আনিসুল কবীর খোকন: ব্যাংকক শহরকে আমার ঢাকার থেকে আহামরি খুব ভালো কিছু মনে হয়না। বিশেষত সুকুম্ববির যে জায়গাতে আমরা বাংলাদেশিরা বেড়াতে গেলে উঠি, সেই জায়গাটা ঢাকার বনানী-গুলশানের তুলনায় নিতান্তই অনুন্নত মনে হয় আমার।
তবে জায়গাটা বাংলাদেশ থেকে যে অনেক দিক দিয়ে অন্যরকম, সেটা যারা গেছেন, তারা বুঝবেন।
ব্যাংককে যে জিনিস দেখলে আমার মন খুব খারাপ হয়, সেটা হচ্ছে ওদের নদী, চা প্রায়া রিভার। ছোট্ট একটা নদী। আমাদের বুড়িগঙ্গার চেয়ে ঢেড় ছোট। বুড়িগঙ্গা বুড়ি হলে, চা প্রায়া নিতান্তই কিশোরী।
জানিনা, আমার বোঝার ভুল হতে পারে। তবে নদী যদি দেখতেই হয়- সেক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর মানুষের উচিৎ বাংলাদেশে এসে নদী কত প্রকার ও কি কি, সেটা দেখুক।
রিভার সিটি
দুঃখের বিষয় নদী মাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোকে ফোকাস করে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার কোন শক্তিশালী প্রচেষ্টা আমার চোখে পড়েনি। পর্যটন কর্পোরেশন নাকি পর্যটন ব্যুরো একটা চমৎকার ভিডিও তৈরি করেছিলো বছর দুয়েক আগে নদী ভিত্তিক পর্যটনকে কেন্দ্র করে। তবে ওই পর্যন্তই দৌড়। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অবকাঠামো গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টা এখনও চোখে পড়ছেনা।
প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা দুরে চলে গেলাম বোধহয়। যেটা বলছিলাম, ব্যাংককে গেলে ওদের ছোট্ট নদী চা প্রায়াকে ঘিরে ওদের কর্ম চাঞ্চল্য, উদ্দীপনা অথবা ব্যবসায়িক পরিমণ্ডল দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়। যে কাজ করা উচিৎ ছিলো আমাদের সেটা করছে ব্যাংককবাসী। চা প্রায়া নদীকে কেন্দ্র করে প্রচুর রিভার ক্রুজ পরিচালিত হয়।
এছাড়াও নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে অনেক পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল আর রেস্তোরাঁ। রাতের বেলা নদী পাড়ের স্থাপনাগুলো আলোকসজ্জায় সেজে উঠে। ওই একটু আলোকসজ্জায়ই রিভার ক্রুজে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য নদী পাড়ের ব্যাংকক যেন অপরূপা রূপ ধারণ করে।
বিগত বছরে, ৩ মাসের ব্যবধানে দু’বার ব্যাংককে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। দু’বারই চা প্রায়া নদীতে ডাইনিং ক্রুজে যোগ দেই । প্রথমবার ব্যাংকক গিয়েছিলাম ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে। আমাদের সঙ্গে ২০-২৫ জনের বিশাল দল। অফিসিয়াল ট্যুর। ব্যাংককের ১১ নম্বর (সয় ইলেভেন) সুকুম্বি এলাকার এম্বাসেডর হোটেলে উঠেছিলাম।
জাহাজের চা প্রায়া প্রিন্সে আমরা
ব্যাংককের অ্যাম্বাসেডর হোটেল বাংলাদেশের পর্যটকদের চারণভূমি বলা যায়। আশপাশের বিভিন্ন হোটেলেও বাংলাদেশিদের অবস্থান করতে দেখা যায়। খুব কাছেই বামরুনগ্রাদ হসপিটাল, যেখানে প্রচুর বাংলাদেশির আগমণ হয় চিকিৎসা সেবা আর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য। এই এলাকায় তাই অনেক বাংলাদেশি অবস্থান করে।
বাংলাদেশি পর্যটকদের আধিক্যের কারণে এখানে বেশকিছু বাংলাদেশি দোকান ও খাবার হোটেল (রেস্তোরাঁ) গড়ে উঠেছে। বাঙালিদের দোকানগুলো মজার। এসব দোকানে মোবাইলের সিম, জামা কাপড় থেকে শুরু করে ডলার কেনা-বেচা, প্লেনের টিকিটসহ অনেক কিছুই পাওয়া যায়।
