শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: সীমান্তপারের সন্ত্রাস এবং পাকিস্তানের জঙ্গিপনা নিয়ে সোমবার ব্রিকস-বৈঠকে নিজেদের স্বর সপ্তমে তুলল নয়াদিল্লি।
তবে লাভ হল না তেমন। কূটনীতিকদের একাংশের ব্যাখ্যা, চিনের পাঁচিল তো ছিলই, রুশ শৈত্যও বাঁচিয়ে দিল পাকিস্তানকে!
দিনভর আলোচনায় পাকিস্তান নিয়ে সুর চড়িয়ে সীমান্তপার সন্ত্রাসকেই ব্রিকসের মূল আলোচ্য করে তুলতে সক্রিয় ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
কিন্তু বেলাশেষে ব্রিকসের ঘোষণাপত্রে অনুপস্থিত রয়ে গেল ‘সীমান্তপারের সন্ত্রাস’। রাজনৈতিক সূত্রের মতে, পাকিস্তানকে কোণঠাসা করতে সীমান্তপারের সন্ত্রাসকে গোয়ার অ্যাকশন প্ল্যান এ আনার সব রকম চেষ্টা চালিয়েছিল সাউথ ব্লক।
কিন্তু এ ব্যাপারে চিন এবং রাশিয়ার সহমত আদায় করা সম্ভব হয়নি। সে কারণেই সন্ত্রাস প্রসঙ্গে আইএস বা সিরিয়ার জঙ্গি সংগঠন আল নুসরার নাম ঘোষণাপত্রে ঠাঁই পেলেও পাক জঙ্গিগোষ্ঠী জইশ বা লস্করের নাম থাকল না সেখানে।
সীমান্তপারের সন্ত্রাস প্রসঙ্গটি না-রাখা হলেও সার্বিক ভাবে আন্তর্জাতিক জঙ্গিপনার সমালোচনা করে তার মোকাবিলায় পদক্ষেপ করার কথা অবশ্য বলা হয়েছে গোয়ার ঘোষণাপত্রে।
উরি-কাণ্ডের পর সার্ক-ভুক্ত দেশগুলির সাহায্যে পাকিস্তানকে ব্রাত্য করার কূটনীতি শুরু করেছিল নয়াদিল্লি। সেই কূটনীতি প্রাথমিক ভাবে সফলও হয়েছিল। যার জেরে সার্ক-ভুক্ত প্রায় সবক’টি দেশই ইসলামাবাদে প্রস্তাবিত সার্ক বৈঠক বয়কট করে নয়াদিল্লির পাশে দাঁড়িয়েছিল।
নয়াদিল্লির পরিকল্পনা ছিল, এর পর গোয়ার বৃহত্তর মঞ্চে লিখিত ভাবে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা। কিন্তু গত কাল রাতে চিনা প্রেসিডেন্ট শি চিনফিংএর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকেই সাউথ ব্লক টের পায়, পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার যে প্রবল প্রয়াস চালানো হচ্ছে, তাতে জল ঢালতে ব্যগ্র বেজিং।
আজ ব্রিকসের মঞ্চে মোদীর তীব্র পাক বিরোধিতার পরে বলতে উঠে চিনা প্রেসিডেন্ট তা ঘুরপথে বুঝিয়েও দিয়েছেন।
অন্য দিকে ভারতের সঙ্গে ১৬টি চুক্তি করলেও সদ্য যৌথ সামরিক মহড়া চালিয়ে আসা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লিখিত ঘোষণায় মস্কো যে সায় দেবে না, তা-ও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে যায়।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াশিংটন নিজের স্বার্থে যত বেশি করে ভারতীয় বাজার, অর্থনীতি এবং কৌশলগত দোসর হওয়ার চেষ্টা করছে, ততই মস্কোর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ছে নয়াদিল্লির। পাশাপাশি রাশিয়ার
আগ্রাসী সিরিয়া নীতিকেও সমর্থন করেনি নয়াদিল্লি। ভারতের ঘোষিত বক্তব্য, সিরিয়ার সন্ত্রাসবাদীদের নিকেশ করা উচিত ঠিকই। কিন্তু সে দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থে যুদ্ধবিরতির কথাও ভাবা উচিত।
যার পাল্টা হিসেবে রাশিয়ার যুক্তি, সে ক্ষেত্রে আইএস জঙ্গিদের পালাতে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে। সূত্রের খবর, গত কালের বৈঠকেই মস্কো জানিয়ে দেয়, পাকিস্তানের নাম করে কড়া শব্দ ঘোষণাপত্রে ব্যবহার করায় তাদের সম্মতি নেই। সে কারণে আজ ব্রিকসের মঞ্চে পুতিন সন্ত্রাস নিয়ে বিশেষ কথাই বললেন না!
