতা”।সর্বভারতীয় ইংরাজী নিবন্ধকার Dr. S. Ausaf Saied Vasfi লিখেছেন, “Muslim Condition is worse than that of Dalits. The only ‘sector’ where Indian Muslims are more than adequately represented in Jail”. (মুসলিমদের অবস্থা দলিতদের থেকেও সঙ্গীন। একমাত্র সেক্টর যেখানে ভারতীয় মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে ব্যপকতর তা হল জেল)।

২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতের লোকসংখ্যা প্রায় ১০২ কোটি ৮৬ লক্ষ। এর মধ্যে ৮০% হিন্দু, ১৩.৪ শতাংশ মুসলিম। বাকী ৭% এর মতো খৃষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি। কয়েক বছর আগে বেসরকারী একটি সমীক্ষার মতে ভারতে প্রায় ১৮-২০ কোটি লোক মুসলিম। আমেরিকার একটি পত্রিকার মতে ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। ভারত কখনোই নাকি মুসলিমদের সঠিক সংখ্যা জানায় না।

যাক, এবার সাচার কমিটি রিপোর্টে দিকে আলোকপাত করা যাক। আমি শুধু কয়েকটা ব্যাপার নিয়ে লিখছি। যেগুলো নিয়ে বেশি হৈ হুল্লোর হয়েছিল।

মুসলিমদের শিক্ষাগত অবস্থা: শিক্ষা ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবস্থা করুণ ও শোচনীয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘মুসলিমরা দু ধরনের অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। একদিকে শিক্ষার স্তর নিম্ন, অন্যদিকে শিক্ষার গুনগত মানও নিম্ন। কোন কোন ক্ষেত্রে মুসলিমদের আপেক্ষিক অংশীদারি দীর্ঘকাল ধরে জাতি-ব্যবস্থার শিকার তপশিলি জাতির মানুষদের চেয়েও খারাপ’। পশ্চিমবঙ্গ বিহারের এক হাজার মুসলিম অধ্যুষিত গ্রামে কোন বিদ্যালয়ই নেই। সারা দেশে মুসলিম প্রধান গ্রাম গুলির এক তৃতীয়াংশে কোন বিদ্যালয় নেই। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তো নাইই। রিপোর্ট অনুযায়ী, শহর অঞ্চলে মুসলিমদের অন্তত ৬০% স্কুলের দরজায় পা দেবার সৌভাগ্যও হয়নি। উচ্চশিক্ষাতেও মুসলিমদের অবস্থা খুব খারাপ। সারা দেশে প্রতি ১০০ জন স্নাতকের মধ্যে মুসলমান ৬.৩, তপশিলি জাতি ৮.২, অন্যরা ৮৫.৫। টেকনিক্যাল স্নাতকের ক্ষেত্রে মুসলিমদের অবস্থা আরো খারাপ। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট এর সবকটি শাখা মিলিয়ে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে মাত্র ১.৩ শতাংশ মুসলমান। এর কারণ শুধুই সরকারী অমনোযোগীতা, স্কুল কলেজের অভাব। অনেকে আবার বলেছেন মুসলিমরা ছেলেমেয়েদের মাদ্রাসায় পাঠান, স্কুলে নয়। তাই তাদের সঠিক শিক্ষা হয়না। কমিটির এই ব্যাপারেও সমীক্ষা চালিয়েছে। রিপোর্ট মোতাবিক মুসলিম শিশুদের মধ্যে মাত্র ৪% মাদ্রাসায় যায়। মুসলিমদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫৯.৯%। এটা জাতীয় গড় ৬৫.১% অপেক্ষা অনেক কম।

চাকরির ক্ষেত্রে মুসলিম: স্বাধীনতা অর্জনের সময় চাকরীতে মুসলিমদের অবস্থান ছিল খুব ভালো। তখন চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩৪%। সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর এ-কথা বলেওছেন সিনিয়ার সমাজবাদী মন্ত্রী মুহাম্মাদ আযম খান। তিনি বলেন, ‘১৯৪৭ সালে যখন দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় তখন দেশের সরকারী চাকরিতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩৪%, আজ এটা দাড়িয়েছে মাত্র ১ শতাংশে। এমনকি তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেনীর কর্মসংস্থানে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব দলিতদের থেকেও কম। এই অবস্থার জন্য কংগ্রেস ছাড়া আর কে দায়ি?” (Quota for all Muslims: Samajwadis by Amita Verma, The asian Age)

এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে স্বাধীনতার পর থেকে মুসলিমদের সাথে শুধু শোষন হয়েছে। তাদের অবস্থার একটু উন্নতি হয়নি বরং মহা অবনতি হয়েছে। আরেকটা ব্যাপার বলি, মুসলিমদের আর্থিক অবস্থা খতিয়ে দেখতে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮০ সালে গোপাল কৃষ্ণ কমিশান নিয়োগ করেন। এই কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী মুসলিমরা শুধু বেকারই নয়, কিছু কিছু এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তাদের নাম নথিভুক্ত করতেও অস্বীকার। এই রিপোর্টে আরো বলা হয় আশির দশকে মুসলিম আই.এ.এস অফিসারের হার ছিল মাত্র ৩.২৭ শতাংশ, এই.পি.এস অফিসারের হার মাত্র ২.৭ শতাংশ এবং অনান্য কেন্দ্রীয় সরকারী চাকরিতে তাদের হার মাত্র ১.৫৬ শতাংশ। এমনকি রাজ্য স্তরের চাকরিতেও মুসলিমদের হার মাত্র ৬.০১ শতাংশ। অথচ এই রিপোর্ট প্রকাশের ৩০ বছর পরেও মুসলিমদের অবস্থা একই রয়ে গেছে। কোন উন্নতিই হয়নি। সরকার কোন ব্যবস্থাও নেয়নি।

সাচার কমিটির রিপোর্টটি দেখুন-

চাকরিপদ     –     মোট সংখ্যা    –    মুসলমানদের সংখ্যা    –    মুসলমানদের  শতকরা হার

