উইলিয়াম বি মাইলাম: পাকিস্তানের সামাজিক বৈঠকগুলোতে ইদানীং সঙ্কট সমাধানের বাংলাদেশ স্টাইল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। এমনকি আমি এক অথবা দুই বার ইংরেজি মাধ্যমের সংবাদপত্রের কলামেও এ শব্দ দেখেছি। আমি ধারণা করতে পারি ২০০৭ সালে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের দিকে ইঙ্গিত করেই এ আলোচনা হয়।
মিথ রয়েছে যে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, বিচার বিভাগ এবং রাজনীতিবিদদের একটি অংশ যৌথভাবে বিএনপি সরকারের পতনের কৌশল নির্ধারণ করেছিল। সেই সময় অভ্যুত্থানের নায়কেরা দাবি করেছিলেন, তাদের পরিকল্পনা হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিদ্বেষের বৃত্ত থেকে বের করে নিয়ে আসা। কিন্তু এত সহজে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনার আবেদন রোমান্টিক আবেদনে পরিণত হয়েছিল। তাদের পরিকল্পনার মধ্যে ছিল দু’টি প্রধান দলের দুই নারী নেত্রীকে রাজনীতি থেকে বিদায় করা, রাজনৈতিক দলগুলোকে সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দলে পরিণত করা। তারা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদের লম্বা তালিকা তৈরি করেছিল। তাদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। যারা বাংলাদেশকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের তালিকায় শীর্ষ দুর্নীতিবাজ দেশে পরিণত করেছিল। সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের সৎ উদ্দেশ্যে ছিল। কিন্তু ভুল ধারণার কারণে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার সংবাদ মাধ্যমের ওপর দৃষ্টিপাত করলে এটা বোঝা যায় কেন সামাজিক বৈঠকখানাগুলোতে সঙ্কট সমাধানের বাংলাদেশ স্টাইল নিয়ে আলোচনা বহু আগেই বন্ধ হওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশে এখন জগাখিচুড়ি অবস্থা। পাকিস্তান আমলের চেয়েও বাংলাদেশের রাজনীতি এখন বেশি ঘোলাটে। সমপ্রতি বাংলাদেশের রাজপথে একশ’র মতো ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের পটভূমিতে সহিংসতায় তাদের হত্যা করা হয়। যদি পরিস্থিতি শান্ত না হয়, তবে এ সংখ্যা বাড়তে থাকবে, যা পাকিস্তান আমলে শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিরীহ বেসামরিক নাগরিক হত্যার সংখ্যার চেয়েও বেশি। ২০০৭ সালের সামরিক হস্তক্ষেপ পরিকল্পিত চক্রান্ত ছিল না। যদিও কোন কোন পর্যবেক্ষক ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। সেনাবাহিনী যদি সে সময় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতো তাহলে প্রেসিডেন্ট সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিতেন বিরোধীদের দমন করার জন্য। সেনাবাহিনী যদি সে নির্দেশ না মানতো তা হতো রাষ্ট্রদ্রোহিতা। তারা যদি সে নির্দেশ মানতো রাজপথ বাঙালিদের রক্তে রক্তাক্ত হতো। সামরিক হস্তক্ষেপ এবং বিএনপি সমর্থিত সরকারকে উৎখাত করাও অসাংবিধানিক ছিল। কিন্তু বেসামরিক মোড়কে সামরিক অভ্যুত্থান শুধু রক্তপাতই এড়ায়নি, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকাও বহাল রেখেছে। সেনাসমর্থিত সরকার দুই বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করে। কিন্তু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে তাদের স্বপ্ন ব্যর্থ হয়।
সম্ভবত কিছু কিছু ধারণা সেনাবাহিনীর মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছিল। সবচেয়ে বড় ব্যাপার কোন সেনাবাহিনীর দ্বারাই দুই বছরে সমাজ বদলে দেয়া সম্ভব নয়। সে সেনাবাহিনী যত কঠোরই হোক না কেন। রাজনৈতিক দল এবং স্বার্থান্বেষী মহল অপেক্ষায় থাকে। দুই বছরের সেনা বা অন্তর্বর্তীকালীন শাসন শেষে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস বিজয় অর্জন করে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সমর্থন লাভ করে দলটি। এই বিজয়ে শিগগিরই সরকারের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মনোভাব দেখা যেতে থাকে, যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দেখা গেছে, কোন দল যদি কোন নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে তাহলে সে দলের নেতা অথবা নেত্রী মনে করে থাকেন যে তিনিই জাতির একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী। সঙ্কট সমাধানের বাংলাদেশী স্টাইল গত নির্বাচনে এমন এক মেজরিটি পার্টি তৈরি করে যারা গ্রহণযোগ্যতার বাইরে প্রতিশোধপরায়ণ এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে এবং পুলিশি রাষ্ট্রের অনেক পদ্ধতি প্রয়োগ করছে। কিভাবে সংস্কার হবে? সামরিক অভ্যুত্থানের নায়ক অথবা সুশীল সমাজের ব্যক্তিরা কি রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার শিকড়ে যেতে পেরেছেন। এ সঙ্কট পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত এবং সমাধানও পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। গত কয়েক মাসে এ নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমি তালগোল পাকিয়ে ফেলেছি। রাজনৈতিক দিক থেকে এটা ২৫ বছর সময়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ’৯০ দশকের শুরুতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তোরণ শুরু হয়। ’৯০ দশকের শেষ দিকে এসে দক্ষিণ এশিয়া এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ স্বৈরতন্ত্র থেকে পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ ঘটায়। এ পরিভ্রমণ প্রগতিশীল এবং রৈখিক। কিছু কিছু উন্নয়নশীল দেশের পরিবর্তন অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। তারা পুরো গণতান্ত্রিক নয়, পুরো স্বৈরতান্ত্রিক নয় এমন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এই ধরনের ‘ফর্মাল গণতন্ত্রে’ হয়তো বা সব ধরনের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান থাকে। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান ব্যক্তিস্বার্থে ম্যানেজ করা হয় অথবা অপব্যবহার করা হয়। এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হাইব্রিড ব্যবস্থা হিসেবে অভিহিত করা যায়। ‘ইতিহাসের শেষে’ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশেই এ দৃশ্য যাচ্ছে। একজন পণ্ডিতের ভাষায় এসব হাইব্রিড দেশের জনগোষ্ঠী তাদের ভোটাধিকার পেয়েছে, কিন্তু বিভিন্ন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে ব্যর্থ হয়েছে।
সাংবিধানিক গণতন্ত্রায়ন, আইনের শাসন, রাজনৈতিক জবাবদিহিতা থেকে এসব দেশের জনগোষ্ঠী বঞ্চিত। এটা বুঝতে পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন নেই যে, বাংলাদেশও পরিচালিত হচ্ছে হাইব্রিড ব্যবস্থায়। এটা সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে যে, সঙ্কট সমাধানের বাংলাদেশ স্টাইল পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে। এটা দেশকে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে না নিয়ে স্বৈরতন্ত্রের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। যেসব প্রতিষ্ঠান অতীতে স্বাধীন ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের চেষ্টা হয়েছে যেমন বিচার বিভাগকে আরও দুর্বল এবং রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। বেসরকারি সংগঠনগুলোকে দুর্বল করা হয়েছে।
উইলিয়াম বি মাইলাম বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত
Leave a Reply