ড. সা’দত হুসাইন: আহমেদ সাহেব কিশোর বয়স থেকেই কিছুটা উচ্চাভিলাষী। পাদপ্রদীপের আলোয় থেকে কিছুটা দৃশ্যমান হতে পারলে তিনি পরম আনন্দ অনুভব করেন। তিনি চান যে তাঁর দিকে লোকজন যেন সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকায়, লক্ষে-অলক্ষে তাঁর গুণগান করে, কোনো জায়গায় তিনি গেলে ভক্তকুল যেন গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য গলাধঃকরণ করে।
তিনি স্টেজে বসতে ভালোবাসেন, বক্তৃতা দিতে ভালোবাসেন, তারও চেয়ে বেশি ভালোবাসেন নামিদামি ব্যক্তিদের সঙ্গে ফটোসেশনে যোগ দিতে। খেলা দেখতে গেলে তাঁর মনে হয়, তিনি যদি চৌকস খেলোয়াড় হতে পারতেন, তাহলে কত মজা হতো! হাজার হাজার লোক একাগ্র দৃষ্টিতে তাঁর খেলা দেখত, হাতে তালি দিয়ে তাঁকে উৎসাহ দিত, অটোগ্রাফের জন্য তাঁকে ঘিরে ধরত, আরো কত কী! গানের অনুষ্ঠানে গেলে তাঁর মনে হয় গানবাজনা না শিখে তিনি বিরাট ভুল করেছেন। বড় গায়কদের গান শোনার জন্য হাজার হাজার লোক ভিড় করে, মেয়েরা গায়কদের কাছে যেতে চায়, তাদের কথা শুনতে চায়, ফটো তুলতে চায়।
গায়কদের জীবনে রূপ-রসের অভাব নেই। সব জায়গায়ই তাদের আলাদা কদর। তাদের মতো হতে পারলে জীবনটা আনন্দে ভরে থাকত। ভক্ত, বিশেষ করে মহিলা ভক্ত পরিবৃত হয়ে থাকার আনন্দই আলাদা। আজকাল দেখা যাচ্ছে, কবি-সাহিত্যিক, শিল্পীদেরও অনুরক্ত ভক্তের অভাব নেই। তাদের গুণগানে লোকজন ব্যস্ত। সভা-সমিতিতে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি হিসেবে তাঁরা অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে বসেন। সভা শেষে সবাই তাঁদের কাছে যেতে চায়। তাঁরা হাত নেড়ে নিজের বা উদ্যোক্তাদের গাড়ি চেপে বিদায় নেন।
বিষয়টি আহমেদ সাহেব এত দিন ভালোভাবে খতিয়ে দেখেননি। যেহেতু তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা রয়েছে, তাই অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি তাঁর দৃষ্টিকে তীক্ষভাবে আকৃষ্ট করেনি। এটি এখনো গল্পকাহিনীর চৌহদ্দিতে আবদ্ধ রয়েছে। তিনি শুনেছেন খেলোয়াড়রা অনেকেই বছরে শত কোটি টাকা আয় করে, সিনেমার নায়ক-নায়িকারা বছরে ১৫-২০ কোটি টাকা শুধু আয়কর দেয়। তাদের আয় নিশ্চয় শত কোটি টাকার কাছাকাছি! ওরা এত টাকা খরচ করে কিভাবে?
