সামপ্রতিক কালের কিছু পাল্টাপাল্টি ঘোষণা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে ফেলছে বলে অনেকের ধারণা। বিশেষ করে সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাব্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছে সচেতন মহল। তবে এর বিকল্পই বা কী? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে চলমান রাখতে হলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও পক্ষপাতহীন নির্বাচন হতেই হবে। আবার আশাবাদীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাঁদের ধারণা, দুই পক্ষ শেষতক একটি সমাধানে এসে যাবে। নির্বাচনের জন্য তারা জাতির সামনে তুলে ধরবে ইশতেহার। আর সে ইশতেহারই আজকের নিবন্ধটির মূল আলোচ্য বিষয়।
এটা সবার জানা, ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটি যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে, তার মনোহারী শিরোনাম ছিল ‘দিনবদলের সনদ’। আর সনদটি সত্যি সত্যিই জনগণের মন হরণ করেছিল। তারা জয়লাভ করেছিল জাতীয় সংসদের শতকরা ৮০ ভাগ আসনে। আগামী নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি নিয়ে বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে প্রধান দুটি পক্ষের মধ্যে। তা সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশগ্রহণের জোরালো পদক্ষেপ লক্ষ করা যাচ্ছে। এবার প্রধান বিরোধী দল যথারীতি একটি নির্বাচনী ইশতেহার তৈরি করছে বলে জানা গেল। সমপ্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিরোধী দলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তাঁকে এর সারসংক্ষেপ অবগত করানো হয় মর্মে খবরের কাগজে দেখা গেল। এর শিরোনাম হতে পারে রাষ্ট্র পরিচালনার ‘রূপকল্প’। ক্ষমতাসীন দলেরও একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করার কথা। দেখা যাক ইশতেহারগুলো দেখে ভোটাররা কী সিদ্ধান্ত নেন।
এখন দেখা যাক, দিনবদলের সনদের প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা রক্ষা করা হয়েছে। এ ইশতেহারটিতে বহু দফা উপদফা রয়েছে। তবে জোর দেওয়া হয়েছিল দারিদ্র্য দূরীকরণ, বৈষম্যের অবসান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতি দমন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যার সমাধান আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর। রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও সহনশীলতা প্রতিষ্ঠাও একটি মৌলিক অঙ্গীকার ছিল। সরকারের মেয়াদান্তে এগুলোর বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করবে ভোটদাতা জনগণ। বলতে হয় বিদ্যুৎ সমস্যাটি অন্তত সাময়িকভাবে এবং বিতর্কিত পদ্ধতিতে হলেও সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণের সাফল্য এ সরকারের একক কৃতিত্ব নয়। এটা ধারাবাহিক একটি বিষয়। তবে ১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের পথে নতুন যাত্রা করার পর মাঝখানের দুই বছরের বিরতি ছাড়া প্রধান দুটো দলই দেশ শাসন করছে। এ সময়কালে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের সফলতা অসাধারণই বলা চলে। এ বিষয়ে অবদান রয়েছে এ সময়কালের সব সরকারের। তবে ভ্রান্ত করনীতির ফলে আয় বৈষম্য না কমে বরং বেড়েই চলছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
তারপর আসে দুর্নীতি দমন ও সুশাসন প্রসঙ্গ। এর আগের সরকার এ বিষয়ে শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল বলেই ২০০৮-এ মহাজোটের মহাবিজয় হয়েছিল। এ দুটো ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। বরং দুর্নীতি, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি চলমানই রয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু প্রকল্পের বৈদেশিক সহায়তা হাতছাড়া হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যত খুঁড়িয়েই চলছে। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের দাপটে বিপন্ন। নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নে প্রতিশ্রুতি অনুসারে মেধাকে প্রধান নিয়ামক করা হয়নি। বরং উল্টো পথেই চলা অব্যাহত রয়েছে। জঙ্গিবাদ দমনে সরকারের সাফল্য আছে। সাফল্য আছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে। কিন্তু কূটনৈতিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান দুর্বলতার জন্য সে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি থেকে আমাদের ন্যায়সংগত সুবিধাগুলো আদায় করে নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
