শীর্ষবিন্দু নিউজ ডেস্ক: আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, কফি আনান কমিশন ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের মংডু রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো পরিদর্শন করায় বর্মি সেনারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্যাতনের ধরন পাল্টিয়েছে।
এবার তারা শিক্ষিত লোকজনদের ধরে নিয়ে গুম করছে। সেখানে সম্পদশালী বাসিন্দাদের আটক করে মুক্তিপণ আদায় করছে। অন্যথায় অমানুষিক নির্যাতন করে জেলে পুরছে।
গতকাল মঙ্গলবার বুচিদং, নাইচ্ছাখালী ও ঢেকিবনিয়া থেকে সপরিবারে পালিয়ে এসে কুতুপালং বস্তিতে আশ্রয় নেয়া বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। গত রাতেই এ ১০টি পরিবারের ৫০ জন রোহিঙ্গা বাংলাশেরে শরণার্থী বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। আজ বুধবার জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্তের এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
তুপালং বস্তিতে স্বামীহারা তকলিমা ও তার শিশু সন্তান
মিয়ানমারের ঢেকিবনিয়া গ্রামের হুক্কাট্টা স্থানীয় ভাষায় চেয়ারম্যান দিলদার হোসেনের (৪৫) সাথে কথা হয় কুতুপালং নতুন বস্তির ঝুপড়িতে বসে। তিনি তার ছবি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, কোনো দিন যদি মিয়ানমারে ফেরত যেতে হয় ছবি প্রকাশের জেরে বর্মি সেনা পুলিশ তাকে মেরে ফেলবে। একজন চেয়ারম্যান ও সম্পদশালী লোক হওয়া সত্ত্বেও পৈশাচিক নির্যাতনের কবল থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য গভীর রাতে পালিয়ে এসে বস্তিতে আশ্রয় নিতে হয়েছে তার পরিবারকে।
তিনি জানান, ঢেকিবনিয়া এলাকায় তার প্রায় ৫০ একর চিংড়ির ঘের, কয়েক শ’ একর জমি, ধান, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কোটি কোটি টাকার ব্যবসাবাণিজ্য, দোতলাবিশিষ্ট বাগানবাড়িসহ কাঠের তৈরি বাড়িঘর ফেলে জীবন বাঁচাতে পরিবারপরিজন নিয়ে চোরের মতো পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত ঢেকিবনিয়া গ্রাম সীমান্তের এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও দেরিতে কেন এলেন জানতে চাওয়া হলে ওই হুক্কাট্টা (চেয়ারম্যান) বলেন, গত কয়েক দিন ধরে বর্মি সেনা পুলিশ ও রাখাইন যুবকেরা তার কাছ থেকে দফায় দফায় টাকা আদায় করছে। চিংড়িঘেরে লুটপাট চালিয়ে মাছ ধরে নিয়ে গেছে। গোয়ালঘর থেকে গরু, ছাগল, মহিষ লুটপাট করেছে। শত একর জমির ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে।
এরপরও তারা বাড়ির আনাচেকানাচে সার্বক্ষণিক অবস্থান করায় তার মনে সন্দেহের দানা বেঁধেছে। মনে হচ্ছিল তার বাড়িসহ সপরিবারে পুড়িয়ে মারার একটি পরিকল্পনা বর্মি সেনারা নিয়েছে। তাদের সোর্স হিসেবে থাকা আপনজনদের পরামর্শে রাতের আঁধারে ঢেকিবনিয়া খাল পার হয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি।
মিয়ানমার সরকার যদি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কোনো দিন সম্মত হয়, দেশের বাড়িতে ফিরবেন কি না জানতে চাওয়া হলে হুক্কাট্টা দিলদার হোসেন জানান, তার ওপরে মিয়ানমার প্রশাসনের নজরদারি রয়েছে। তাই ফিরে গেলেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে যেতে হবে।
তিনি বলেন, ৯ অক্টোবর মংডুর তিনটি সেনা ক্যাম্পে হামলার ঘটনায় সেখানকার সেনাসদস্য, বিজিপি ও রাখাইন যুবকেরা মংডুর বিভিন্ন স্থানে অগ্নিকাণ্ড, লুটপাটসহ নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও পৈশাচিক নির্যাতন চালালেও ঢেকিবনিয়া এলাকায় এর প্রভাব পড়েনি। গত সপ্তাহকাল ধরে বর্মি সেনারা তার ওপর নজরদারি বৃদ্ধি করে দফায় দফায় চাঁদাবাজি ও লুটপাট অব্যাহত রেখেছে।
মরিচ্যা বিল থেকে আসা তকলিমা খাতুন (২০) জানান, তার স্বামী ইসমাঈল (২৫) কিছু লেখাপড়া করেছে। তিনি ইংরেজিতে কথা বলতে পারেন। গত শনিবার রাতে বর্মি সেনারা বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কুতুপালং বস্তি ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আবু ছিদ্দিক জানান, বর্মি সেনা পুলিশ ও রাখাইন যুবকেরা নির্যাতনের ধরন পাল্টিয়ে শিক্ষিত যুবকদের অপহরণ করে গুম করছে আর বিত্তবানদের আটক করে মোটা অঙ্কের টাকা মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করছে। তবে তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদেশী মানবাধিকার সংস্থার সদস্যরা সরেজমিনে পরিদর্শনে এলে তাদের সাথে কেউ যাতে ইংরেজিতে কথা বলে নির্যাতনের প্রকৃত তথ্য বলতে না পারে সে জন্য শিক্ষিতদের তুলে নেয়া হচ্ছে।