তবে এসব দোকানের সবার সাইড ব্যবসা হচ্ছে ট্যুর প্যাকেজের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা। আরেকটা মজার ব্যাপার না বললেই না, এখানে অনেক ভারতীয় দোকানদার বাংলায় সাইনবোর্ড দিয়ে বাংলাদেশিদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করে। তবে কথা বলার পর তার জাতীয়তার ধরণ বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয়না।
এবার রিভার ক্রুজ বা ডাইনিং ক্রুজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সবাইকে ওয়াকিবহাল করি। যেহেতু ব্যাংকক পর্যটন নগরী। নগরের সব জায়গায় সবচেয়ে বড় ব্যবসা ট্যুরিজম বা পর্যটন। দোকানে দোকানে, রাস্তা-ঘাটে, বড় বড় হোটেলে বিক্রি হচ্ছে নানা প্রকার ভ্রমণ প্যাকেজ। এসব প্যাকেজের মধ্যে ২-৩ ঘণ্টার ডাইনিং ক্রুজের নাম খুব সহজেই পাওয়া যায়।
প্যাকেজগুলোতে অনেক অনেক জাহাজের মেলা যেন। তবে আমরা যেহেতু বাংলাদেশ থেকে এসেছি তাই ভারতীয় ও বাংলাদেশি খাবার এবং গান বাজনা যে জাহাজে পাওয়া যায় সেটার প্যাকেজ টিকেট কাটা হলো। জাহাজের নাম চা প্রায়া প্রিন্স দাম নিলো ১ হাজার ৫০ থাই বাথ (থাইল্যান্ডি মুদ্রা)।
এই টাকার ভিতরেই সব পাওয়া যাবে। জাহাজ ছাড়বে সন্ধ্যা ৭টায়। হোটেলে প্যাকেজের গাড়ি থাকবে সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা কি ছয়টায়, সময়টা ভুলে গেছি। যেখান থেকে জাহাজ ছাড়ে সেই জায়গাটির নাম রিভার সিটি। বিশাল হুলুস্থূল ব্যাপার। রিভার সিটি আদতে একটা শপিং সেন্টার। সাথে জাহাজ ঘাট এবং বেশ কিছু রেস্তোরাঁ।
টাইটানিক পোজে উৎফুল্ল পর্যটক
আমরা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার মধ্যে রিভার সিটিতে পৌঁছে যাই ডাইনিং ক্রুজের প্যাকেজের ঠিক করা গাড়িতে। গাড়ির ড্রাইভারই মূলত গাইডের কাজ করে। রিভার সিটির পার্কিংয়ে গাড়ি পার্ক করে আমাদের মার্কেটের এক তালায় নিয়ে আসে সে। আমাদের সাথে বিভিন্ন দেশের আরও অনেক পর্যটক ছিলো। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছিলো যে বেশিরভাগ পর্যটকই বাংলাদেশ আর ভারত থেকে গিয়েছে।
উপমহাদেশের মানুষ মুলত বুকিংয়ের সময় চা প্রায়া প্রিন্স জাহাজের টিকেট কাটে। দল বেঁধে অপেক্ষার অবসান ঘটলো থাই ঐতিহৃবাহী পোষাকে সজ্জিত দুই তরুণীর আবির্ভাবে।
চা প্রায়া প্রিন্সের যাত্রীদের বিশেষ রঙের স্টিকার আর ফুলের ব্যাজ পরিয়ে দিলো তরুণী দুজন। তারপর আবার ড্রাইভার কাম ট্যুর গাইডের পিছে পিছে মার্কেটের পেছন দরজা দিয়ে নদী পাড়ে। রিভার সিটির বিল্ডিংটা বেশ সুন্দর। নদীর পাড়ে শত শত মানুষ, গিজ গিজ করছে যেন, তবে বিশৃঙ্খলা নেই।
একের পর এক আলোকমালা সজ্জিত জাহাজ ভিড়ছে ঘাটে আর ওইসব জাহাজের যাত্রীরা তাদের স্টিকার আর ফুল দেখিয়ে ঢুকে যাচ্ছিলো জাহাজের ভিতরে। নদী পাড়ে যেন উৎসব চলছে। নদীর যত দূর পর্যন্ত চোখ যায়, শুধু বিলাশবহুল হোটেল, আলোকমালায় সজ্জিত প্যাগোডা বা পুরাতন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা চোখে পড়ছিল, যেগুলো অতি যত্নসহকারে আলো দিয়ে ঝলমলে করে রাখা হয়েছে।
পুরো ব্যাপারটিতেই একটা জাতীয় পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়। ছোট একটা নদীকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার ট্যুরিস্টকে আনন্দ বিতরণ করে যাচ্ছে ব্যাংকক নগর। বিপরীতে তারা আয় করছে কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা। হাসিমুখে এখানে এসে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে যাচ্ছে নানা দেশের নানা জাতের মানুষ।
