শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৯

শিশুর নৈতিকতাবোধের বিকাশ

শিশুর নৈতিকতাবোধের বিকাশ

/ ২৬৫
প্রকাশ কাল: বুধবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

জীবনে চলার পথে প্রতিদিনই আমরা ভুল-শুদ্ধ, ঠিক-বেঠিক কিংবা ন্যায় অন্যায় ইত্যাদি নির্ধারণ করি যুক্তির আশ্রয়ে। আজ যাকে গগনবিদারী হুংকারে ‘মহান’  বলে দেবতার আসনে বসাই  কয়েকদিন পরেই হয়ত তাকে আবার পাল্টা যুক্তির আশ্রয়ে ‘শঠ’ বলে টেনে-হিঁচড়ে নিচে নামাই। নীতি আদর্শের এহেন তারতম্য নানা বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল হলেও মানুষের মধ্যে ভালো-মন্দের ধারণাটি গড়ে ওঠে শৈশব থেকেই। প্রকৃতপক্ষে শিশুর মধ্যে  বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যৌক্তিক ভাবনার উদ্ভব হয়। আর যৌক্তিক ভাবনার ওপর ভর করে সৃষ্টি হয় নৈতিকতাবোধের।

প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো শিশুরাও তার চারপাশের শব্দ, আলো, বিষয়, ঘটনাকে একেবারেই তার মতো গ্রহণ, চিন্তন, বিশ্লেষণ এবং সর্বোপরি সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। কোনো বিষয়ে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এ সমন্বিত প্রক্রিয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞান/ মনোরোগবিদ্যা/ মানব মনস্তত্ত্বের ভাষায় কগনিশন (Cognition) এবং  শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধি এমনকি পূর্ণ বয়স পর্যন্ত এ পুরো প্রক্রিয়াকে কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট (Cognitive Development) বলা হয়।

কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট নিয়ে যেসব বিজ্ঞানী গবেষণা করেছেন তাদের মধ্যে জ্যা পিয়াজে (Jean Piaget), কোহেল বার্গ (Kohleberg) প্রমুখের অবদান অনস্বীকার্য।  আর কগনিটিভ ডেভেলপমেন্টের একটি অংশ হলো নৈতিক বিকাশ বা Moral development।

জন্মের পর থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা শুধুমাত্র তাদের চারপাশের জগতের অস্তিত্ত্ব সনাক্ত করতে পারে। বস্তুর আকার সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। কিন্তু তার মাঝে কোনো যুক্তি তৈরি হয় না।  দুই বছরের পর থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত  শিশুরা ভাষা বলতে এবং বুঝতে শেখে। এ বয়সে সীমিত পরিসরে তাদের মাঝে বোধ জন্মায়। শিশুরা যা শুনে বা যা দেখে তাকেই সত্য বলে ধরে নেয়। এ সত্যের পেছনে কোনো কারণ বা যুক্তির আশ্রয় নিতে তারা অক্ষম। তাদেরকে ‘এটা খারাপ ওটা ভালো’ বলে দেওয়া হলে সেটাই সত্য বলে গ্রহণ করে। কিন্তু তার পেছনের কার্যকারণে তারা মাথা ঘামায় না বা সে বিষয় বিশ্লেষণে অপারগ তারা। এ বয়সে শিশুরা ভেবে নেয়, নিয়ম ভাঙা অপরাধ। আর তার বিপরীতে শাস্তি অনিবার্য।
সাত থেকে ১১ বছর বয়সেই মূলত শিশুরা যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনা করতে শেখে। কোনো বিষয়ের কার্যকারণ সম্পর্কে বুঝতে শেখে। তারা বুঝতে শেখে নিয়ম মানেই অবধারিত বিষয় নয় বরং সামাজিক রীতি হিসেবেই এসব বিধি নিষেধের আরোপ।

১১ বছর পর থেকে শিশুরা কোনো বিষয়ে সমস্যা বা সমাধানের প্রাক্কালে বিশ্লেষণপ্রসূত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে। তারা বুঝতে শেখে নিয়ম ভাঙ্গার ফলে সামাজিক সাম্য বিনষ্ট হয়। তাই সমাজের স্বার্থেই নিয়ম পালন জরুরি। এক্ষেত্রে ভাল-খারাপ বা নৈতিকতার প্রশ্নে তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে নিজস্ব বিশ্লেষণ অগ্রণী ভূমিকা রাখে। পরবর্তিতে প্রাপ্ত বয়সে ব্যক্তি পর্যবেক্ষণের নিরিখে তার নিজস্ব ব্যক্তিত্ত্বের ধরণ (personality type) অনুযায়ী নৈতিকতার প্রশ্ন মীমাংসা করেন।

