সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০৬:১১

সুখী হওয়ার গোপন টিপস

সুখী হওয়ার গোপন টিপস

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আরিফ আহম্মেদ : সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স বা মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানের নতুন এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, যারা নিজেদের ব্যস্ত রাখতে যে কোন ইতিবাচক কাজকে নির্বাচন করতে পারেন, সে কাজটি যদি নিছক উদ্দেশ্যবিহীনও হয়, তারাও নিষ্কর্মা বা অলস ব্যক্তিদের চেয়ে সুখী।

গ্রীক পুরাণ বা মাইথোলজিতে বর্ণিত আছে যে, গ্রীক দেবতারা করিন্থ রাজ্যের রাজা সিসিফাসকে একটি দণ্ড দিয়েছিলেন। দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করে ভারি একটি পাথরখণ্ডকে গড়িয়ে গড়িয়ে মৃতদের পাহাড়ের চূড়ার কাছাকাছি ওঠানোর পর সেটিকে পুনরায় আগের স্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে। ওঠানো-নামানোর এ শাস্তিটি অনন্তকাল তাকে ভোগ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, গ্রীক দেবতারা পৌরাণিক রাজা সিসিফাসের প্রতি সদয়াচরণই করেছিলেন।

কারণ, এ দণ্ডের পরিবর্তে তাকে যদি নিশ্চুপ হয়ে অপলক দৃষ্টে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা অর্থাৎ, শাশ্বতকাল নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকার শাস্তি দেয়া হতো, তা ন্যায়সঙ্গত বিচার হতো না। এ ধরনের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন ব্যস্ত থাকার বিষয়ের ওপর পরিচালিত নতুন এক গবেষণার গবেষক ও মনস্তত্ত্ববিদরা। গবেষকরা বলছেন, যারা ব্যস্ত থাকার জন্য কোন কাজ বেছে নিতে পারেন, সে কাজটি যদি নিছক উদ্দেশ্যবিহীনও হয়, তারা অলস মানুষদের তুলনায় সুখী জীবনযাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্রিস্টোফার বলছিলেন, একটি সাধারণ ঘটনাপ্রবাহ আমাকে আকৃষ্ট করে। তা হচ্ছে, আধুনিক সমাজে মানুষ কেন ও কিভাবে নিজেদের কাজ নিয়ে এতোটা ব্যস্ত ও নিমগ্ন থাকে।

অ্যাডেল এক্স ইয়াং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ও আরও দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি ব্যস্ত থাকার বিষয়ের ওপর গবেষণা করছেন। তার মতে, মানুষ চতুর্দিকে ছুটে বেড়াচ্ছে, প্রতিনিয়ত কঠোর পরিশ্রম ও সংগ্রাম করছে। আগে এ বিষয়গুলো মানুষের সামর্থ্যরে বাইরে বলে ধারণা করা হতো। কিন্তু সে ধারণায় আমূল এক পরিবর্তন এসেছে। অতিরিক্ত এ পরিশ্রমের পেছনে কিছু যুক্তিযুক্ত ও অকাট্য কারণ খুঁজে পেয়েছেন মনস্তত্ত্ববিদরা। সেগুলো হচ্ছে, বাসস্থানের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা, অর্থ উপার্জন করা, যশ বা খ্যাতি বাড়তে থাকা, অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলা, অপরকে সহযোগিতা করার মনোভাব ও এরকম আরও বহু কিছু, যা মানুষের জীবনে প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। গাণিতিক হিসাবে, প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্রমোন্নতির সঙ্গে কাজ বাড়ার বিষয়টি সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকে। তবে ক্রিস্টোফার বলছিলেন, আমি মনে করি, মূল ব্যাপারটি আরও গভীরে। আর তা হলো, আমাদের কাজ করার জন্য রয়েছে অপরিমেয় ক্ষমতা, সামর্থ্য ও শক্তি। তিনি বলেন, তাছাড়াও অলসতাকে এড়িয়ে চলার একটি সহজাত প্রবণতা আমাদের মধ্যে সক্রিয় থাকে। এবার আসা যাক গবেষণা প্রসঙ্গে।

বহুল আলোচিত এ গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন বেশ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক। তাদেরকে কয়েকটি দলে ভাগ করে দেয়া হয়। সফলভাবে গবেষণাটি পরিচালনার জন্য প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবক দলকে মাঠ-পর্যায়ের একটি জরিপে অংশ নিতে হয়েছিল। একটি জরিপ শেষ হওয়ার পর পরবর্তী জরিপের প্রস্তুতির জন্য তাদের ১৫ মিনিট অপেক্ষা করানো হয়।  তবে, স্বেচ্ছাসেবক দলগুলোর প্রতিটি সদস্যের স্বাধীন ইচ্ছা প্রয়োগের মাধ্যমে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্ব-নির্দেশনা ছিল। দুটি জরিপের জন্য কয়েকটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম নির্ধারণ করে দেয়া হলো। প্রতিটি জরিপ সম্পন্ন হলে, স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের পর্যবেক্ষণে প্রাপ্ত ফলাফল কাছাকাছি দুটি নির্ধারিত স্থানে জমা দিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে বাকি ১৫ মিনিট তাদের অপেক্ষা করে কাটাতে হবে। তবে কেউ যদি চান, তিনি ওই ফলাফল দূরের একটি সুনির্দিষ্ট স্থানেও জমা দিতে পারবেন। আর এক্ষেত্রে ১৫ মিনিট বসে থেকে অপেক্ষার পরিবর্তে হেঁটে যাওয়া-আসায় পুরো সময়টা ব্যয় হবে। অর্থাৎ ইচ্ছা করলে ওই ১৫ মিনিটও তারা নিজেদের ব্যস্ত রাখতে পারবেন। তবে দুটি ক্ষেত্রেই জরিপের ফল হস্তান্তর করার পরপরই, প্রত্যেক সদস্যকে একটি মাঝারি আকারের ক্যান্ডি বার বা চকোলেট দেয়া হবে।