এটাও বিবেচনার বিষয় যে বিএনপি তাদের রাষ্ট্র পরিচালনার রূপকল্পে জনগণের সামনে কী তুলে ধরছে? সারসংক্ষেপ যেটুকু এসেছে তাতে দেখা যায়, তারা ভারতের সঙ্গে বিবদমান সমস্যাগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে গুরুত্ব দেবে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ দমন আর দুর্নীতি বন্ধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথাও এতে রয়েছে। তবে যাদের সমন্বয়ে তাদের জোটটি গঠিত, তাদের নিয়ে এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব, এ বিষয়ে অনেকে সংশয়বাদী। ভারতের সঙ্গে সমস্যাগুলোর সমাধানে তারা কতুটুকু সক্ষম হবে, এ বিষয়ে অনেকেই সন্দিহান। আর এ সন্দেহের যৌক্তিক কারণও আছে। তাদের আগের সরকারের সময়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী কিছু গোষ্ঠী আমাদের ভূখণ্ডকে ব্যবহার করত সরকারি সহায়তায়। এ দেশটির ওপর দিয়ে তারা অস্ত্রশস্ত্রও আমদানি করত। এ অভিজ্ঞতার পর ভারত দলটি বা তার নেতাদের ওপর কতটা আস্থাশীল হবে, এ বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়।
তারপর আসছে দুর্নীতি আর সুশাসনের কথা। এটা ঠিক, মানুষের স্মৃতিশক্তি সীমিত। তা সত্ত্বেও এটা এত সীমিত নয় যে এখনই ২০০১-২০০৬ মেয়াদের সরকারের দিনগুলোর কথা তারা ভুলে যাবে। একটি বিকল্প ক্ষমতাবলয় সৃষ্টি আর ব্যাপক দুর্নীতির ঘটনাগুলো মানুষের স্মৃতিতে এখনো রয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দলীয়করণেও তারা সক্রিয় ছিল। নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়নের ভিত্তিতে মেধা ও যোগ্যতাকে অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষা করা হয়েছে। আর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য তারা এখন আন্দোলন করে চলছে, তার ভিত্তিমূলে বড় রকমের আঘাত তারাই করেছিল। তা করেছিল প্রথমে একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বয়সসীমা বাড়িয়ে। আর পরে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করে। এত কিছুর পরও ভোটাররা আবার তাঁদের বেছে নিতে চাইছেন বলে প্রাথমিক ইঙ্গিত আসছে। অন্তত পর পর কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল তা-ই বলে। হয়তো বা এখন যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা প্রতিশ্রুতি রাখেননি, ব্যর্থ হয়েছেন জনগণের প্রত্যাশা পূরণে। এ জন্য ভোটাররা একটি পরিবর্তন চাইতেও পারেন।
অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের আশঙ্কা; পরিবর্তন ঘটুক আর না-ই ঘটুক, দুর্নীতি দমন আর সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর কিছু করা হবে না। যেমনি চলছে সেভাবেই চলবে। আরেকটি মৌলিক বিষয় এ নিবন্ধে আলোচনার দাবি রাখে। আওয়ামী লীগ ‘দিনবদলের সনদে’ রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও সহনশীলতা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখলাম ও দেখে চলছি তার উল্টো চিত্র। বিএনপি তাদের ‘রূপকল্পে’ও হয়তো বা অনুরূপ কথা বলবে। কিন্তু করবে কি? তাদের অতীত এমনকি বর্তমান তো এমনটা বলে না। আমরা দেখি রাজনীতিতে সবচেয়ে কদর্য কাদা-ছোড়াছুড়ি হয় দল দুটোর প্রয়াত নেতাদের নিয়ে। এটা শিষ্টাচারের চরম ব্যত্যয়। ১৫ আগস্ট জাতির জন্য গভীর শোকাবহ একটি দিন। সেদিনটি জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু এই দেশটির সৃষ্টিতে তাঁর ভূমিকাকে গৌণ করার চেষ্টা অগ্রহণযোগ্য। আর তাঁর পাশে একই কাতারে অন্য কাউকে স্থান দেওয়ারও সুযোগ নেই। সেই শোকাবহ দিনটিতেই বিরোধী দলের নেতা ১৯৯২ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন হিসেবে উদ্যাপন করছেন। অথচ তাঁর জন্মদিনসংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য তথ্যাদি ভিন্ন। আর এজাতীয় কাজ না করে জাতির জনককে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দিলে বিএনপির কোনো ক্ষতি হবে না। বরং ভুল পথ থেকে সরে আসার জন্য তারা নন্দিত হতে পারে।