রিভার সিটির নদী পাড়ে ব্যাপক ভীড়ের মধ্যেই ঘুরাঘুরি করে ছবি তুলে আর কফি খেতে খেতে আমাদের চা প্রায়া প্রিন্স জাহাজের আগমন হলো। পুরোটাই আলো দিয়ে ঘেরা জাহাজ। জাহাজ ঘাটে ভেরার পরে জাহাজের ক্রুরা গানের তালে তালে খুব সুন্দর করে যাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে নাচ প্রদর্শন করে। যেটা খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে। জাহাজের ক্রুদের আগমনী নাচ-গান শেষ হলে গেট খুলে দেয়া হয়।
আমাদের বসার জায়গা আপার ডেক বা উপরের ডেকে ছিলো। টিকেটের রঙ দেখে আমাদের উপরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়া হয়। জাহাজের উপরে উঠতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। একদম মাঝখানে ওভাল আকারে বুফ্যে খাবারের ব্যবস্থা। পুরো ডেকে ৮ টা চেয়ারের মাঝে একটা করে বড় টেবিল, এমন ভাবে অনেক টেবিল দেয়া ছিলো।
আমরা একটা টেবিল দখল করে বসে পড়লাম। বসতে না বসতেই বেয়ারা এসে সবার জন্য সুস্বাদু পানীয়, বাদাম আর চিপস্ দিয়ে যায়। বাদাম চিপস্ খেতে খেতেই দেখি ভারতীয় যাত্রীরা সব ডিনারের প্লেট নিয়ে ব্যুফে খাবার নেয়া শুরু করে দিয়েছে।
আমরাও লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার নিয়ে নেই। বেশির ভাগই ভারতীয় খাবার। বিরানী-কাবাব পেটপুরে খেতে খেতে নদী পাড়ের অদ্ভূত সুন্দর আলোকমালা দেখতে ভালোই লাগে। ব্যাংককের বিখ্যাত স্থাপনাগুলোর অনেকগুলোই চা প্রায়া নদীর পাশে অবস্থিত। বিখ্যাত গ্রান্ড প্যালেসকে দিনের বেলার চেয়েও অনেক সুন্দর দেখতে লাগলো।
ডাইনিং ক্রুজের বড় বড় জাহাজ ছাড়াও ছোট ছোট টিক বোট বা সেগুন কাঠের নৌকাতেও সুন্দর করে আলো সাজিয়ে রিভার ক্রুজ পরিচালনা করা হয়। মাত্র দুই ঘণ্টার নদী ভ্রমণ কিন্তু আনন্দের কোনো ঘাটতি রাখে নাই জাহাজ কতৃপক্ষ। প্রথম থেকেই একজন ডিজে জাহাজের ডেকে বিভিন্ন রকম মজাদার কথাবার্তার ধারাবাহিকতায় হিন্দি গান বাজিয়ে চলছিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে দু’একজন অতি উৎসাহী তরুণ নাচানাচি শুরু করলো।
দিনের দেখা সাধারণ থাই ভবনগুলোও আলোকসজ্জার কারসাজিতে হয়ে ওঠে অপরূপ
আমরা ডেকের কিনারে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তুলতে হালকা কৌতুকময় দৃষ্টিতে অতি উৎসাহী তরুণদের দেখতে না দেখতেই দেখি ফিডব্যাকের মেলায় যাইরে গানটা বাজছে। বিদেশে বসে নিজের দেশের গানে জাহাজে থাকা বাঙালি রক্তে বান ডাকলো যেন।
এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিরা দৌড়ে এসে নাচা শুরু করলো ডিজের সামনে। শুরু হলো যেন অলিখিত ভারত-বাংলাদেশ নৃত্য প্রতিযোগিতা। তাতে ভারতীয়দের আধিক্য ছিলো বলাই বাহুল্য, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশিরা সংখ্যায় কম হলেও হইচইয়ে কম যায়নি।
রিভার ক্রুজ নামে অপর একটি জাহাজ
ব্যাংককের ডাইনিং ক্রুজের অভিজ্ঞতা আসলেই বেশ মজার। ছোট এই ভ্রমণে বেশ অনেক কিছুই পাওয়া যায়। নদী পাড়ের অসাধারণ দৃশ্য। নাচগান। টাইটানিকের পোজ দেয়া ছবি ইত্যাদি টুকরা টুকরা ছবি হৃদয়ের মনিকোঠায় সযত্নে রেখে দেয়ার মতো অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকবে, দীর্ঘদিন।
আমরা কি আমাদের বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলীসহ প্রধান শহরগুলোর নদীগুলোতে এমন ডাইনিং ক্রুজের ব্যবস্থা করতে পারি না!