একদিকে খ্যাতি-পরিচিতি, ভক্তকুল পরিবেষ্টিত হয়ে সময় কাটানোর আনন্দ। অন্যদিকে অঢেল সম্পদের তুলতুলে বিছানায় গড়াগড়ি দেওয়া, ইচ্ছামতো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানো, প্রায় প্রতিদিন টিভিতে, খবরের কাগজে নানা রূপে ছবি প্রকাশ হওয়া—সবই বড় আনন্দের ব্যাপার। সমাজে ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর অবস্থান এখনো উঁচুতে নয়। কিছু লোক তাঁকে চেনে-জানে, কিছুটা সম্ভ্রম দেখায়, সুবিধা বুঝে গুণগান করে।
তবে তিনি এখনো অগণিত লোকের কাছে ‘হিরো’ হতে পারেননি। চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রসিদ্ধি অর্জন, সেলিব্রিটি হওয়া, নানা ধরনের পুরস্কার পাওয়ার শখ তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
তাঁর বন্ধু আলী সাহেব অন্য ধাঁচের মানুষ। প্রসিদ্ধি পাওয়া বা সেলিব্রিটি হওয়ার তাঁর কোনো অভিলাষ নেই। তিনি মোটামুটি সচ্ছল লোক। খেয়ে-পরে ভালো আছেন। নিজের মতো করে চলাফেরা করতে পছন্দ করেন। সন্ধ্যার আড্ডায় পরিমিত সরাব পান করেন। লোকের হাতের তালি, ‘হিরো’কে ঘিরে তাদের দাঁড়িয়ে থাকা, তার পিছু নেওয়া, এখান-সেখান থেকে নানা নামের পুরস্কার পাওয়া—এ সব তাঁর কাছে অর্থহীন ‘ফজুল’ কাজ বলে মনে হয়।
এর মধ্যে একমাত্র অর্থবহ উপাদান হচ্ছে পুরস্কারের টাকা, যদি পুরস্কারের সঙ্গে তা পাওয়া যায়। অর্থের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার আছে, যা জীবনকে সহজ ও উপভোগ্য করে। এ কথাগুলো আলী সাহেব তাঁর বন্ধু আহমেদ সাহেবকে বলেছেন। তাতে আহমেদ সাহেবের ভাবান্তর হয়েছে বলে মনে হয় না। আলী সাহেবের জীবন অভিজ্ঞতায় ভরা, তিনি পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হন্যে হয়ে রিকশার খোঁজ করতে দেখেছেন। এমনও শুনেছেন পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সোনার মেডেল বিক্রি করে একজন কৃতী ব্যক্তি সংসারের খরচ নির্বাহ করেছেন। এ ধরনের পুরস্কার ব্যক্তিকে সত্যিকার অর্থে মহিমান্বিত করেছিল কি না সে ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সাম্প্রতিককালে পুরস্কারের নানা গল্পে নৈতিকতার প্রশ্নটিও উঠে আসছে। এমন কথা শোনা যায় যে পুরস্কারপ্রাপ্তরা পুরো অ্যাওয়ার্ডটা ‘স্পন্সর’ করেছেন। অঢেল সম্পদের মালিক, বৃহৎ শিল্পপতি, করপোরেট অঙ্গনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ রয়েছে।
অনেক অখ্যাত ভুঁইফোড় সংগঠন বিভিন্ন চটকদার নামে, বিশেষ করে মহাত্মন ব্যক্তিদের নামে পুরস্কার দিচ্ছে, সত্যিকার অর্থে যার কোনো আগা-মাথা নেই। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে দু-একজন প্রথিতযশা ব্যক্তি থাকলেও বাকিদের নাম-পরিচয় প্রায় অজানা। তবে তারা শিল্প-কারখানার মালিক অথবা মালিকের সন্তান কিংবা অঢেল সম্পদের মালিক। পুরস্কারের অর্থ ও অনুষ্ঠানের খরচ তাদের কেউ জুগিয়েছে। জাতীয় পুরস্কারের নেপথ্য কাহিনীও আলী সাহেবের ভালোভাবে জানা আছে।
