অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: তালাক একটি আরবি শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করা, পরিত্যাগ করা বা বন্ধনমুক্ত করা। নির্দিষ্ট বাক্যের মাধ্যমে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করাই তালাক। স্বামী স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, একত্রে বসবাস করা উভয়ের পক্ষেই বা যে কোনো এক পক্ষের সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে তারা নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন।
একজন স্বামী যেমন তার স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন, অনুরূপ একজন স্ত্রীও তার স্বামীকে তালাক দিতে পারেন। এ অধিকারটি ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন কর্তৃক প্রদত্ত হয়েছে। তবে উক্ত আইনের ধারা ২এ কিছু শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
তালাকের আইনগত দিক
১. কোনো ব্যক্তি স্ত্রীকে তালাক দিতে চাইলে তাকে যে কোনো পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর যথাশীঘ্রই সম্ভব স্থানীয় ইউপি/পৌর/সিটি চেয়ারম্যানকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে এবং স্ত্রীকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।
২. নিম্নের (৫) উপ-ধারার ব্যবস্থাবলীর মাধ্যম ব্যতিত প্রকাশ্য অথবা অন্যভাবে প্রদত্ত কোনো তালাক, পূর্বাহ্নে বাতিল না হলে (১) উপ-ধারা অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ হবে না।
৩. উপরোক্ত (১) উপ-ধারা অনুযায়ী নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার (পুনর্মিলনের) জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে।
৪. তালাক ঘোষণাকালে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে বা অন্তঃসত্ত্বা থাকলে উপরের (৩) উপ-ধারায় উল্লেখিত সময় অথবা গর্ভাবস্থা-এ দুইটির মধ্যে দীর্ঘতরটি অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তালাক বলবৎ হবে না।
৫. অত্র ধারা অনুযায়ী কার্যকরী তালাক দ্বারা যার বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটেছে, সে স্ত্রী এ জাতীয় তালাক তিন বার কার্যকরী না হলে কোন তৃতীয় ব্যক্তিকে বিবাহ না করে পুনরায় একই স্বামীকে বিবাহ করতে পারবে।
৬. যে কোনো ধরনের তালাক রেজিষ্টেশনের ক্ষেত্রে নিকাহ রেজিষ্ট্রার বা কাজী সাহেবকে ২০০ (দুই শত) টাকা ফি প্রদান করে তালাক রেজিষ্ট্রি করতে হবে (১৯৬১ সালের ২৯শে আগষ্ট তারিখের গেজেট নোটিফিকেশন)। ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিষ্ট্রেশন) আইন এর ধারা ৬ মোতাবেক তালাক রেজিষ্ট্রেশন করা প্রয়োজন। যিনি বিবাহ রেজিষ্ট্রি করবে তারাই তালাক রেজিষ্ট্রি করতে পারবে। কোনো বিয়ে বা তালাক রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হবার পর নিকাহ রেজিস্ট্রার সংশ্লিষ্ট পক্ষগণকে নিকাহনামা বা তালাকনামার সত্যায়িত প্রতিলিপি প্রদান করবেন এবং ঐরূপ সত্যায়িত প্রতিলিপির জন্য কোনো ফি আদায় করা যাবে না (ধারা-৯)৷
নোটিশ ছাড়া তালাক দিলে শাস্তি ধারা-৭ (২) অনুযায়ী নোটিশ ছাড়া তালাক দিলে এক বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা দশ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা অথবা উভয় প্রকার শাস্তি হবে।
স্ত্রীর পক্ষে বিচ্ছেদ স্ত্রী তিনভাবে স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চাইতে পারে। ১. তালাক-ই-তৌফিজ ২. খুলা। ৩. আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ।
১. তালাক-ই-তৌফিজ নিকাহনামার ১৮ নং ঘরে স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পন করে থাকে, সে ক্ষমতার বলে স্ত্রী যদি স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ চায় তাহলে সে বিচ্ছেদকে তালাক-ই- তৌফিজ বলে। তালাক-ই-তৌফিজের ক্ষেত্রে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারবারিক অর্ডিন্যান্সের ৭ ধারায় বর্ণিত নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।