এক্ষেত্রে ব্যক্তিত্ত্ব বা Personality সম্পর্কে ধারণা থাকাটা প্রাসঙ্গিক। বিজ্ঞানী ফ্রয়েড’র ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রতিটি ব্যক্তির ব্যক্তিত্ত্বের ছাঁচ গড়ে ওঠে ছোট বেলার অভিজ্ঞতার আলোকে। আর এই ‘ব্যক্তিত্ত্বের’ কেন্দ্রে থাকে ইড (id), তার চারপাশ ঘিরে থাকে ইগো (ego) আর সবার বাইরে মৌনভাবে বসে থাকে সুপার ইগো (super ego)। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে। ধরা যাক তাজিন’র আজ স্কুলে যেতে মোটেই ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু সে ভাবছে স্কুলে না গেলে বার্ষিক পরীক্ষায় উপস্থিতির ঘাটতির কারণে সে পিছিয়ে পরবে। আর নিয়মিত স্কুলে যাওয়া তো প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীরই কর্তব্য। তাই শেষ পর্যন্ত তাজিন স্কুলে গেলো।

এক্ষেত্রে তাজিনের নিজের ইচ্ছেটা হলো ইড, বাস্তবতা হলো ইগো আর নৈতিকতা হলো সুপার ইগো। ইড, ইগো, সুপার ইগোর সমন্বয়ে শেষ পর্যন্ত তাজিন স্কুলে যাবার সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করে। মানুষের ‘সুপার ইগো’ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং সমাজ।

একজন নিম্নবিত্তের ক্রোধান্বিত হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটাই সহজাত প্রতিক্রিয়া, আবার অসাম্যকে যুক্তির মাধ্যমে চিহ্নিত করে বিনম্রভাবে উপস্থাপন করাটাই ভদ্রতা মনে করেন মধ্যবিত্ত সমাজ। নৈতিকতা বা সুপার ইগোর প্রশ্নে ব্যক্তির আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভৌগলিক সীমানাও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। তবে শিশুর জীবনে বাবা মায়ের আচরণ অভিব্যক্তি, অভিরুচি এবং সহপাঠী বা খেলার সাথীদের সঙ্গে কথোপকথন, ভাব বিনিময়  খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অসুস্থ  না হয়েও প্রায়ই অসুস্থতার কথা বলে সামাজিক অনুষ্ঠানে বারবার যাওয়া থেকে বিরত থাকা দেখে সন্তানের মাঝে বিষয়টি প্রভাব ফেলতে পারে। হয়তো পরবর্তিতে সেও শিখে নেয় নিজস্ব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য মিথ্যা বলা একটা ভালো কৌশল এবং এতে সহজে উদ্দেশ্য সাধিত হয়।

সংক্ষেপে বললে শিশুদের সঙ্গে বা সামনে মিথ্যা না বলে বরং সত্যাটা প্রকাশ করে এর প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দেয়াটাই সমীচীন। অন্ধভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলায় অভ্যস্ত না করে ধর্মের যৌক্তিক দিকগুলো দৃষ্টিগ্রাহ্য উদাহরণের মাধ্যমে তাদের মতো করে বুঝিয়ে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি ‘শ্রেণি বৈষম্য/ উঁচু-নীচু’ তত্ত্বের বিষবাষ্প থেকে সন্তানকে দূরে রেখে শিশুর মানবিকতাবোধ সম্পন্ন করে গড়ে তোলার দিকে লক্ষ্য রাখা বাবা মায়ের অবশ্য কর্তব্য।

সময় স্বল্পতার জন্য আজকাল সদুপদেশ দেওয়াটা অনেকটাই লোপ পেয়েছে আমাদের সমাজে। ‘গুরুজনে করো নতি’, ‘শিক্ষককে সম্মান করো’, ‘ছোটকে স্নেহ করো’, ‘দুর্জন বিদ্বান হইলেও পরিত্যাজ্য’, কিংবা ‘খলের ছলের অভাব হয়না’ ইত্যাদি আমরা সেই ছোটবেলায় পড়েছি। হয়তো নতুন করে সেগুলো রপ্ত করে সন্তানদের শেখানোর সময় এসেছে।
শিশুরা প্রথম দিকে শুধু অনুকরণ করে তার অনভিজ্ঞতার কারণে। তার দৃষ্টি বা শ্রবণ সীমাই  তার পৃথিবী। ক্রমান্বয়ে সে ভাষা, ভঙ্গি, অভিব্যক্তি রপ্ত করে। বিধি নিষেধের বোধের ডালপালা ধীরে ধীরে প্রসারিত হয় তার ছোট্ট মনে। সে যুক্তির অস্তিত্ত্ব টের পায় একসময়। উৎসাহী অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে যুক্তির আঘাতে সীমানা প্রাচীর ভাঙার খেলায় মেতে ওঠে। সবুজ স্নায়ু কোষগুলোই তার হাত ধরে নিয়ম ভাঙ্গার পথ দেখায়। তাই মিথ্যুক, দুষ্টু , অবাধ্য বা বেয়াড়া বলে বেদম প্রহার বা গাল মন্দের আগে ভাবা উচিত ‘আমরা কি তাদের সঠিক পথ দেখাচ্ছি?’

ডা. মো. সালেহ উদ্দীন এম ডি,

ফেইজ এ (সাইকিয়েট্রি) ডিপার্টমেন্ট অফ সাইকিয়েট্রি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

mohammad.salehuddin@gmail.com

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2024