সব মিলিয়ে ব্রিকস মঞ্চকে ব্যবহার করে একটা পাকিস্তান-বিরোধী হাওয়া একক ভাবে নরেন্দ্র মোদী তুললেন ঠিকই। কিন্তু তার বৃহত্তর প্রতিফলন আপাতত ঘটানো সম্ভব হল না বলেই ঘরোয়া ভাবে স্বীকার করছে বিদেশ মন্ত্রকের একটি অংশ।
এর পরেও অবশ্য পাকিস্তানকে ছেড়ে কথা বলছেন না মোদী। চিন এবং রাশিয়ার মনোভাব বুঝেও সন্ত্রাস প্রশ্নে পাকিস্তানকে একঘরে করে ফেলতে দিনভর ঝাঁঝালো ভাষায় তাদের নিশানা করেছেন তিনি।
ব্রিকসের সভায় যেমন মোদী তাঁর প্রারম্ভিক এবং সমাপ্তি বক্তৃতায় আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস প্রশ্নে ইসলামাবাদকে আক্রমণ করেছেন, তেমনই রাত্রে বিমস্টেকভুক্ত দেশগুলির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকেও ইসলামাবাদকে নিশানা করেছেন তিনি।
ব্রিকস এবং বিমস্টেকভুক্ত দেশগুলির প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে সরাসরি পাকিস্তানের নাম না করে মোদীর বার্তা, এখন আর কথা নয়। এখন সময় কাজ করে দেখানোর।
শুধু ব্রিকস বা বিমস্টেকের মঞ্চে নয়, দ্বিপাক্ষিক আলোচনাতেও পাক মদতে পুষ্ট সন্ত্রাস নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন মোদী। এবং কিছু ক্ষেত্রে উরি-কাণ্ডের নিন্দা-বার্তা আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
ভুটান, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলি ভারতের সঙ্গে আলোচনায় আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসের নিন্দা করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় বলেছেন, বিমস্টেকভুক্ত দেশগুলির কোনও উন্নয়নই সম্ভব নয়, যদি না সন্ত্রাসবাদ রোধ করা যায়।
মোদী আজ দিনের শুরুতেই ব্রিকস-এর আলোচনার সুর বেঁধে দিতে চেয়েছেন পাক-সন্ত্রাস নিয়ে। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নের প্রশ্নে একটি বড় বাধা হল সন্ত্রাসবাদ।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হল, ভারতের প্রতিবেশী একটি দেশ সন্ত্রাসবাদের মূল জাহাজ (মাদার শিপ) স্বরূপ। বিশ্বের সমস্ত সন্ত্রাস মডিউল এই জাহাজটির সঙ্গে যুক্ত। পরে সমাপ্তি বক্তৃতাতেও ব্রিকসভুক্ত দেশের নেতাদের পাশে বসিয়ে মোদী বলেন, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাছাই করে ব্যবস্থা নিলে তা শুধু মাত্র ব্যর্থ হবে না, তার উল্টো ফলও হতে পারে।
এ ব্যাপারে সমস্ত দেশকে একজোট হয়ে সার্বিক ভাবে লড়াই করতে হবে। সন্ত্রাসবাদীদের যারা রাজনৈতিক ভাবে সমর্থন করছে, তারাও কিছু কম ক্ষতিকর নয়। জঙ্গিদের অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ, প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে মসৃণ ভাবে। এগুলিকে নির্মূল করতেই হবে। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সন্ত্রাসবাদ তার দীর্ঘ ছায়া ফেলছে বলে মন্তব্য করে মোদী বলেন, ব্রিকসে আমাদের অগ্রাধিকার হল সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করা।’
যদিও তাঁর এই ‘অগ্রাধিকার’ শেষ পর্যন্ত প্রতিফলিত হয়নি ঘোষণাপত্রে। উরি-কাণ্ডের একটি প্রচ্ছন্ন প্রসঙ্গ ঠাঁই পেলেও কোথাও স্পষ্ট ভাবে পাকিস্তানের নাম ওঠেনি।
ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ভারত-সহ ব্রিকসভুক্ত কয়েকটি দেশের উপর যে আক্রমণ হয়েছে, আমরা তার ঘোরতর নিন্দা করছি। সন্ত্রাসবাদকে কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। তা সে আদর্শগত, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, জাতিগত—যে মোড়কই দেওয়া হোক না কেন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার জন্য ব্রিকসভুক্ত দেশগুলি তাদের সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এর পর আন্তর্জাতিক শান্তি এবং নিরাপত্তার পক্ষে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলি দ্রুত রূপায়ণের উপরে জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে ঘোষণাপত্রে।
কূটনৈতিক সূত্রের বক্তব্য, যে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবগুলি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার দিক্নির্দেশিকা দিয়েছে ব্রিকস-ঘোষণাপত্র, সেই পরিষদেই ভারতের জন্য পাঁচিল তুলে রেখেছে ব্রিকস-এরই সদস্য চিন।
গতকাল পর্যন্ত তারা নিরাপত্তা পরিষদের নিষিদ্ধ জঙ্গি তালিকায় জইশ-ই-মহম্মদের নেতা মাসুদ আজহারের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ভারতের দাবির বিরোধিতা করে গিয়েছে। নাম না করতে চাওয়া এক সরকারি কর্তার কথায়, আসলে সর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে!
যে ব্রিকস-এর মাধ্যমে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হয়েছে, তার সদস্যদের মধ্যেই এমন একাধিক দেশ রয়েছে, যারা নিজের স্বার্থে ইসলামাবাদকে ব্যবহার করে।
জম্মু-কাশ্মীরের রাজৌরিতে নিয়ন্ত্রণরেখার ও পার থেকে পাক সেনার গুলিতে নিহত হলেন সুদেশ কুমার নামে এক ভারতীয় সেনা। তাঁর বাড়ি উত্তরপ্রদেশে। রবিবার পুঞ্চ ও রাজৌরিতে ওপার থেকে আক্রমণ শুরু হতেই পাল্টা জবাব দিয়েছে ভারতীয় সেনা। সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর থেকে এ নিয়ে ২৫ বার সংঘর্ষবিরতি চুক্তি ভাঙল পাকিস্তান।