২. খুলা স্বামী এবং স্ত্রীর আলোচনা সাপেক্ষে যে বিচ্ছেদ হয় তাকে ‘খুলা’ বিচ্ছেদ বলে, তবে স্বামীকে ‘খুলা’ বিচ্ছেদে রাজী করানোর দায়িত্ব হচ্ছে স্ত্রীর (প্রয়োজনে কোনো কিছুর বিনিময়ে)। এ ক্ষেত্রে স্বামী স্ত্রীকে ইদ্দতকালীন ও গর্ভস্থ সন্তানের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী এক্ষেত্রে প্রস্তাবক যেহেতু স্ত্রী, তাই চেয়ারম্যানের কছে স্ত্রী নোটিশ পাঠাবে।
৩. আদালতের মাধ্যমে বিচ্ছেদ তালাক-ই-তৌফিজ ও খুলার মাধ্যমে স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ না নিতে পারে এবং স্ত্রী যদি বিচ্ছেদ নেওয়া একান্ত প্রয়োজন মনে করে তাহলে ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে বলা হয়েছে কি কি কারণে একজন স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবে।
কারণগুলো হলো ১. চার বছর পর্যন্ত স্বামী নিরুদ্দেশ থাকলে। ২. দুই বছর স্বামী স্ত্রীর খোরপোষ দিতে ব্যর্থ হলে। ৩. স্বামীর সাত বছর কিংবা তার চেয়েও বেশী কারাদণ্ড হলে। ৪. স্বামী কোনো যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত তিন বছর যাবৎ দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে। ৫. বিয়ের সময় পুরষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করা পর্যন্ত বজায় থাকলে। ৬. স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা কুষ্ঠ ব্যাধিতে বা মারাত্মক যৌন ব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে। ৭. বিবাহ অস্বীকার করলে। কোনো মেয়ের বাবা বা অভিভাবক যদি ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে মেয়ের বিয়ে দেন, তা হলে মেয়েটি ১৯ বছর হওয়ার আগে বিয়ে অস্বীকার করে বিয়ে ভেঙ্গে দিতে পারে, তবে যদি মেয়েটির স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সর্ম্পক (সহবাস) স্থাপিত না হয়ে থাকে তখনি কোনো বিয়ে অস্বীকার করে আদালতে বিচ্ছেদের ডিক্রি চাইতে পারে। ৮. স্বামী ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লংঘন করে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করলে। ৯. স্বামীর নিষ্ঠুরতার কারণে।
উপরে যে কোনো এক বা একাধিক কারণে স্ত্রী আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারে। অভিযোগ প্রমাণের দায়িত্ব স্ত্রীর। প্রমাণিত হলে স্ত্রী বিচ্ছেদের পক্ষে ডিক্রি পেতে পারে, আদালত বিচ্ছেদের ডিক্রি দেবার পর সাত দিনের মধ্যে একটি সত্যায়িত কপি আদালতের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাবে। ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুযায়ী চেয়ারম্যান নোটিশকে তালাক সংক্রান্ত নোটিশ হিসেবে গণ্য করে আইনানুযায়ী পদক্ষেপ নিবে এবং চেয়ারম্যান যেদিন নোটিশ পাবে সে দিন থেকে ঠিক নব্বই দিন পর তালাক চূড়ান্তভাবে কার্যকর হবে।
স্বামীর আদালত স্বীকৃত নিষ্ঠুর ব্যবহার সমূহ ক) অভ্যাসগতভাবে স্ত্রীকে আঘাত করলে বা নিষ্ঠুর আচরণ করলে, উক্ত আচরণ দৈহিক পীড়নের পর্যায়ে না পড়লেও, তার জীবন শোচনীয় করে তুলেছে এমন হলে। খ) স্বামী খারাপ মেয়ের সাথে জীবনযাপন করলে। গ) স্ত্রীকে অনৈতিক জীবনযাপনে বাধ্য করলে। ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করলে। ঙ) স্ত্রীকে ধর্মপালনে বাধা দিলে। চ) একাধিক স্ত্রী থাকলে সকলের সাথে সমান ব্যবহার না করলে। ছ) এছাড়া অন্য যে কোনো কারণে (যে সকল কারণে মুসলিম আইনে বিয়ের চুক্তি ভঙ্গ করা হয়)।
তালাক কখন কার্যকরী হয় না গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে সন্তান ভূমিষ্ট না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না৷ এক্ষেত্রে ৯০ দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকরী হবে৷ অর্থাৎ স্ত্রী গর্ভবতী হলে, সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হবে না৷ মনে রাখতে হবে এই ৯০ দিন পর্যন্ত স্ত্রী পূর্ণ ভরণপোষণ পেতে আইনত হকদার৷
তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীর পুনরায় বিয়ে ১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ (৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি পুনরায় বিয়ে করতে চাইলে সেক্ষেত্রে নতুন করে বিয়ে করতে হবে।
