দুর্নীতি বিরোধী অনুসন্ধানীমূলক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলেছে, দেশের ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ সেবা গ্রহণকারী কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত শ্রম অভিবাসন। তারা জাতীয় খানা জরিপ ২০১২-এর ফলাফল বিশ্লেষণ করে এ তথ্য দিয়েছে।
টিআইবি তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে, ২০১০ সালের তুলনায় ২০১২ সালে স্বাস্থ্য খাত ছাড়া প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতি ও হয়রানি কমেছে। তবে সব গুরুত্বপূর্ণ খাতে দুর্নীতির ব্যাপকতা উদ্বেগজনক। কিন্তু ঘুষ আদায়ের হার আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে তাদের আগের খানা জরিপের তুলনায় ২০১২ সালে প্রায় প্রতিটি খাতেই দুর্নীতি ও হয়রানি কমেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, ভূমি প্রশাসন, কৃষি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচারিক সেবা, বিদ্যুৎ, ব্যাংকিং, বিমা, কর ও শুল্ক, শ্রম অভিবাসন, এনজিও, অন্যান্য (নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি, বিআরটিএ, ওয়াসা, পাসপোর্ট, বিটিসিএল ইত্যাদি) এই খাতগুলো জরিপের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
টিআইবি আরো বলেছে, সেবা নেওয়ার সময় দেশের ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ খানাকে (এক বাসায় থাকা ও একসঙ্গে খাদ্যগ্রহণকারী পরিবার) কোনো না কোনো খাতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়েছে। জরিপকৃত সব খানার দেওয়া নিয়মবহির্ভূত এই অর্থের গড় ছয় হাজার ৯০০ টাকা। এর ভিত্তিতে টিআইবির প্রাক্কলন বলছে, জাতীয়ভাবে দেওয়া মোট নিয়মবহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ২১ হাজার ৯৫৫ দশমিক ৬ কোটি টাকা, যা ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ এবং জিডিপির ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে জরিপের ফল উপস্থাপন করা হয়। জরিপের ফলাফল উপস্থাপনের সময় টিআইবির গবেষণা ও পলিসি পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান বলেন, এ বছর ১৫ মে থেকে ৪ জুলাইয়ের মধ্যে ৬৪ জেলার সাত হাজার ৯০৬টি খানা থেকে তথ্য নেওয়া হয়। এর মধ্যে গ্রাম এলাকার ৬০ শতাংশ ও শহর এলাকার ৪০ শতাংশ খানা।
টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, প্রত্যাশিত সেবা দিতে পারছে না বলে মানুষ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে কম যাচ্ছে। প্রতিবেশী, বন্ধু বা নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছে। কিন্তু এতেও প্রতারণার শিকার হচ্ছে তারা।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জরিপের বৈজ্ঞানিক মান ও পদ্ধতিগত উৎকর্ষ নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন ছয়জন বিশেষজ্ঞের সহায়তা ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। আরো এক প্রশ্নের জবাবে জনাব ইফতেখারুজ্জামান বলেন, স্বাধীন অবস্থানে থেকে টিআইবি জরিপ পরিচালনা ও ফলাফল বিশ্লেষণ করেছে।
আর সবচেয়ে বেশি শ্রম অভিবাসনে: খাতগুলোর মধ্যে শ্রম অভিবাসন এবার সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত (৭৭ শতাংশ)। এর পরেই আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (৭৫.৮ শতাংশ), ভূমি প্রশাসন (৫৯ শতাংশ), বিচারিক সেবা (৫৭.১ শতাংশ), স্বাস্থ্য (৪০.২ শতাংশ), শিক্ষা (৪০.১ শতাংশ) ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (৩০.৯ শতাংশ)। জরিপকৃত খানার ৩ দশমিক ২ শতাংশ শ্রম অভিবাসনসংক্রান্ত সেবা নিয়েছে। এদের ৭৭ শতাংশই দুর্নীতির শিকার হয়েছে। এ খাতে দুর্নীতির ধরনের মধ্যে আছে: অতিরিক্ত টাকা দেওয়া (৫৪.১ শতাংশ), টাকা আত্মসাৎ (৪৮.২), চুক্তি অনুযায়ী কাজ না দেওয়া (১৮.৩), অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ (১১.