যেখানে যাবেন সেখানেই এক আলোচনা। নির্বাচন কি হচ্ছে? কেন জানি অনেকেই ধরে নিয়েছেন নির্বাচন হচ্ছে না। তাদের যুক্তি দু’পক্ষের অনমনীয় মনোভাব। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ইদানীং কূটনৈতিক পাড়ায়ও এই ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু ব্যতিক্রমও আছে। এ মাসের গোড়ার দিকে এক ইফতার পার্টিতে একজন পশ্চিমা কূটনীতিক বললেন- নির্বাচন হবেই। ইচ্ছে করলে বাজি ধরতে পারেন।
পাশে বসা একজন উপমহাদেশীয় কূটনীতিককে জিজ্ঞেস করা হলে তার জবাব, নির্বাচন ছাড়া বিকল্প কি? এ থেকে আমরা কি বুঝলাম বা ধারণা করতে পারি। নির্বাচনকে সামনে রেখেই কূটনীতিকরা ছক আঁকছেন। নির্বাচনকালীন সরকার নিয়েই যত বিরোধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। তার মতে, অ-দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন মানে আবার জরুরি শাসন। এই লক্ষ্যে তিনি সংবিধান সংশোধন করেছেন সবার মত উপেক্ষা করে।
এখন তিনি বলছেন, অসাংবিধানিক সরকার আনার চেষ্টা চলছে। কারা করছে তা কিন্তু তিনি বলছেন না। বিরোধী দল বিএনপি বলেছে, অসাংবিধানিক সরকার তাদের কাম্য নয়। অসাংবিধানিক সরকার যাতে না আসতে পারে সে জন্য সংবিধানে শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান মেনে কি কেউ ক্ষমতা দখল করে কখনও? এক এগারোর সরকার অসাংবিধানিক হলে আওয়ামী লীগ ব্যবস্থা নিলো না কেন? নেয়ার কথাও নয়। কারণ ক্ষমতায় আসার আগে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা হয়েছিল।
এতে বলা হয়েছিল, এক এগারোর সরকারের পেছনে যারা ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। পরখ করে দেখুন কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বরং অন্যতম কুশীলব লেঃ জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী বহাল তবিয়তে অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। জেনারেল মইন নিউ ইয়র্কে অবস্থান করছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারীকে আগেই সরানো হয়েছিল। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে বেঁচে থাকার জন্য খাবার দোকানে চাকরি করছেন। মজায় আছেন জেনারেল আমিন। মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে চাকরিরত। এই চারজনই ছিলেন এক এগারোর মূল নায়ক। অন্য যারা ছিলেন সক্রিয় তাদের কিছুই হয়নি। এই যখন অবস্থা তখন অসাংবিধানিক সরকার নিয়ে এতটা শঙ্কা কেন?
আসলে কৌশলটা অন্যখানে। চাপের মধ্যে রেখে বেগম জিয়াকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনমুখী করা। বেগম জিয়া এতে টলছেন না। তার শক্তি দু’টো। এক. পাঁচটি সিটি করপোরেশনে নির্বাচনের ফল। দুই. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দেশী-বিদেশী জরিপ। সব জরিপই তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে।
খালেদা তাই বলছেন, নির্বাচন করতে হলে জনগণের টার্মেই আসতে হবে। তিনি নাকি এমনও বলছেন, প্রয়োজনে আরও পাঁচ বছর বাইরে থাকবেন। তার কথা, সেদিন অর্থাৎ ২০০৮-এর নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ সরকার বৈধতা পেতো কিভাবে? নেতিবাচক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন খালেদা। পাঁচ বছর বিরোধী দলে থাকাকালে তার কাছ থেকে আরও বলিষ্ঠ ও জোরালো নেতৃত্ব আশা করেছিল জাতি। এসব তো আছেই। তাই বলে কি কোন সমঝোতা হবে না? সোমবার ঢাকায় অবস্থানরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা বিরোধী নেত্রী বেগম জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন।
সেখানেও তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠু হলেও জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এর কোন নিশ্চয়তা নেই। তার যুক্তি, নির্বাচন কমিশন নিজেকেই বিতর্কিত করে ফেলেছে। আস্থা নষ্ট করেছে। তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের চিন্তা মাথায় রেখে কাজ করছে। তারা যে তল্পিবাহকের ভূমিকা পালন করছে এতে কোন সন্দেহ নেই। খালেদার ভয়, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলে বোতাম টিপে মিডিয়ার মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করা হবে। আস্থাহীনতার মধ্যেই রয়েছে গোটা বিষয়টি। সময় যত গড়াচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়াচ্ছে জনমনে। আমাদের প্রতিনিধিরা গ্রামে গিয়েছিলেন ঈদ করতে। তারা বললেন, গ্রামেও এই ধারণা জন্মেছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন দেবে না। মারামারি, কাটাকাটি হতে পারে দেশে। এই আশঙ্কা সব মহলেই। এই অবস্থায় একমাত্র পথ হচ্ছে সংলাপ। দুই দলের অবস্থানের মাঝামাঝি কোন সমাধান খুঁজে বের করা।
অনেকেই জোর দিয়ে বলেন, যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জিতবে না সে নির্বাচন দেবেন কেন শেখ হাসিনা? তারা কি সৎ পরামর্শ দিচ্ছেন? রাজনীতি থাকলে আওয়ামী লীগের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আজ না হোক কাল তো ক্ষমতায় আসবে। ভুলে গেলে চলবে না দীর্ঘ ২১ বছর সংগ্রাম করে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছিলেন। যারা বলছেন ভিন্ন পথে হাঁটার জন্য তাদের ভয় হচ্ছে ভবিষ্যৎ সরকার তাদের জন্য বৈরী হতে পারে। ভয়টা সেখানেই। গুটিকয়েক মানুষের জন্য আওয়ামী লীগ কেন নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনছে। এক সময় খালেদাও মনে করতেন তার সবই আছে। এক দুপুরে দেখা গেল কেউ নেই। ক্ষমতার মসনদে তার বিশ্বস্ত চারজন তাকেই শত্রুর তালিকায় নিয়ে কৌশল আঁটছেন।
সৌজন্য: মানবজমিন।
Leave a Reply