বিভিন্ন মহলের উচ্চপর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব রয়েছে। জ্ঞানবুদ্ধির বদৌলতে তিনি তাদের আস্থা ও শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর সঙ্গে গল্প-গুজব করে, নিজ অঙ্গনের খবর তাঁকে শুনিয়ে তারা তৃপ্তি বোধ করে, সে সুবাদে তিনি জেনেছেন, পুরস্কার প্রদান কমিটির চেয়ারম্যান কিভাবে পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় নিজ নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। প্রথমে কমিটিতে তাঁর অনুগত সদস্যকে দিয়ে নিজের নাম প্রস্তাব করিয়েছেন। কমিটির অন্য সহকর্মী সদস্যরা সমস্বরে এ প্রস্তাব সমর্থন করে চেয়ারম্যান (মাননীয় মন্ত্রী) মহোদয়ের গুণগান করেছেন। চেয়ারম্যান ভাব দেখিয়েছেন যে সবাই বলায় বাধ্য হয়ে তিনি মনোনীতদের তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তবে সব কিছু নির্ভর করবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে কিছুই বলতে পারবেন না। তিনি ভালো করেই জানেন যে আসলে এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর কিছুই বলতে হবে না।
এ কাজটা কমিটিভুক্ত তাঁর কোনো সহকর্মী অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা করে ফেলবেন। এভাবেই কমিটির চেয়ারম্যান মাননীয় মন্ত্রী হয়ে গেলেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি। অন্যান্য অনেক পুরস্কারের ক্ষেত্রে এ রূপ ঘটে থাকে। নিজে না হলেও ছেলেমেয়ে, ভাইবোন এমনিভাবে হয়ে যান গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজয়ী বীর। পরবর্তীকালে কোনো সুবর্ণ সুযোগে লোকমুখে শোনা যায় তাদের জয়গান।
আন্তর্জাতিক পুরস্কার বা স্বীকৃতির ক্ষেত্রেও খাতির, তদবির, ও লবিং যে একেবারে কাজ করে না তা নয়। কৃতিত্ব বা পারফরম্যান্সের একটা পর্যায়ে গেলে ওই পর্যায়ে অবস্থিত যেকোনো ব্যক্তিকে পুরস্কারে ভূষিত করা যায়, বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া যায়।
চূড়ান্ত বাছাইয়ের ব্যাপারটি কিছুটা ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর সমর্থন, কিছুটা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। সাহিত্য, অর্থনীতি ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়া ব্যক্তিদের কাজকর্ম (work) সম্পর্কে আমার সামান্য ধারণা রয়েছে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোয় আমার ধারণা একেবারেই ক্ষীণ। সে সম্পর্কে আমি কোনো মন্তব্য করছি না।
অপর তিনটি ক্ষেত্রে যাঁরা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের কৃতিত্ব ও অবদান যে সে অঙ্গনে সর্বোচ্চ এমনটি বলা যাবে না। রবীন্দ্রনাথের বন্ধু-শুভানুধ্যায়ীরা যদি তাঁর লেখা বিদেশি ভাষায় যথানিয়মে অনুবাদ না করতেন, তাহলে তিনি নোবেল পুরস্কার পেতেন কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে।
অথচ নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকদের অনেকের লেখা পড়ে ও তাদের সাহিত্যকর্মের বর্ণনা পড়ে মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে ১০-১২টি নোবেল পুরস্কার দিলেও তাতে বড় একটা অন্যায় হতো না। অর্থনীতিতে স্যামুয়েলসন, অ্যারো, কুজনেট, টিম্বারজেন, ফ্রিডম্যান এই অঙ্গনের সেরা পণ্ডিত হিসেবে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই সর্বজনস্বীকৃত ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তাঁদের নোবেল পুরস্কার পাওয়া ছিল অতি স্বাভাবিক ব্যাপার।