উদাহরণ: রহিম তার স্ত্রী রুণাকে তালাক দিল। তিন মাস পর রহিম বুঝতে পারল যে, তালাক দেয়াটা তার ভূল হয়েছে এবং সে এখনো রুণাকে ভালবাসে৷ খবর নিয়ে জানা গেল রুনাও তার কাছে ফিরে আসতে চায়। এখন তারা যদি আবার একসাথে বসবাস করতে চায় তবে তাদেরকে পুনরায় বিয়ে করতে হবে৷ এখানে বলে রাখা দরকার যে, এক্ষেত্রে হিল্লা বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং তালাক হওয়া দম্পতি হিল্লা বিয়ে ছাড়াই পুনরায় বিয়ে করে একসাথে বসবাস করতে পারবে। কিন্তু পরপর তিনবার তালাক হলে তৃতীয়বার স্ত্রীকে আরেকজনের সাথে বিয়ে দিয়ে তারপর বিয়ে-বিচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রথম স্বামী বিয়ে করতে পারবে।
তালাকের পর সন্তানের অবস্থান তালাকের পর সন্তান মায়ের কাছে থাকবে। এক্ষেত্রে ছেলে সন্তান ৭ বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তান বয়ঃসদ্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে৷ তবে তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব বাবা বহন করবে৷ যদি বাবা দায়িত্ব পালন না করে সেক্ষেত্রে চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে আলাপ আলোচনা করে বিষয়টি মীমাংসা করতে পারেন।
তালাক প্রত্যাহার করা যায় ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগেই তালাক প্রত্যাহার করা যায়৷৯০ দিনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এটা মাথায় রেখে যাতে এ সময়ের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষ ঠান্ডা মাথায় সব কিছূ ভেবে চিন্তে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারে। একটা বিষয় পুনরায় মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, তালাক দেওয়ার নব্বই দিন পর তালাক কার্যকরী হয় কিন্তু এই ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে যে কোন দিন তালাক প্রত্যাহার করা যাবে।
দেন-মোহর পাবার অধিকারঃ তালাক যে পক্ষ থেকেই দেয়াই হোক না কেন স্ত্রী দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী। অর্থাৎ দাম্পত্য মিলন ঘটলে স্ত্রী তালাক দানের পরপরই তাৎক্ষণিক ও বিলম্বিত উভয় মোহরের পুরো অর্থের অধিকারী হয়। তবে দাম্পত্য মিলন না ঘটলে এবং মোহরানা সুনির্দিষ্ট হয়ে থাকলে স্ত্রী মোহরানার অর্ধেকের অধিকারী। আর নির্ধারিত না থাকলে স্ত্রী তিনটি পোষাক উপহার পাবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে এ অধিকার খর্ব হয়নি।
তালাক সংক্রান্ত আইনের সংশোধন করে যুগোপযোগী করা দরকার ১৯৩৯ সালের বিবাহবিচ্ছেদ আইনের ধারা-২ এর উপ-ধারা ৬ এ বলা হয়েছে, স্বামী কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হলে স্ত্রী তালাক নিতে পারবেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে কুষ্ঠ একটি নিরাময় রোগ, বর্তমান যা কোনো মারাত্মক রোগ নয়। তাই এ বিধিতে কুষ্ঠরোগের কারণে স্বামীকে তালাক প্রদানের ব্যবস্থাটি বাদ দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে এইডস রোগটির কথা স্পষ্টভাবে সংযোজন করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এ ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিয়ের অজুহাত দেখিয়ে প্রথম স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, যাতে প্রথম স্ত্রী মোহরানা বা ভরণপোষণের অধিকার দাবি না করতে পারেন। তাই এ ক্ষেত্রেও সুষ্পষ্ট বিধান সংযোজন প্রয়োজন।
হিন্দু আইনে যা বলা হয়েছে সনাতন হিন্দু আইনে সরাসরি বিবাহবিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই। তবে ভারতে ১৯৫৫ সালের হিন্দুু বিবাহ আইনে কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এ আইন প্রযোজ্য নয়। স্ত্রী যদি একান্তই মনে করেন যে, স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা দুর্বিসহ, তা হলে তিনি পিত্রালয়ে বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে পৃথক থাকতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হন। ১৯৪৬ সালে বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান এবং ভরণপোষণ আইন পাস হওয়ার পর, এ আইন অনুযায়ী- এক স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করলে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেতে পৃথক থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবেন।
খ্রিষ্টান ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদ খ্রিষ্টানদের জন্য বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় আইন রয়েছে, তা ব্রিটিশ কর্তৃক প্রবর্তিত, যা ১৮৬৯ সালের ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্ট নামে পরিচিত। কিন্তু এ আইনের কোনো ক্যাথলিক খীষ্টান বিবাহবিচ্ছেদ ঘটালে তা ক্যাথলিক মন্ডলী কৃর্তক গ্রহণীয় নয়। কেননা বিয়ে প্রসঙ্গে ক্যাথলিকমন্ডলী বৈধ বিয়েতে বিচ্ছেদ মানেন না। প্রোটেষ্ট্যান্ট খীষ্টান সম্প্রদায় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে বৈধ বিয়ের বিচ্ছেদ মেনে নেয়। তবে মহামান্য পোপের (ক্যাথলিখ সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মযাজক) বিশেষ বিবেচনায় অথবা চার্চের হস্তক্ষেপে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হতে দেখা যায়। উল্লেখ্য, ১৮৬৯ সালের ত্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্টের বিবাহবিচ্ছেদের ব্যাপারে নারীকে অধিকার প্রদান করা হয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, স্ত্রীর ক্ষমতা ও অধিকারকে স্বামীর পাশাপাশি সমুন্নত রাখা হয়েছে এবং স্ত্রীকেও স্বামীর পাশাপাশি সমতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মুসলিম আইনে বিবাহবিচ্ছেদ-সংক্রান্ত যে কোনো মামলা পারিবারিক অদালতে দায়ের করা যায়।
বিবাহ বিচ্ছেদ মোকদ্দমার আদালত ও মোকদ্দমার খরচ ১৯৮৫ সালের বিবাহ পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও প্রবর্তনের পর থেকে উক্ত আইনের ধারা ৫ (ক) অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ মোকদ্দমা পারিবারিক আদালতে রুজু করতে হবে। স্ত্রীর পৃথক সম্পত্তি রয়েছে এমন ক্ষেত্র ছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদ মোকদ্দমায় স্বামীকেই খরচ বহন বহন করতে হবে ব্রিটিশ আইনের এ বিধানটি, মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদ মোকদ্দমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
তালাক রোধে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব: অনেক সময় দেখা যায়,মানুষ রাগের মাথায় অথবা আবেগের বশবর্তী হয়ে তালাক দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ পরে তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু তখন কি করবে তা বুঝে উঠতে পারে না। এক্ষেত্রে যদি চেয়ারম্যান সালিসীর মাধ্যমে উভয় পক্ষকে ডেকে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার দ্বারা তাদের মধ্যে পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করে দেন তবে দু`পক্ষেরই ভালো হয়। এজন্য বলা হয় তালাক রোধে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও গুরুত্ব অপরিসীম।
মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদে নারী মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদ করার জন্য নারীদের হাতে যে কয়েক প্রকার তালাকের বিধান রয়েছে তা হলো- ক. ‘খুল’ বা ‘খুলা’ তালাক, খ. মুবারাত এবং গ. তালাক-ই-তাওফিজ। প্রচলিত হানাফি আইন অনুযায়ী একজন মুসলিম স্ত্রী শুধু খুলা তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে। এই তালাকে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। তবে উল্লেখ্য, এই ধরনের তালাকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রী তার স্বামীকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। সাধারণত ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্ত্রী তার আর্থিক দাবির কোনো অংশ ত্যাগ করে এবং তখন স্বামী তালাক দেয়ার মাধ্যমে স্ত্রীকে বিবাহবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়।