অপর দিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গে তাঁর বিরোধীরা কেউ তাঁকে একজন অখ্যাত মেজর আর কেউ বা মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মবেশে পাকিস্তানি অনুচর বলেও আখ্যায়িত করে। ব্যাপারটি কি তা-ই? বঙ্গবন্ধু তাঁকে বীর উত্তম খেতাব দিয়েছিলেন। নিযুক্ত করেছিলেন ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ হিসেবে। এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া হলে বঙ্গবন্ধুর বিবেচনা বোধের ওপরই প্রশ্ন আসে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬ মার্চ ১৯৭১ দুপুর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হতে থাকে। স্থানীয় নেতাদের অনুরোধে পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধরত তদানীন্তন মেজর জিয়া ২৭ মার্চ এ ঘোষণাটি আবার পড়েন। এখানে তাঁকে কেউ কেউ শুধু একজন পাঠক হিসেবে আখ্যায়িত করতে চান। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। তখনকার মেজর জিয়ার এ ঘোষণা পাঠ মুক্তিযুদ্ধকে নুতন মাত্রা দিয়েছিল। তিনজন প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধার কথোপকথন নিয়ে রচিত একটি বই মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর। সে তিনজনের একজন মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান সেনাপতি আর এখনকার পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকার।
তাহলে মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের বড় ভূমিকাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তারপর আসে তাঁর রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ প্রসঙ্গ। স্বীকার করি, প্রক্রিয়াটি আইনসিদ্ধ ছিল না। তবে তিনি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন, তা অন্তত তাঁর মৃত্যুর পর জানাজাকালে দৃশ্যমান হয়। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়েও সমালোচনা করার অনেক কিছু আছে। তাঁর দলটি ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নিলেও সেখান থেকে দ্রুতই সাধারণ মানুষের মধ্যে চলে গিয়েছিল। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তাঁর দল জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তাই তাঁকে কথায় কথায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের পরিপন্থী নয় কি?
বাঙালিত্ব নিয়ে আমাদের গর্ব প্রচুর। তবে গ্লানিও কম নয়। কারও যশ ও প্রতিষ্ঠার পেছনে আমরা লেগেই থাকি। এ বিষয়ে প্রয়াত লেখক নীরদ চৌধুরীর একটি উক্তি উল্লেখ করার মতো। অবশ্য বলে নিতে হয়, তিনি যা লিখেছেন তা বাঙালি পাঠক নির্দ্বিধায় মেনে নেয়নি। তবে তাঁকে উপেক্ষাও করা যায়নি। আমার দেবোত্তর সম্পত্তি বইটিতে তিনি লিখেছেন; ‘একদল বাঙালীর নিন্দায় চৈতন্যদেব হইতে সুভাষচন্দ্র পর্যন্ত সকলের অনিষ্ট হইয়াছে, বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তান রবীন্দ্রনাথের জীবন বিষময় হইয়াছে, বাঙালী জাতির কলঙ্ক হইয়াছে। সুতরাং বাঙালী জাতির দিক হইতে এই হিংস্র নিন্দাপরায়ণতাকে উপেক্ষা করা যায় না।’
তেমনি আমাদের বাংলাদেশেও একদল বাঙালি জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেছে। তাদের অনুসারী কেউ কেউ এখনো তাঁকে কত নিচে নামানো যায়, সেই চেষ্টায়ই থাকে। আবার এ দেশটিতে যে দু-একজন লোক যশ ও খ্যাতিতে বিশ্বের নজর কেড়েছেন, তাঁদেরও হেয় করার আগ্রাসী চেষ্টা আমরা অসহায়ভাবে দেখছি। অবশ্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীই চায় এ অক্ষমতা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটুক। তাতে আমাদের রাজনীতিতে শিষ্টাচার ও সহনশীলতা আসবে, দেশ দুর্নীতিমুক্ত হবে এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠাও নির্বাচনী ইশতেহারের মায়াবী ফানুস হয়ে থাকবে না।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব। majumder234@yahoo.com
Leave a Reply