কিন্তু পরবর্তীকালে এ বিষয়ে অনেকেই পুরস্কার পেয়েছেন, যাঁরা এ অঙ্গনে তেমন প্রথিতযশা ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তাঁদের কাজকর্মও অর্থনীতির অনালোকিত এলাকায় অবস্থিত। প্রথমোক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় তাঁদের অখ্যাত বললেও অত্যুক্তি হবে না। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বেশ কয়েকজনের ব্যাপারে বিতর্ক রয়েছে। তাদের প্রশংসাপত্রে নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলা হয়েছে।
এ ধরনের কথা আরো বহু লোক সম্পর্কে বলা যায়, কিন্তু তাঁরা নোবেল পুরস্কার তো দূরের কথা; হয়তো জীবনে কোনো পুরস্কারই পাননি। তবু তাঁদের কৃতিত্ব ও মাহাত্ম্য পুরস্কারের ঊর্ধ্বে, নিজ গৌরবে বলীয়ান, যথার্থই মানবকল্যাণে প্রোথিত। তাঁরা সত্যিকার অর্থেই কীর্তিমান।
আহমেদ সাহেব এত প্যাঁচগোছ বুঝেও বুঝতে চান না। এসব কথাবার্তাকে তিনি শিক্ষিত লোকের বাড়তি প্যাঁচাল মনে করেন। তিনি ‘সেলিব্রিটি’ হতে চান, প্রসিদ্ধ হতে চান। কৌশল হিসেবে ছোটখাটো অনৈতিক চাল দিতেও রাজি। প্রসিদ্ধ হলে দূরে থেকে লোকে তাকিয়ে দেখে, কাছে গেলে সম্ভ্রমে কথা বলে, প্রশংসায় গদগদ হয়, একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ফটো তুলতে চায়, তার ছোটখাটো কাজ অন্যরা করে দেয়, মহিলারাও ভিজিটিং কার্ড চায়, নিজেদের নম্বর তাকে দিয়ে দেয়। এর সবই আনন্দের ব্যাপার, আহমেদ সাহেবের চিন্তা করতে খুব ভালো লাগে।
তবে ক্রীড়া, সংস্কৃতি, সাহিত্য ও বিনোদনজগতের ‘সেলিব্রিটি’দের কথা ভাবলে আহমেদ সাহেব একটু ঘাবড়ে যান। এসব ক্ষেত্রে পুরোপুরি ফাঁকি দেওয়া বা দুই নম্বরী করার বিশেষ অবকাশ নেই। অগণিত দর্শক, শ্রোতা, পাঠক সরাসরি হবু সেলিব্রিটিদের কাজ মূল্যায়ন করে।
জনচিত্তাকর্ষক পারফরম্যান্সের ধারাবাহিক পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে সেলিব্রিটি হলে অন্য অনেক প্রাপ্তির মধ্যে আয়-উপার্জন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তাদের অনেকের সম্পদ ২০০-২৫০ কোটি। কারো কারো সম্পদ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের অনেকের বয়স আবার ৪০-এর সীমা পেরোয়নি।
আহমেদ সাহেব ভাবেন, এত অল্প বয়সে এত বেশি পরিমাণ টাকার মালিক হলে তাদের মাথা ঠিক থাকে কেমন করে। এত টাকা দিয়ে তারা কী করবে। তাঁর যদি এর ১০ শতাংশ টাকা থাকত, তবে জনপ্রতিনিধি হওয়া ছাড়া ও বড় বড় বহু সংগঠন তিনি দখল করে বসতেন। তখন আর তাকে পায় কে? যেদিকে তাকানো যায় তার নেতৃত্বাধীন সংগঠন চোখে পড়ে।
এর মধ্যে আয়বর্ধক কিছু সংগঠনও থাকবে, যা থেকে ফিবছর অনেক টাকা মুনাফা হিসেবে আসবে। প্রসিদ্ধি-প্রভাবের সঙ্গে মণি-কাঞ্চনের সংযোগ দেহমনে নেশা ধরিয়ে দেয়। খ্যাতি-প্রতিপত্তির সঙ্গে বিশাল আয়ের সম্ভাবনা আলী সাহেবের সব মন্তব্য, বুদ্ধি-পরামর্শকে দূরে-বহু দূরে ঠেলে দেয়।