৬) ইত্যাদি। দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মধ্যে আছে: আত্মীয়/পরিচিত (৫৫.২ শতাংশ), দালাল (২৯.৩), রিক্রুটিং এজেন্সি (২১.৯ শতাংশ)। ২০১০ সালে শ্রম অভিবাসনকে পৃথক খাত হিসাবে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সেবা খাতে দুর্নীতি কমেছে: ২০১০ সালের সঙ্গে ২০১২ সালের জাতীয় খানা জরিপের তথ্য তুলনা করে টিআইবি বলছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, কৃষি, বিদ্যুৎ, কর ও শুল্ক, শিক্ষা, ব্যাংকিং, বীমা ও এনজিও খাতে দুর্নীতির হার কমেছে। এর সম্ভাব্য কারণের মধ্যে আছে: সচেতনতা বৃদ্ধি, ডিজিটালাইজ করার মাধ্যমে সেবা গ্রহণ সহজ করা, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিবিরোধী প্রশিক্ষণ, জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন এবং নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও এনজিওর সচেতনতামূলক কাজ। ২০১০ সালে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত ছিল বিচারিক সেবা (৮৮ শতাংশ)। এ বছর বিচারিক সেবা নেওয়া ৫৭ দশমিক ১ শতাংশ খানা দুর্নীতি ও হয়রানির শিকার। দুর্নীতি ও হয়রানির মধ্যে আছে: ঘুষ বা অতিরিক্ত অর্থ প্রদান (৬৮ শতাংশ), সময়ক্ষেপণ (৪৩.৬), নির্ধারিত ফি দেওয়া সত্ত্বেও আইনজীবী/মুহুরির অতিরিক্ত টাকা দাবি (১৩.৬) ইত্যাদি। টিআইবি বলছে, দুর্নীতির হার কমলেও এ নিয়ে ‘আত্মসন্তুষ্টির খুব সামান্যই অবকাশ রয়েছে’। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, ভূমি প্রশাসন, বিচারিক সেবা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান খাতের দুর্নীতির ফলে মানুষের হয়রানির অভিজ্ঞতা এখনো সবচেয়ে বেশি। শুধু স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি বেড়েছে: জরিপভুক্ত সব সেবা খাতে দুর্নীতি কমলেও বেড়েছে শুধু স্বাস্থ্য খাতে। ২০১০ সালে স্বাস্থ্যে দুর্নীতির অভিজ্ঞতা ছিল ৩৩.২ শতাংশ খানার। ২০১২ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৪০.২ শতাংশ। জরিপভুক্ত খানার ৭৯.৯ শতাংশ স্বাস্থ্য সেবা নিয়েছে। এর ৫০.২ শতাংশ নেয় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা। টিআইবি শুধু সরকারি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তথ্য দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে (৩৫ শতাংশ)। এরপর জেনারেল হাসপাতাল (২৪.৯) ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (২০.৭)। নতুন চালু করা কমিউনিটি ক্লিনিকেও দুর্নীতি হচ্ছে (১২.৫ শতাংশ)। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সেবা পেতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিতে হয়। যেসব কাজে এ অর্থ দিতে হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে অ্যাম্বুলেন্স (৩২.৬ শতাংশ), ট্রলি ব্যবহার (২০), ব্যান্ডেজ ও ড্রেসিং করানো (১৭.৩) প্রসূতিসেবা (১৭), অস্ত্রোপচার সেবা (১২.১), ইনজেকশন/স্যালাইন গ্রহণ (১২.১)। দরিদ্র বেশি মূল্য দেয়: টিআইবির বিশ্লেষণ বলছে, বেশি আয়ের মানুষ বেশি খাতের সেবা নেয়। সুতরাং ধনীদের দুর্নীতির শিকার হওয়ার প্রবণতাও বেশি। তবে দরিদ্রদের ওপর দুর্নীতির আপেক্ষিক (রিলেটিভ কস্ট অব করাপশন) ব্যয় বেশি। জরিপে বলা হচ্ছে, যেসব খানার মাসিক আয় ১৬ হাজার টাকার নিচে, তারা বার্ষিক ব্যয়ের ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ঘুষ দেয়। আর মাসিক আয় ৬৪ হাজার টাকার ওপরে যাদের, সেসব খানা দেয় বার্ষিক ব্যয়ের ১ শতাংশ।
অভিজ্ঞতাভিত্তিক জরিপ: সংবাদ সম্মেলনে ব্যাখ্যা করে বলা হয়, টিআইবির জাতীয় খানা জরিপ ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স) পৃথক দুটো জিনিস। দুর্নীতির ধারণা সূচকে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতির বিস্তারের ওপর প্রতিফলন থাকে। পক্ষান্তরে খানা জরিপে থাকে ছোট আকারের দুর্নীতি। এই জরিপ তথ্যদাতাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক তথ্যের ওপর নির্ভরশীল।
Leave a Reply