মুবারাত হলো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ধরনের বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় উভয়ই বিবাহ বিচ্ছেদে সম্মত হয় বলে কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগে না। শারিয়া অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট ১৯৩৭ এই তালাকের বিধান ছিল। মুবারাত তালাকের প্রচলন খুব একটা নেই বললেই চলে।
সবশেষে তালাক-ই-তাওফিজ বা অর্পিত ক্ষমতাবলে দেয়া তালাক। এই ধরনের তালাকে স্বামী কিছু শর্তসাপেক্ষে তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্ত্রীকে প্রদান করে এবং উক্ত শর্ত অনুযায়ী স্ত্রী তালাক প্রদান করতে পারবে। যেমন স্ত্রীকে প্রমাণ করতে হবে যে, তার স্বামী বিবাহ সম্পর্কিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম নয় বা স্বামী ঠিকমতো খরপোশ প্রদান করে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, তালাক প্রদান করার এই অধিকার স্ত্রীর একচ্ছত্র নয় বরং স্বামীর ইচ্ছার (হস্তান্তরের) ওপর নির্ভরশীল।
উল্লেখ্য, মুসলিম আইনে ‘খুলা’ এবং ‘মুবারাত’ ছাড়া সব ক্ষেত্রে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করার ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে পুরুষের ওপর ন্যস্ত। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে তবে তা একচ্ছত্রভাবে নয় বরং স্বামীর সম্মতি সাপেক্ষে। প্রচলিত মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় স্বামী-স্ত্রীর অসাম্য দূর করার জন্য ১৯৩৯ সালে পাস করা হয় মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন। এই আইনে বিভিন্ন কারণে যেমন স্বামী যদি ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হয় বা স্বামী যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয় অথবা স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে তাহলে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারবে। সুতরাং স্বামী কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতা বলে নয় অথবা কোনো প্রকার আর্থিক দাবি ত্যাগ না করে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে প্রদান করা হয়।
উল্লেখ্য, মালিকী মতবাদ অনুসরণ করে ‘নিষ্ঠুরতা’ বা ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’কে উক্ত আইনে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে পারে। ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দটি ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় আমাদের আদালতও ঘোষণা করেছে যে ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতন বোঝাবে না বরং যে কোনো মানসিক নির্যাতনও নিষ্ঠুরতার অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন, হাসিনা আহমেদ মামলায় (৩২ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ২৯৪) আদালত মন্তব্য করেছেন যে স্ত্রীর অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করা হলে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারবে। কুতুবউদ্দিন জায়গীরদার মামলায় (২৫ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ২১) আদালত মন্তব্য করেছেন যে, নিষ্ঠুরতার (যা মানসিক নির্যাতনকেও অন্তর্ভুক্ত করে) কারণে মুসলিম আইনে বিবাহিত একজন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে। এছাড়া হোসনে আরা বেগম মামলায় (৪৩ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ৫৪৩) আদালত ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। উক্ত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, ‘নিষ্ঠুরতা বলতে শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতন বোঝাবে না বরং স্বচ্ছল কোন পরিবারে কোন স্ত্রীকে (যার অভ্যাস নাই) যদি প্রাত্যহিক গৃহকর্ম করতে বাধ্য করা হয় তাহলে তা নিষ্ঠুরতা বলে গণ্য হবে।’