তবু মাঝেমধ্যে একটা চিন্তা, একটা গোলকধাঁধা, একটা রহস্য আহমেদ সাহেবকে চিন্তিত করে, ভাবিয়ে তোলে। দমিয়ে দেয়। বারবার তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, এত প্রসিদ্ধি, এত প্রতিপত্তি, হাততালি, অর্থসম্পদের মধ্যেও কোনো কোনো সেলিব্রিটি এত অসুখী হয় কেন? কেন তারা হতাশায় ভোগে, আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, সামনে দাঁড়িয়ে আলী সাহেব। তাঁর ঐন্দ্রজালিক প্রভাব থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। তাঁর বক্তব্যের ফেরারি চরিত্র এক অবাক করা ব্যাপার। হারিয়ে গিয়েও বারবার ফিরে আসে। মাঝেমধ্যে আহমেদ সাহেবকে চিন্তামুক্ত করে, স্বস্তি দেয়।
এক বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে নিবিষ্ট মনে চিন্তা করতে থাকলে হঠাৎ মাথা খুলে যায়। অনেক দিন আগে শোনা আলী সাহেবের একটি মন্তব্য তাঁর মনের জটলা পাকানো প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে সহায়ক মনে হলো। তিনি নতুন করে মন্তব্যটি বুঝতে চেষ্টা করলেন।
আলী সাহেব বলেছিলেন যে মানুষের জীবনে তিনটা ভাগ রয়েছে : দৃশ্যমান জনজীবন (Public life), পারিবারিক জীবন (Family life) ও একান্ত ব্যক্তিগত (Private life)। এই তিন অংশের স্বতন্ত্র অবস্থান ও অস্তিত্ব রয়েছে। একের সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক থাকলেও তা সব সময় নিবিড় হয় না। এক অংশের ওপর অন্য অংশের প্রভাব থাকা অস্বাভাবিক নয়।
তবে এ প্রভাব এমন নয় যে এক অংশ অপর অংশকে নিয়ন্ত্রণ করবে। সে কারণে জনজীবন বা কর্মজীবনে সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে একসময় সেলিব্রিটির পর্যায়ে পৌঁছলেও পারিবারিক জীবন সাজানো-গোছানো ও সুখপ্রদ না-ও হতে পারে। মহামতী সক্রেটিসের জীবন এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। এ ধরনের আরো বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। কথায় বলে দুজন লোক হলেই এটি সংগঠন হয়ে যায়, একে অপরকে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়।
সংগঠনের সদস্যদের পছন্দ-অপছন্দ ও স্বার্থ সাংঘর্ষিক হলে একে অপরকে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় না। দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয় অনিবার্য। একইভাবে সময় বিশেষে দেখা যায় যে ব্যক্তিগত জীবনের অনুধাবন, অনুভূতি, সমস্যা, সংকট জনজীবন বা কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বাইরে।
এর অনেক কিছুই একান্ত আপন, যা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শুধু নিজের কাছেই সংরক্ষিত রাখতে হয়। বাংলা সাহিত্যের এক খ্যাতিমান লেখক তাঁর মারাত্মক দুরারোগ্য অসুখের কথা দীর্ঘ সময় লুকিয়ে রেখে অদম্য নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে লেখালেখি করে গেছেন। তাঁর ভেতরে যে তোলপাড় চলেছে বাইরের লোককে তা ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেননি।
আহমেদ সাহেব তাঁর পাগলা বন্ধুর বক্তব্যের গূঢ় তাৎপর্য এতক্ষণে অনেকটা বুঝতে পেরেছেন। যত খ্যাতি, প্রতিপত্তি, বিত্তবৈভব থাকুক না কেন, মানুষ তার সুখশান্তির পুরো নিয়ন্ত্রক নয়। এর জন্য তাকে ভাগ্যের ওপর নির্ভর করতে হবে। এর থেকে পরিত্রাণ নেই। আহমেদ সাহেব এখন অনেকটা শান্ত, সুস্থির। আলী সাহেবের প্রতি তিনি একধরনের কৃতজ্ঞতা অনুভব করছেন।
লেখক: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান