l
রবিবার, ০৭ মার্চ ২০২১, ১১:১৩ পূর্বাহ্ন
শীর্ষবিন্দু নিউজ: বিপুল উৎসাহ আমেজ নিয়ে সদ্য সমাপ্ত হয়ে গেল সিলেট সিটি কর্পোরেশন (সিসিক) নির্বাচন। সিলেট কিং মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরানকে দরাশায়ী করে নগর পিতার মসনদ কেড়ে নিলেন বিএনপির একক প্রার্থী বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। আর এবার তাই নতুন পথে সিলেটের রাজনীতি। লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। সিটি নির্বাচনে পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন ভাবনা শুরু হয়েছে এখানকার রাজনীতিতে।
সামনেই শুরু হতে পারে পাল্টে যাওয়ার প্রক্রিয়া যা খুব একটা বেশি দূরে নয়। এতে অনেকেই হতে পারেন নায়ক, আবার কেউ কেউ খলনায়কও। হিরো থেকে জিরো বনে যেতে পারেন জাঁদরেল রাজনীতিকরাও। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মাত্র তিন দিনের মাথায় এসে স্থানীয় রাজনীতিতে পাল্টে যাওয়ার এমনই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে, খুব বেশি অদল-বদল না-ও হতে পারে বিএনপি’র রাজনীতিতে।
নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী ইতিবাচকভাবে এখানে রাজনীতিতে নতুন পালক যোগ করতে পারেন। তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে সিলেট বিএনপিতে চলছে উৎসবের আমেজ। সকল ভেদাভেদ ভুলে যে নেতারা একটি মাত্র বিজয়ের জন্য মাঠে নেমেছিলেন, তারা এখন তৃপ্ত। এই বিজয় স্থানীয়ভাবে বিএনপি’র বিবর্ণ রাজনীতিকে রঙিন করে তুলেছে। বিএনপি’র ভেতরে অনেক ক্ষোভ ছিল। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান ও বিএনপি’র নিখোঁজ সাংগঠনিক সম্পাদক এম. ইলিয়াস আলীর যুগেও সিলেটে বিএনপি এবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। স্পষ্ট বিভক্তি ছিল তখন। এই কোন্দলের কারণে সিটি করপোরেশনে সিংহাসন পেতে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হয়েছে বিএনপি’র নেতা-কর্মীদের। এবার যখন দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশের একক প্রার্থী হিসেবে আরিফুল হক চৌধুরীকে মনোয়ন দেয়া হয়, তখন আর কেউ বসে থাকেননি।
মেয়র পদ থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন মহানগর বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি নাসিম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাইয়ূম জালালী পংকি ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট শামসুজ্জামান জামান নির্বাচনী মাঠে সরব হয়ে ওঠেন। আর তারা নির্বাচনে সরব হওয়ার পরপরই পাল্টে যায় ভোটের মাঠের পরিস্থিতি। একই সঙ্গে শরিক দল জামায়াতে ইসলামীও তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়। সুতরাং আরিফের বিপক্ষে তো দূরের কথা কোন নেতাই তখন নির্বাচনে বিজয় ছাড়া বিকল্প কিছু চিন্তা করেননি। ঢাকা থেকে আসা বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, সুবক্তা ফজলুর রহমানসহ সিনিয়র নেতাদের নিয়ে সবাই ভোটের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
অন্যদিকে, নতুন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এবারই প্রথম নির্বাচনের আগে সবার সঙ্গে মিশে যেতে সক্ষম হন। তিনি যতবার প্রয়াত অর্থমন্ত্রী এম. সাইফুর রহমানের মাজার জিয়ারতে মৌলভীবাজারে গেছেন ততবার ওখানে যাওয়ার আগে বিশ্বনাথের রামধানা গ্রামে নিখোঁজ বিএনপি নেতা এম. ইলিয়াস আলীর মাকে দেখতে গেছেন। ইলিয়াস আলীর ভাই আছকির আলীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এ কারণে শেষ মূহূর্তে স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সম্পাদক আছকির আলী নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন সিলেট নগরেও।