মজার ব্যাপার হলো, স্বেচ্ছাসেবকদের যে দলটি ফলাফল জমা দেয়ার জন্য বসে অপেক্ষা করার পরিবর্তে দূরবর্তী স্থানে হেঁটে যাওয়াকে নির্বাচন করেছিলেন, তাদের বেশ প্রাণবন্ত, প্রফুল্ল, চিন্তামুক্ত ও সতেজ দেখাচ্ছিল। তাদের মোটেই পরিশ্রান্ত মনে হচ্ছিল না। উপরন্তু, কারও কারও উচ্ছ্বল আচরণ অন্যদের বিনোদনের রসদ বা খোরাক যুগিয়েছে। অন্যদিকে, দ্বিতীয় স্বেচ্ছাসেবক দলটির সদস্যরা ১৫ মিনিট বসে অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাদের তুলনামূলক পরিশ্রান্ত, নিষ্প্রভ, কম স্বতঃস্ফূর্ত ও এমনকি কোন কোন সদস্যকে বিমর্ষ ও চিন্তাক্লিষ্ট বলেও মনে হয়েছে। এর মূল কারণ অলস বসে থাকার মাধ্যমে অপ্রাসঙ্গিক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেয়া। এ সমীক্ষায় আরও একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। স্বেচ্ছাসেবকদের মানসিক পরিবর্তনের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন মনস্তত্ত্ববিদরা। উভয় জরিপের ফলাফল হস্তান্তরের জন্য নিকটবর্তী নির্ধারিত দুটি স্থানে যে স্বেচ্ছাসেবকদের পরপর দুই বার একই স্বাদের চকোলেট বা ক্যান্ডি বার দেয়া হয়েছিল, তারা দূরে গিয়ে ফল জমা দেয়ার ব্যাপারে অনীহা বা উদাসীনতা প্রদর্শন করেছিলেন। অলসভাবে বসে অপেক্ষা বা জিরিয়ে নিয়ে সময়টাকে কাটানোর সিদ্ধান্তই তাদের কাছে শ্রেয় মনে হয়েছিল।

অন্যদিকে, যাদের দুটি ভিন্ন স্বাদের চকোলেট দেয়া হয়েছিল, তারা আরও দূরে হেঁটে গিয়ে ফল হস্তান্তরের ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেন। বিশেষজ্ঞরা মানুষের মনস্তত্ত্বের এ ভিন্নধর্মী আচরণটিকে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে একটি যুক্তিনির্ভর যোগসূত্রের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের মতে, যারা ভিন্ন স্বাদের দুটি চকোলেট পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাদের কাছে তা যথার্থ ও ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয়েছে। অর্থাৎ, তাদের কাজ যথাযথভাবে মূল্যায়িত করা হয়েছে। সে কারণে তারা দূরবর্তী স্থানে গিয়ে ফলাফল জমা দেয়ার নবোদ্যম ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। এভাবেই পুরো গবেষণার সমগ্র প্রক্রিয়ার কথা ব্যাখ্যা করেন ক্রিস্টোফার ও তার সহ-গবেষকরা। মানুষের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এ গবেষণাপত্রটি ‘সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।

ক্রিস্টোফার মনে করেন, এ সূত্রটি বহুমাত্রিকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে। তার মতে, মানুষ ব্যস্ত থাকতে পছন্দ করে ও ব্যস্ত থাকার জন্য ন্যায়সঙ্গত প্রতিদানও আশা করে। আর এ সবকিছুই সে করতে চায় নিজেকে, নিজের পরিবারকে, সমাজকে ও দেশকে উন্নত করা ও সামনে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে। ক্রিস্টোফার আরও বলেন, যদি প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে আমরা অলস কিংবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জন্য এমন একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করতে সক্ষম হই, যা তাদের কাজে ব্যস্ত রাখবে ও সেটি এমন কোন কাজ হবে, যা তাদের ক্ষতির কারণ হবে না, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ধ্বংসাত্মক চিন্তা ও নেতিবাচক ব্যস্ততার তুলনায় তা যথেষ্ট ইতিবাচক ও কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। গবেষক ক্রিস্টোফার নিজেও একটি মজার বিষয়ের জন্য বেশ পরিচিত। যখন কোন উপযুক্ত গবেষণার কাজ থাকে না, তিনি তার সহযোগী গবেষক, অধীনস্থ কর্মচারী ও সহকারীদের মাঝে মধ্যে অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যস্ত রাখেন। এ ব্যস্ততার ফলে দুটি জিনিস ধ্বংস হবে- একটি হলো অনির্দিষ্টতা ও অপরটি হতাশা বা উদ্যমহীনতা।

এর ফলে, কর্মক্ষেত্রে ক্লান্তি, শারীরিক বা মানসিক অবসাদ বা অবসন্নতা, দুশ্চিন্তা ও গ্লানি থেকে প্রত্যেকে দূরে থাকতে পারবেন। মনঃসংযোগেও ব্যাঘাত ঘটবে না। ক্রিস্টোফার স্বীকার করেন, আমি জানি যে, এটা মোটেও নীতিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নয়। তবে এটা তাদের প্রফুল্ল ও সুখী থাকতে সহায়তা করে।

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024