তিস্তা চুক্তির মতো ঝুলে গেল ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল।অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় অঙ্গরাজ্যের অধিকারের প্রশ্নে সোমবার ফের সরব হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর এই আপত্তির ফলেই এদিন রাজ্যসভায় পেশ হয়নি ভারত-বাংলাদেশ স্থলসীমান্ত চুক্তি সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল।
কারণ, বিজেপি ইতিমধ্যেই এই বিল নিয়ে বেঁকে বসেছে। তবে মন্ত্রণালয়ের একাংশের মতে, বিলটি অন্তত পেশ করা গেলেও বাংলাদেশকে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব হতো। দ্বিপাক্ষীয় কূটনীতির প্রশ্নে যা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু মমতার পাল্টা যুক্তি, নিজের রাজ্যকে বিপন্ন করে অন্য দেশকে খুশি করা তাঁর অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না।
বস্তুত, তিস্তা চুক্তির মতো এই চুক্তির ভবিষ্যতও অনিশ্চিত পথে পা বাড়ালো বলেই সংশ্লিষ্ট মহলের মত। খবর কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের অভিযোগ, তাদের না-জানিয়েই এদিন সংসদে স্থলসীমান্ত চুক্তি বিলটি পেশ করতে চাইছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। সে কথা জানতে পেরে মমতার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন রাজ্যসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়েন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বিলটি পেশের বিরোধিতা করার নির্দেশ দেন। মমতার নির্দেশমতো রাজসভার ওয়েলে নেমে বিল পেশ করার বিরোধিতা করেন ডেরেক, সুখেন্দুশেখর রায়েরা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেয় আসাম গণ পরিষদও।
এই প্রতিবাদের জেরে একাধিক বার চেষ্টা করেও বিলটি পেশ করতে পারেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সলমন খুরশিদ। মুলতুবি করে দিতে হয় অধিবেশনও। এর পর ফোনে মমতার সঙ্গে কথা বলেন খুরশিদ। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কেন্দ্র এক তরফা এমন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, যাতে রাজ্যের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হয়। বিলটি আনার আগে কেন্দ্রের উচিত ছিল রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিবাদ মেটাতে ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ইন্দিরা গান্ধী এবং শেখ মুজিবর রহমানের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সেই চুক্তিতে দু’দেশের মধ্যে জমি আদানপ্রদান করে সমস্যা মেটানোর কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু এত দিনেও সেই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। দীর্ঘ দিনের বকেয়া এই সমস্যা মেটাতেই সংবিধানের ১১৯তম সংশোধনী বিল আনতে চাইছিল কেন্দ্র। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতার বক্তব্য, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্তের বেশির ভাগটাই পশ্চিমবঙ্গে। স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হলে পশ্চিমবঙ্গই প্রভাবিত হবে সব চেয়ে বেশি।
পশ্চিমবঙ্গকে যতটা জমি দিতে হবে, ততটা জমি বাংলাদেশের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না। তা ছাড়া, বাড়তি জনসংখ্যার চাপও নিতে হবে রাজ্যকে। ফলে রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে এই বিল পেশ মেনে নেওয়া যায় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তৃণমূল সংসদীয় দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে বলেন মমতা। জানিয়ে দেন, তার পর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেওয়া হবে। বিল পেশে বাধা পাওয়ার পরে রাজ্যসভার তৃণমূল সংসদ সদস্যদের সঙ্গে অবশ্য কয়েক বার কথা বলেছিলেন খুরশিদ। ডেরেকরা তখন তাঁকে বলেছিলেন, ভারতীয় ভূখণ্ড অন্য দেশকে দিয়ে দেওয়ার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা না-করেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অভিপ্রেত নয়। তৃণমূলের পক্ষে সেটা মেনে নেওয়াও সম্ভব নয়। মমতা-খুরশিদ আলোচনার পর ঠিক হয়, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায় ও ডেরেক ও’ব্রায়েন তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। কবে, কখন এই বৈঠক হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যত দিন না আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছনো যাচ্ছে, তত দিন বিলটি সংসদে আনা হবে না।
ঘটনা হল, তিস্তা চুক্তি নিয়েও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের দীর্ঘ টানাপোড়েন চলেছে। মমতার আপত্তিতেই বাংলাদেশে গিয়েও এই চুক্তিতে সই করতে পারেননি প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন তিস্তা নিয়ে বৈঠক করেছেন মমতার সঙ্গে। কলকাতায় এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মণিও। কিন্তু বরফ গলেনি।
মমতার বক্তব্য, তিনি বাংলাদেশের বিরোধী নন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে রাজ্যের স্বার্থ দেখাটা তাঁর কর্তব্য। বাংলাদেশকে তিস্তার বাড়তি জল দিলে উত্তরবঙ্গের একটা বড় অংশের জনজীবন বিপন্ন হবে। কিন্তু বাংলাদেশে নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই তিস্তা এবং স্থলসীমান্ত চুক্তি নিয়ে দিল্লির উপরে চাপ বাড়াচ্ছে ঢাকা। চেষ্টা চালাচ্ছে সাউথ ব্লকও। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটাও জানে যে, সংবিধান সংশোধনী বিল পাশ করাতে হলে সংসদে যে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন, তা সম্ভবত পাওয়া যাবে না।
Leave a Reply