তবে, সিলেট বিএনপি’র এই পট পরিবর্তনের রাজনীতিতে এবার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন বিএনপি’র সহ-সভাপতি শমসের মুবীন চৌধুরী। তিনি শুরু থেকেই সিটি নির্বাচনে একক প্রার্থী দেয়ার প্রক্রিয়া চালান এবং দলের চেয়ারপারসন একক প্রার্থী ঘোষণা দেয়ার পর তিনি নতুন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বিজয় ঘরে তুলতে নির্বাচনী মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং ফলাফল ঘোষণার দিন গভীর রাত পর্যন্ত রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে অবস্থান করে বিজয় নিয়ে ঘরে ফেরেন। এ কারণে আরিফুল হক চৌধুরীর এ বিজয়কে অনেকেই বলছেন, সিলেটের নির্বাচনী মাঠে শমসের মুবীনের প্রথম বিজয়। তবে, এই বিজয়ের অংশীদার হিসেবে খন্দকার আবদুল মোক্তাদিরের নামও উচ্চারিত হচ্ছে। তিনি সিটি নির্বাচনে বিএনপি’র মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরীর পক্ষে ভোটের ময়দানে অবিরাম প্রচারণা চালিয়েছেন। উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন সিলেট মহানগর বিএনপি’র সভাপতি এমএ হক-ও। আরিফের বিজয়ে মূল টিমওয়ার্কের সঙ্গে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। একই সঙ্গে বিবাদ মিটে যাওয়ার পর এডভোকেট শামসুজ্জামান জামানও আরিফের বিজয়ে ভোটের মাঠে ভূমিকা রাখেন। নির্বাচনে আরিফের বিজয়ের পর জামান ঘোষণা দিয়েছেন সিলেটবাসী এই নির্বাচনে ইলিয়াস গুমের জবাব দিয়েছে।
এদিকে, মেয়র নির্বাচিত হলেও সিলেট বিএনপি’র রাজনীতিতে আরিফুল হক চৌধুরী এখনও অনেকটা পিছিয়ে। তাকে বিগত দিনে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপি’র কোন পদে রাখা হয়নি। এবার নির্বাচনে জয়লাভের পর তিনি জেলা ও মহানগর বিএনপি’র কোন একটি শীর্ষ পদে আসতে যাচ্ছেন বলে আলোচনা চলছে। সুতরাং এক্ষেত্রে আন্দোলনে সফল হতে বিএনপি’র শীর্ষ পর্যায় থেকে তাকে দেয়া হতে পারে সিলেট মহানগর বিএনপির পদ। বর্তমান সভাপতি এমএ হককে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে আরিফুল হককে মহানগর বিএনপি’র সভাপতি করার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা। তবে, নবনির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী এ নিয়ে এখন বেশি চিন্তিত নন। তিনি জানান, সিলেট বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করে ধরে রাখাই হচ্ছে তার কাজ। বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আগামী সংসদ নির্বাচনেও একই ভাবে ফল ঘরে তোলা সম্ভব। এবারই প্রথম আরিফের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন বিশাল জনপ্রিয়তার অধিকারী সাবেক মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরান। তবে পরাজয়ের জন্য তিনি যে দায়ী নন সে বিষয়টি ইতিমধ্যে সিলেটের রাজনীতিতে স্পষ্ট হয়েছে।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে এর জন্য দায়ী করছেন খোদ আওয়ামী লীগের নেতারাই। বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন ও ঢাকায় হেফাজতের ওপর গুলি ছোড়ার ঘটনাটি এখানে দারুণভাবে কাজ করেছে। এর বাইরে কামরানের সঙ্গে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিকরা ভোটযুদ্ধে শরিক হননি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদ, সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহমদসহ দলের সিনিয়র নেতারা ভোটের মাঠে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু তাদের নিয়ে ব্যাপক শঙ্কাও ছিল। অভিযোগ উঠেছিল, এই নেতারা কামরানের বিজয় ঘরে তুলতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেননি। তারা যেসব কাজ করেছেন সেগুলো নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে বিতর্ক দেখা দেয়।
অন্যদিকে, এবার জোটগতভাবে নীরব ভূমিকা পালন করেছে জাতীয় পার্টি। কেন্দ্রীয়ভাবে তাদের পক্ষ থেকে কোন বার্তা না আসায় দলের পক্ষ থেকে কাউকে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়া হয়নি। তবে শেষ দিকে এসে কামরানের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল্লাহ সিদ্দিকী। জাতীয় পার্টির নেতারা জানান, দল কাউকে প্রকাশ্য সমর্থন না দেয়ায় ভাগ হয়েছে জাতীয় পার্টির ভোটও। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সিলেটের হেফাজতে ইসলামের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়েছে দলের পক্ষ থেকে। হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র নেতারা শেষ দিকে এসে আরিফের পক্ষে মাঠে সক্রিয় হয়েছেন। তবে সেখানে তারা হেফাজত নাম ব্যবহার না করলেও ইসলামী রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচনী প্রচারণা চালান। তাদের ‘সুর’ তোলার কারণেই সিলেটে ভোটের মাঠে আরিফের এই বিজয়। এদিকে, কামরানের পক্ষে সিলেটের বাম দলগুলোর অবস্থানও স্পষ্ট ছিল না। নেতারা জোটগতভাবে কয়েকটি সভায় উপস্থিত থাকলেও ভোটের মাঠে সক্রিয় ছিলেন না।
সিলেটে নির্বাচনী প্রচারণায় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমু, মোহাম্মদ নাসিম এসে আওয়ামী লীগের ভেতরের দৃশ্য অবলোকন করে হতাশ হয়েছেন। তারাও কৌশলে বিষয়টি মীমাংসার চেষ্টা করেছেন। তবে তাদের সে প্রক্রিয়ায় কোন কাজ হয়নি। এভভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি, আশফাক আহমদ ও আসাদ উদ্দিন শেষ পর্যন্ত রহস্যময় ভূমিকা পালন করায় নির্বাচনের দিন অর্ধেক কেন্দ্রে কামরানের কোন নির্বাচনী এজেন্ট ছিল না। নির্বাচনের পর কামরান নিজেই স্বীকার করেছেন বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে তিনি এজেন্ট খুঁজে পাননি। সিলেটের ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের এই পরাজয়ে এবার দলীয়ভাবে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ। ইতিমধ্যে দলের তৃণমুলে তার সাংগঠনিক পদ থাকা না থাকা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।
মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ নির্বাচনের পর তার প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কামরানের জনপ্রিয়তা এত কমেছে তা টের পাননি। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, কামরানের এই পরাজয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে তার কদর বেড়েছে এবং নির্বাচনের পর কামরানের নেতৃত্বসুলভ আচরণ সবার নজর কেড়েছে। এ কারণে আগামী দিনে আওয়ামী লীগের তরফ থেকে কামরানের জন্য সুখবর আসতে পারে বলে জানান তারা। আরিফের বিজয়ে চাঙ্গা হয়েছে সিলেটে জামায়াতে ইসলামী। শুরু থেকে আরিফকে নিয়ে ভোটের মাঠে সক্রিয় ছিল তারা। এমনকি জামায়াতের প্রায় ৫ হাজার কর্মী ও দুই হাজার নারী কর্মী ঘরে ঘরে আরিফের দাওয়াত পৌঁছে দিয়েছেন। আর দাওয়াত পৌঁছে দেয়াই আরিফের বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়া আরিফের বিজয়ে বিএনপি ও জামায়াতের জোটের বন্ধন আর পাকাপোক্তও হয়েছে।