আই.এ.এস    –    ৩,৮৮৩        –    ১১৬                         –     ২.৯৯ %

আই.পি.এস   –    ১,৭৫৩           –    ৫০                           –      ২.৮৫ %

ইনকাম ট্যাক্স –   ৮৮১             –    ২৭                            –     ৩.৬ %

রেলওয়ে ট্রাফিক এবং আকাউন্ট – ৪১৫ – ১১                    – ২.৬৫ %

ব্যঙ্ক –(অজানা)                        – ২,৪৭৯                         – ২.১৮ %

কেন্দ্রীয় দপ্তর – ৮,২৬,৬৬৯    – ৩,৩৪৬                      – ৪.৪১ %

রাজ্য সরকারী দপ্তর – – (অজানা) ৪৯,৭১৮                    – ৬.০১ %

আরো কয়েকটি ব্যাপার জানুন, ১৯৭১ সালের তালুকদার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গ ক্যাডারে ২৬৪ জন আই.এ.এস অফিসারের মধ্যে মাত্র ২ জন মুসলিম। গোপাল কৃষ্ণ রিপোর্ট অনুসারে, উল্লেখযোগ্য মুসলিম জনসংখ্যাবিশিষ্ট তিন রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, আসম ও বিহারের ক্লাস ওয়ান সেক্টারের অফিসারের মধ্যে একজনও মুসলিম নেই। সর্বভারতীয় মোট ২,২৩২ জন ক্লাস ওয়ান অফিসারের মধ্যে মাত্র ৩৬ জন মুসলিম। এর মধ্যে ২২ জনই কেরালার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। উল্লেখ্য, কেরালাতে অনেক মুসলিম আছে। ভারতের সব থেকে শিক্ষিত, স্বচ্ছল, ক্ষমতাশালী মুসলিম কেরালায় আছে। রাজ্য গুলিতে মুসলিমদের জনসংখ্যা ও চাকরীর হার: রাজ্য——মুসলিম জনসংখ্যা—-চাকরির হার পশ্চিমবঙ্গ – ২৫.২ % – ২.১ % কেরালা – ২৪.৭ – ১০.৪ উত্তর প্রদেশ – ১৮.৫ -৫.১ বিহার – ১৬.৫ – ৭.৬ আসাম – ৩০.৯ – ১১.২ ঝাড়খন্ড – ১৩.৮ – ৬.৭ কর্ণাটক – ১২.২ – ৮.৫ দিল্লী – ১১.৭ – ৩.২ মহারাষ্ট্র – ১০.৬ – ৪.৪ অন্ধ্রপ্রদেশ – ৯.২ – ৮.৮ গুজরাট – ৯.১ – ৫.৪ তামিলনাড়ু – ৫.৬ – ৩.২ পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে মুসলিমদের সংখ্যার অনুপাতে চাকরিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম। বার বার কমিশন গঠন করা হয়েছে, কমিশন রিপোর্ট দিয়েছে। সুপারিশও করেছে। কিন্তু সরকার কোন রকমের উদ্যোগ নেয়নি। তাই মুসলিমদের অবস্থার উন্নতিও হয়নি। মুসলিমদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে, হচ্ছে, হয়ে চলেছে। দারিদ্র ও ভুমিহীন মুসলিম: ভারতে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন ৩২% মানুষ। যাদের পরিবারের লোকেদের মাথাপিছু খরচ ২৬ টাকার কম তাদেরকে দারিদ্র সীমার নিচে বলে ধরা হয়। স্বাধীন হওয়ার ৬০ বছর পরেও একটি দেশের ৩২% মানূষের দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস নিসন্দেহে লজ্জাকর। কিন্তু তার থেকেও লজ্জার ব্যাপার হল সেই দেশের একটি নিদিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের ৪৯.৯ শতাংশ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস। হ্যা আমি মুসলমানদের কথা বলছি। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের ৪৯.৯% মুসলিম দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। যা জাতীয় গড়ের থেকে অনেক বেশি। এটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের জন্য খুবই লজ্জার। প্রশ্ন উঠে ভারত কি সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ দেশ? দারিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী মুসলিমদের বি.পি.এল অন্তরভুক্তও করা হয়নি। অথচ সারা দেশের প্রায় ২৭% দারিদ্রদের সেই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা অতিরিক্ত রেশন, কমদামে খাদ্যদ্রব্য, বিনা খরচে বিদ্যুতও পাননা। গ্রামীন মুসলিমদের ৬০% ভুমিহীন। ভিটে মাটি ছাড়া চাষ বাষ করার জন্য কোন জমি নেই। অথচ, ১৯৫০ সালের সংবিধান ও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী জমিদারী প্রথা বিলোপ করা হয়েছিল। এবং নিদিষ্ট সংখ্যক সম্পত্তি ছেড়ে, অতিরিক্ত জমি সরকার গরীব্দের মধ্যে বেটে দেয়। তাহলে কি মুসলমানরা এই জমি থেকে বঞ্চিত হয়েছিল? তাদের কোন জমি দেওয়া হয়নি? কেন আজ ৬০% মুসলিম ভুমিহীন? সরকারের কাছে এইসব প্রশ্নের কোন উত্তরই নাই। অনান্য জন-গোষ্ঠীর মধ্যে দারিদ্র (শতাংশ হিসেবে) সম্প্রদায় – শহর – গ্রাম তপশীলি জাতি- ৩৬.৪ – ৩৪.৮ হিন্দু – ৮.৩ – ৯.০ অনান্য সঙ্খ্যালঘু – ১২.২ – ১৪.৩ দেখা যাচ্ছে তপশীলি জাতি বাদ দিলে সবাই সুখেই আছে। দারদ্রের ছোবল থেকে বেঁচে আছে। অথচ মুসলিমরা দারিদ্রের দংশনে কাতরালেও চিকিতসার কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অবাক করা ব্যাপার হলো দেশের ৪০% মুসলমান প্রধান গ্রামে কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রই নাই। ফ্রীতে চিকিতসা পাওয়া তো দুরের কথা। বিচার বিভাগ, লোকসভা ও রাজ্যসভাতে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব খুবই কম। এসব বিষয় নিয়েও লেখা যায়, কিছু তথ্য দেওয়া যায়। কিন্তু এগুলো ততটা ইম্পোর্টান্ট নয়। তাই শিক্ষা, চাকরি এবং দারিদ্রতার কথাই শুধু তুলে ধরা হলো।

সুত্র: * সাচার রিপোর্ট, মুসলিমদের বঞ্চনার দলিল; সন্তোষ রাণা * মুসলমান সমাজ এখন এই সময়; এস.এম শামসুদ্দিন * আবু রিদা সাহেবের বিভিন্ন প্রবন্ধ।

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১
All rights reserved © shirshobindu.com 2024