তৌহিদা শিরোপা: এই হাসির আড়ালে কী দুঃখ ছিল মডেল রাউধা আথিফেরনীল চোখে নীল সমুদ্রের মতো গভীরতা, প্রগাঢ়তা। আত্মবিশ্বাসী তো বটেই।
একজন মেয়ে চিকিৎসক হবেন বলে মালদ্বীপ থেকে রাজশাহীর একটি মেডিকেল কলেজে পড়তে এলেন। কী এমন হয়েছিল তাঁর যে বেছে নিতে হলো আত্মহত্যার পথ। গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফাঁস নেওয়ার কারণেই রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছাত্রী ও মালদ্বীপের মডেল রাউধা আথিফের মৃত্যু হয়েছে।
ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করে তা জমা দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তবুও মা–বাবার মনে অনেক প্রশ্ন মেয়ের মৃত্যু নিয়ে। রাউধার আত্মহত্যা ঘটনার তদন্ত করতে রাজশাহী এসেছেন মালদ্বীপের দুই পুলিশ কর্মকর্তা। তাঁরা কথা বলছেন রাজশাহী পুলিশের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে।
রাউধার বাবা মোহাম্মদ আথিফ, মা আমিনাথ মুহাররিমাথ এবং ভাই–বোনেরা এসেছিলেন রাজশাহীতে। রাজশাহীর মাটিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত করেন রাউধাকে।
পিয়ানোতে নিজের প্রিয় সুর তোলার আগে, চিকিৎসক হিসেবে অন্যের সেবা করার আগে এই সিদ্ধান্ত কেন নিতে হয়েছিল তাঁকে? নীল চোখের আড়ালে কি ঢাকা পড়েছিল মনের নীল বেদনা?
ভোগের সেই প্রচ্ছদগত বছর ফ্যাশন সাময়িকী ভোগইন্ডিয়ার একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে কাজ করার সময় মডেল রাউধার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাংলাদেশের মডেল জান্নাতুল পিয়ার।
একদিনই তাঁরা একসঙ্গে ফটোশুট করেছিলেন। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মেয়েটি কেন আত্মহত্যার পথ বেছে নিলেন, বুঝতে পারছেন না পিয়া। ‘একদিনই কথা হয়েছিল। আমি তো খুব অবাক হয়েছিলাম মালদ্বীপ থেকে বাংলাদেশে পড়তে গেছে। দেশে ফিরে অবশ্য আর যোগাযোগ হয়নি।
ওর মৃত্যুর খবর শুনে খুবই মর্মাহত আমি। ও তো অন্য দশটা মেয়ের মতো না। ওর জীবনে যা-ই ঘটুক না কেন আত্মহত্যা করবে কেন? যদি একটু নিজের কষ্টগুলো বড় করে না দেখে সেটি থেকে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজত। আত্মহত্যা তো বেঁচে যাওয়ার কোনো পথ না।’ কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন পিয়া।
আত্মহত্যা করার প্রবণতা থাকে কারও কারও মধ্যে। মানসিক চাপ, হতাশা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা থেকে কেউ কেউ ভাবেন আত্মহত্যা করলে সব সমস্যার সমাধান। জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে সমস্যার সমাধান করা কোনো কাজের কথা হতে পারে না। এ ধরনের প্রবণতা নিজে বুঝতে পারলে কিংবা কাছের মানুষেরা বুঝতে পারলে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তাজুল ইসলাম মনে করেন অনেকে রাগ, অভিমান ও কষ্টকে কয়েক মুহূর্তের জন্য মেনে নিতে পারেন না। দেখা গেল বড় কোনো অন্যায় হয়ে গেছে তাঁর সঙ্গে। সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সাহস না থাকায় আত্মহত্যা করে ফেলেন।
হঠাৎ করেই শক্ত মনোবলের কোনো মানুষকে যদি শোনেন আত্মহত্যা করে ফেলেছে, তাহলে আপাত চোখে মনে হবে, আত্মহত্যা ছাড়া হয়তো কোনো পথ খোলা ছিল না।
কিন্তু তার জায়গা থেকে বিবেচনা করলে মনে হবে, ওটাই সহজ সমাধান। মনের আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সব মানুষেরই থাকা উচিত। যত পাহাড়সমান বিপদই আসুক না কেন, আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া যাবে না।
একজন মেয়ের সঙ্গে কথা হলো কদিন আগে। চাকরিজীবী এই মেয়েটি তিনবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। মনে হয়েছিল এ জীবনে তাঁকে দিয়ে কিছু হবে না। মাদকাসক্ত হননি, বেছে নিয়েছিলেন নিজেকে শেষ করার পথ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেয়েটি বলেন, পারিবারিক সমস্যার কারণে বারবার বেছে নিয়েছিলাম এই পথ। ওই সময় যাঁরা আত্মহত্যা করা খারাপ বলত, ভাবতাম—এটা কেন স্বার্থপরের মতো কাজ হবে?
কাউকে কষ্ট না দিয়ে চলে যাব। আমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। বন্ধুরা আমাকে বোঝায়। সময় দেয়। আজ আমি বুঝতে পারি কী বোকাই না ছিলাম। জীবনে আরও অনেক কিছু আছে, তার মধ্যে কিছু না কিছুর জন্য আমি উপযুক্ত। আমি নিজেই এখন অন্যকে বোঝাই। আত্মহত্যা প্রতিরোধে কাজ করি।
পপতারকা সেলেনা গোমেজও মাঝেমধ্যেই নিজের হতাশা, দুশ্চিন্তা আর একাকিত্বের চাপে চুপসে যান। মানসিক অস্থিরতা বেড়ে গেলে আমি সব কাজ থেকে নিজেকে অবসর দিয়ে ফেলি। ব্যস্ততা থেকে দূরে সরে নিজেকে ঠিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাই। এমনটাই বলেন তিনি। এখন তিনি আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটা জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমও চালাচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আত্মহত্যা প্রতিরোধে একটি প্রচারণা চালায়। তাদের মতে, সমবেদনা ও ভালোবাসা দিয়ে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা যায়। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দালাই লামার একটি কথা সবার মনে রাখা উচিত।
তিনি বলেছেন, কারও কষ্টে সমব্যথী হওয়া কেবল ধর্মীয় ব্যাপার নয়, এটা মানবতার বিষয়। বিলাসিতা নয়; বরং আমাদের নিজের মনের শান্তির জন্য, স্থিতিশীলতার জন্যও টিকে থাকার জন্য জরুরি।