চৌধুরী মুমতাজ আহমদ: বৈষ্ণব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসকনের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ যখন মায়াপুরে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন তখন তিনি বৃদ্ধাবস্থায়ও তার বোনের সঙ্গে একান্তে কথোপকথন করেননি। ভক্তরা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্জনে মা, বোন এবং কন্যার সঙ্গে একত্রে উপবেশন করা উচিত নয়।
কেননা, বলবান ইন্দ্রিয়সমূহ অত্যন্ত বিদ্বান ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করতে পারে।’ শ্রী চৈতন্যের ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত কৃষ্ণপ্রেমী ইসকনের সদস্যদের অনেকেও তাই কঠোর সাধনার অংশ হিসেবে নারীসঙ্গ ত্যাগ করেন। বেছে নেন ব্রহ্মচারী জীবন। সিলেটের যুগলটিলা ইসকনেও ৫৮ জন ব্রহ্মচারী আছেন। নারীবিহীন যুগলটিলা মন্দিরের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস নিজেও একজন ব্রহ্মচারী। নারী সংসর্গবর্জিত এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধেই উঠেছে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এ নিয়ে সরব হয়ে উঠেছেন ইসকনেরই সদস্যরা।
‘বৃহত্তর সিলেটের সচেতন ইসকন ভক্তবৃন্দ’ পরিচয়ে এসব অভিযোগ সংবলিত প্রচারপত্রও বিলি করা হচ্ছে। প্রচারপত্রে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে স্বামী পরিত্যক্তা এক স্টাফ নার্সের সঙ্গে ১৯৯৯ সাল থেকে অনৈতিক সম্পর্ক থাকার উল্লেখ রয়েছে। সিলেটের জনৈক ইঞ্জিনিয়ার তার স্ত্রীর সঙ্গে ইসকন অধ্যক্ষের অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ করেছেন বলেও প্রচারপত্রে উল্লেখ রয়েছে।
অভিযোগের ফিরিস্তিতে অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাসের বিরুদ্ধে অবিবাহিত মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে প্রমোদ ভ্রমণের উল্লেখ আছে। প্রচারপত্রে এ অভিযোগের পক্ষে অডিও রেকর্ড রয়েছে বলেও প্রকাশ করা হয়। অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগে ঝড় উঠে সিলেটের ইসকনে। নিয়ম ও শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ইসকনের ৪ সদস্য পাণ্ডব গোবিন্দ দাস, ব্রজকৃষ্ণ দাস, প্রেমনিধি দাস, বিপিনবিহারী দাসকে বহিষ্কারের ঘটনাও ঘটে। বুধবার রাতে এ বহিষ্কারের ঘটনা ঘটলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে ইসকনে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সেখানে উপস্থিত হন সিটি কাউন্সিলর রকিবুল ইসলাম ঝলক, সাবেক কাউন্সিলর আবদুর রকিব বাবলু ও অ্যাডভোকেট প্রদীপ ভট্টাচার্য। তারা বহিষ্কৃতদের আপাতত ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেন ইসকন কর্তৃপক্ষকে।
এ প্রসঙ্গে রকিবুল ইসলাম ঝলক মানবজমিনকে বলেন, ইসকনে উত্তেজনার পর তারা সেখানে গিয়ে আপাতত বহিষ্কারের বিষয়টি স্থগিত রাখতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ২৩শে নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সিলেট সফরের পর তারা বিষয়টি মীমাংসা করে দেবেন। তবে ইসকন কর্তৃপক্ষ রাজি হননি।
তিনি জানান, পরে ইসকনের আরো দুজন সদস্য নিজের ইচ্ছায় বেরিয়ে আসেন। বহিষ্কারের জের ধরে হামলার ঘটনাও ঘটে। ইসকনের অভিযোগ, বহিষ্কৃতরা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিশ্বপতি নিতাই দাস নামের এক ইসকন সদস্যের ওপর হামলা চালিয়েছে। এ সকল ঘটনায় থানায় পাল্টাপাল্টি জিডিও হয়েছে। কোতোয়ালি থানায় প্রথম জিডি করেন নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস (নং ১০১৫)। একই থানায় পাল্টা জিডি (নং ১০২০) করেন ইসকনের বহিষ্কৃত সদস্য গোবিন্দ দাসও।
নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগের ব্যাপারে জানতে মানবজমিনের কথা হয় ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাসের সঙ্গে। তিনি তার বিরুদ্ধে উঠা সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, কুচক্রী একটি মহল তার বিরুদ্ধে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে।
তিনি বলেন, ২০১২ সালেও ওই মহলটি তার বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনেছিল। পরে তা মিথ্যা প্রমাণিত হলে শাস্তি হিসেবে তাদের অন্য মন্দিরে স্থানান্তর করা হয়। পরে তারা ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসেন।
সিলেট ইসকনের বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস বলেন, কুচক্রী ওই মহলটি এবার নতুন কৌশল নিয়ে হাজির হয়েছে। তারা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলার স্বার্থে ৪ জনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ইসকনের বাংলাদেশের দায়িত্বে থাকা কমিটি জেবিসি তদন্ত করে অভিযোগগুলোর কোনো সত্যতা না পেয়ে কয়েকজনকে মৌখিকভাবে শোকজও করেছে বলে জানান তিনি।
তিনি তথ্য দেন, লিখিতভাবে শোকজেরও প্রক্রিয়া চলছে। ইসকন বাংলাদেশের সহ-সভাপতি নবদ্বীপ দ্বিজ গৌরাঙ্গ দাস মানবজমিনকে জানান, চলতি মাসের শেষের দিকে মায়াপুর থেকে জয়পতাকা স্বামী গুরু মহারাজ আসবেন। তিনি এলেই এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
মানবজমিন কথা বলে ইসকনের সিলেট বিভাগীয় কমিটির সদস্য বুদ্ধিগৌর দাসের সঙ্গে। তিনি ইসকনের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগগুলোকে সত্য বলে দাবি করেন। তিনি জানান, অভিযোগগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছেও পৌঁছেছে। কেন্দ্রীয় কমিটি বিভাগীয় কমিটিকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। বিভাগীয় কমিটি তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতাও পেয়েছে বলে জানান তিনি।