মুসলিম আইনের বিভিন্ন মতবাদগুলোর মধ্যে একমাত্র মালিকী মতবাদে স্বামীর নিষ্ঠুরতার জন্য স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারে। প্রচলিত হানাফি মতবাদ অনুযায়ী স্বামী যদি ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে। অন্যান্য মতবাদেও বিভিন্ন কারণ যেমন স্বামী যদি ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করে অথবা স্বামী যদি পাগল হয় তাহলে স্ত্রী আদালতের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে।
গত কয়েক দশকে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে সাথে বিচার বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিশেষ করে ষাটের দশক থেকে, যখন দেনমোহর প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার কারণে স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে বলে আদালত মত দিয়েছিলেন, এই পরিবর্তন বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে নেলি জামান মামলাটি (৩৪ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ২২১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত মামলায় প্রথমবারের মতো সামাজিক পরিবর্তন এবং নারীর স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বারোপ করার জন্য আদালত মত প্রদান করেন। আদালত মত প্রকাশ করেন যে, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে নারী অধিকারের বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে এবং বিবাহের দায়-দায়িত্বের ক্ষেত্রেও তাদের স্বাধীন সত্তাকে সম্মান জানাতে হবে।
বিবাহ-বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে কাজির দায়িত্ব ও তালাক রেজিস্ট্রেশন মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রিকরণ) আইন ১৯৭৪’ অনুসারে বিয়ের মতো তালাকও রেজিস্ট্রি করতে হয়। নিকাহ নিবন্ধক অর্থাৎ কাজি তার এখতিয়ারভূক্ত করার জন্য নিকাহ নিবন্ধন/কাজি দুইশত টাকা (একশত টাকা মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রি বিধিমালা ১৯৭৫ (১৮/২ অনুসারে) ফি নিতে পারেন। আইনানুসারে, যে ব্যক্তি তালাক কার্যকর করেছেন তিনি রেজিস্ট্রির জন্য আবেদন করবেন এবং ফি দেবেন। নিকাহ নিবন্ধক পরীক্ষা করে দেখবেন উক্ত দু’পক্ষের মধ্যে সত্যি তালাক কার্যকর হয়েছিল কিনা। সাধারণত স্বামী-স্ত্রী উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব হলো, নিকাহ নিবন্ধন ও তালাক রেজিস্ট্রির প্রত্যয়ন কপি তুলে দেয়া এবং সংরক্ষণে রাখা। যদি নিকাহ রেজিস্ট্রার কোন তালাক রেজিস্ট্রেশন করতে অস্বীকৃতি জানান, তবে সেই ক্ষেত্রে উক্ত রেজিস্ট্রিকরণের নিমিত্ত দরখাস্ত করেছিল এমন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সেরকম অস্বীকৃতির ৩০ দিনের ভেতর জেলা প্রশাসকের কাছে আপীল দায়ের করতে পারেন ও ওইরূপ আপীলের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কর্তৃক প্রদত্ত আদেশই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে।
উপসংহারঃ তালাকের ক্ষেত্রে স্বামীর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রন ও স্ত্রী কর্তৃক শর্ত সাপেক্ষে তালাকের অধিকার প্রদানসহ মুসলিম পরিবারের পারিবারিক সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৩৯ সালে মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন এবং ১৯৬১ সালে মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ আইন জারি করা হয়। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে এই আইনকে পরিমার্জন ও গ্রহণযোগ্য করা হয়। ১৯৭৪ সালে মুসলিম বিবাহ তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন প্রণীত হয়। মুসলিম স্বামী-স্ত্রীর বৈধ স্বত্ত্ব-স্বার্থ নির্ধারণ করে স্ব-স্ব স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মুসলিম বিবাহ ও তালাক রেজিস্ট্রেশন আইন একত্রীকরণ ও সংশোধন করে এটি প্রণয়ণ করা হয়। এরপর বিবাহ-তালাক বিধিমালা রেজিস্ট্রেশন ১৯৭৫ সালে জারি করা হয়। বিবাহ-বিচ্ছেদ, দাম্পত্য সম্পর্ক পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি পারিবারিক বিষয়াদির দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫ প্রণীত হয়।
লেখকঃ সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, এম.ফিল গবেষক ও আইনজীবী জজ কোর্ট, কুষ্টিয়া।
Leave a Reply