শনিবার, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৫৪

ইমামদের সুখ-দুঃখ

আব্দুল আলীম: মাওলানা মো. নেসার উদ্দিন। পটুয়াখালীর গলাচিপা থানার আওলিয়াপুর গ্রামে জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। এখন মুন্সীগঞ্জ সদরের মহাখালী ফকিরবাড়ী জামে মসজিদের ইমাম তিনি।

৫ বছর আগে মাত্র ২ হাজার টাকা বেতনে ইমামতি পেশা শুরু করেন। ২০১৭ সালে এসে এখন বেতন মাত্র সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এই সামান্য বেতনেই চলে দুই ছেলেমেয়েসহ ৪ জনের পরিবার। থাকেন মসজিদের পাশেই ইমামের নির্ধারিত কক্ষে। খান মহল্লাবাসী মুসল্লিদের পাঠানো খাবার। সামান্য বেতন হওয়ায় প্রতি মাসে গ্রামের বাড়িতে পরিবারের কাছেও যেতে পারেন না।

তিনি বলেন, মুন্সীগঞ্জ থেকে পটুয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে-আসতে অন্তত ২ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। তাই ২/৩ মাস পরে একবার বাড়িতে যাই। গ্রামে কিছু জমি আছে যা বর্গা দিয়ে রাখা আছে। সব মিলিয়ে ফসল এবং নিজের সামান্য বেতন দিয়ে সংসার চলে। ছাত্র জীবনে পড়ালেখা করেছেন পটুয়াখালী ওয়াজিয়া কামিল মাদরাসায়।

১৯৯৭-৯৮ সালে কামিল পাস করলেও সে সার্টিফিকেট দিয়ে তেমন কিছু করতে পারেননি। পরে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নতুন কারিকুলামে আবার ফাজিল পাস করেছেন ২০১৫ সালে। তবে ইচ্ছা থাকলেও এখনো ইমামতি ছেড়ে অন্য কোনো পেশায় যেতে পারেননি তিনি। সীমাহীন অর্থকষ্টে দিন চলে তার। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক এই ইমাম নিজে আগাগোড়া মাদরাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষাও দিচ্ছেন। একমাত্র মেয়ে গ্রামের বাড়িতে কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। ছেলে পড়ে হেফজখানায়।

তিনি বলেন, সরকারের কাছে একটাই চাওয়া, অন্যান্য চাকরিতে যেমন সরকার বেতন দেয় তেমনি ইমামদেরও সরকারি বেতনের আওতায় আনা হোক। মাওলানা মো. রফিকুল ইসলাম। শেরপুরের নকলা থানার গড়েরগাঁও জামে মসজিদের ইমাম। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরীপুর থানার উকুয়াকান্দা গ্রামে। জেলার ফুলপুর আশরাফুল উলুম বালিয়া (কওমি) মাদরাসা থেকে ১৯৯৩ সালে দাওরা হাদিস পাস করেছেন। ৫ বছর আগে মাত্র ৩ হাজার টাকা বেতনে ইমামতি পেশায় যোগ দেন। এখন বেতন ৬০০০ টাকা। এই সামান্য বেতন দিয়েই চালাতে হয় ১ ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে ৫ জনের সংসার। সন্তানদের মধ্যে ছেলের বয়স ১৬ বছর। মেয়ে দুইজন ছোট।

তিনি বলেন, ইমামতির পাশাপাশি তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে বিভিন্ন মসজিদে মক্তব পড়াতে দেয়া হয়। কিন্তু কোনো জামে মসজিদের ইমামের জন্য মক্তব পড়ানোটা অবমাননাকর। কারণ মক্তব সব এলাকাতেই মুয়াজ্জিনরা পড়ায়। এছাড়া, প্রতি সপ্তাহে দুই একটা দাওয়াত থাকে। সেটাকে কোনো পেশাদারি আয় বলা যায় না। কেউ দাওয়াত করে দোয়া অনুষ্ঠান শেষে কোনো বকশিশ না দিলেও কোনো ইমামের বলার কিছু থাকে না। বকশিশ নেয়াও একটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার।

মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার সুরুদিয়া জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা মো. শহীদুল্লাহ। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার ঘোড়াঘাট গ্রামে জন্ম। ছাত্র জীবনে পড়ালেখা করেন জেলার আন্দারমানিক দাখিল মাদরাসায়। দাখিল পাসের পাশাপাশি তিনি কারিয়ানাও পাস করেছেন। ২৪ বছর আগে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর থানার হারিয়ানা মুন্সী সিকদারবাড়ী জামে মসজিদে মাত্র ৭০০ টাকা বেতনে ইমামতি শুরু করেন। এলাকার তিনটি মসজিদে বিভিন্ন মেয়াদে চাকরি করে ১১ বছর আগে সুরুদিয়া জামে মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। এখন বেতন ৯ হাজার টাকা। মহল্লাবাসীর পাঠানো খাবার খান এবং মসজিদের পাশে ইমামের জন্য নির্ধারিত রুমে ঘুমান। মহল্লাবাসী থেকে চাঁদা তুলে মসজিদ কমিটি বেতন দেন ইমামের। সেই বেতনেই চলে তার সংসার। দাম্পত্য জীবনে তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক। বড় মেয়ে কওমি মাদরাসা থেকে মেশকাত শরীফ ও মেজো মেয়েকে দাওরা হাদিস পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন।

এমনই আরেকজন মুফতি মহিউদ্দিন আহমেদ। গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া থানার চরবগুলা গ্রামে। চট্টগ্রামের জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া মাদরাসা থেকে মুফতি পাস করেছেন তিনি। এখন ঢাকা মানিকদি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম। একই সঙ্গে তিনি মসজিদ সংলগ্ন উচ্চমাধ্যমিক কওমি মাদরাসার প্রিন্সিপাল। ২০১১ সালে ১১ হাজার টাকা বেতনে চাকরি জীবন শুরু করেন।

এখন বেতন ২০ হাজার টাকা। ২০১১ সালে বিয়ে করে এখন ২ মেয়ের বাবা তিনি। বাড়তি সুযোগ-সুবিধার মধ্যে মসজিদ ও মাদরাসার সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকার জন্য কোয়ার্টার সুবিধা দেয় কর্তৃপক্ষ। একই কমিটির দ্বারা মসজিদ ও মাদরাসা পরিচালিত হওয়ায় আলাদা কোনো বেতন পান না। সব মিলিয়ে সারা দেশের ইমামদের তুলনায় যথেষ্ট সুখেই আছেন তিনি।

তিনি বলেন, একজন ইমাম তার মুসল্লিদেরকে শুধু মুখের কথা দিয়েই স্থিতিশীল রাখতে পারেন। যেটা আইন প্রয়োগ করেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পারে না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক ইমামকে যথাযথ মূল্যায়ন করা উচিত। একটি ওয়ার্ডের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামকে কাউন্সিলরের মর্যাদা দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন। একইভাবে থানার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমামকেও থানা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধির মর্যাদা দেয়ার পাশাপাশি সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়ার দাবি জানান তিনি।

মাওলানা মো. আমিনুল ইসলাম। টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর থানার ধুবলিয়া গ্রামে বসবাস। ইমামের চাকরি করেন পাশের গ্রাম ঘাটাইল থানার পাঁচকড়ি হাটখোলা গ্রামের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে। ১৬ বছর ইমামতি করেও এখন বেতন মাত্র ৩ হাজার টাকা। মসজিদ কমিটি মুসল্লিদের থেকে ১০/২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকা করে উঠিয়ে বেতন দেন ইমামের। সামান্য ৩ হাজার টাকা বেতন হলেও কোনো কোনো মাসে বাকি থাকে তার আংশিক। কখনও ৪ মাসের বেতনও বাকি পড়ে যায়। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ২০০২ সালে মাত্র ৬০০ টাকা বেতনে ইমামতির চাকরি শুরু করি রায়ের বাসালিয়া জামে মসজিদে।

পরে কুঠিবয়রা পূর্বপাড়া জামে মসজিদেও ইমামতি করেছি। বেতন একটু বেশি হওয়ায় এখন হাটখোলা মসজিদে ইমামতি করি। ইমামতির পাশাপাশি এলাকায় প্রাইভেট পড়িয়ে কিছু টাকা আয় হয়। তা দিয়ে সংসার চালাতে হয়। তিনি বলেন, ২০০৫ সালে বিয়ে করে এখন দুই মেয়ে ও এক ছেলের বাবা। বড় মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

মাওলানা মো. মিজানুর রহমান। ঢাকা জেলার ধামরাই থানার আটিমাইথান কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ইমাম। বাড়ি একই থানার শ্রীরামপুর গ্রামে। রাজধানীর মিরপুর দারুল উলুম কওমি মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস পাস করে ধামরাইয়ের কালামপুর জামে মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। তখন বেতন ছিল মাত্র ২৩০০ টাকা। ৯ বছর ধরে ইমামতি করে এখন বেতন পান সাড়ে ৪ হাজার টাকা। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা তিনি। বড় ছেলের বয়স ৮ বছর। মেয়ের বয়স মাত্র আড়াই বছর।

মাওলানা মো. নবী ইসলাম ইমামতি করেন গাজীপুরের চন্দনা চৌরাস্তা এলাকার বার বৈকার পূর্বপাড়া জামে মসজিদে। বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানার ফুলের নাউড়ি গ্রামে। ২০১২ সালে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিল পাস করে শুরু করেন ইমামতির চাকরি। মাত্র ৫ হাজার টাকা বেতন হলেও মসজিদের সঙ্গে ইমামের জন্য থাকার কোনো জায়গা নেই। খাবারও খেতে হয় নিজের টাকায়। মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় ব্যাচেলর হিসেবে ভাড়া থাকেন তিনি। গত বছরের জুলাই মাসে বিয়েও করেছেন। কিন্তু বেতন কম হওয়ায় স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকাও সম্ভব হচ্ছে না তার।

এছাড়া, মাওলানা মো. মিজানুর রহমান জামাল ইমামতি করেন গাজীপুরের জয়দেবপুরের দক্ষিণ কাইলপুর মোস্তফা জামে মসজিদে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার কালিসিঁড়ি গ্রামে জন্ম। সিলেটের বার্তখলা জামিয়া মুরিয়া ইসলামিয়া কওমি মাদরাসা থেকে দাওরা হাদিস পাস করেছেন তিনি। পাশাপাশি ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে কামিলও পাস করেন ভালো চাকরির আশায়। তবে তেমন কোনো চাকরি না পেয়ে ১ বছর আগে ইমামতির চাকরিতে যোগ দেন গাজীপুরে। মসজিদ কর্তৃপক্ষ বেতন ধরেন ৮ হাজার টাকা। প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে মসজিদ জাতীয়করণের দাবি জানান তিনি।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির ২০০৯-১০ অর্থবছরে চালানো জরিপ অনুযায়ী সারা দেশে জামে মসজিদের সংখ্যা ২ লাখ ৫০ হাজার ৩৯৯টি। ধারণা করা হচ্ছে পরের ৭ বছরে জামে মসজিদের সংখ্যা সাড়ে ৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আর এসব মসজিদের প্রত্যেকটিতে একজন করে ইমাম রয়েছে। কোনো কোনো মসজিদে একাধিক ইমামও (সানি ইমাম) রয়েছে। এই হিসাবে সারা দেশে ৩ লাখেরও বেশি ইমাম রয়েছেন।




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024