বানিজ্য ডেস্ক: চট্টগ্রামের ম্যাফ সুজ লিমিটেড বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেটি আন্তর্জাতিকমানের স্যান্ডেল ইউরোপ-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করছে। গত বছর ১৮ লাখ জোড়া চপ্পল রপ্তানি করেছে। এতে আয় হয়েছে ১৯ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। চলতি বছর ৩০ লাখ জোড়া জুতা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন : আসিফ সিদ্দিকী
বাংলাদেশ থেকে চামড়া বা লেদারের জুতা রপ্তানি হচ্ছে অনেক আগেই। সিনথেটিক বা চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিতেও এসেছে বড় অর্জন। কিন্তু ফ্লিপফপ বা রাবার স্যান্ডেল (যাকে অনেকে হাওয়াই চপ্পল বলে থাকেন) রপ্তানির বড় অংশ দখল করছে, তা অনেকেরই অজানা।
চট্টগ্রামের ম্যাফ সুজ লিমিটেড বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেটি আন্তর্জাতিক মানের স্যান্ডেল ইউরোপ-এশিয়ার বড় দেশগুলোতে রপ্তানি করে ভালো অবস্থান দখলে নিয়েছে। এমনকি পাশের দেশ ভারতের বাজারেও বেশ ভালো অবস্থান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
নগরীর কালুরঘাটে বিসিক শিল্প এলাকার এই প্রতিষ্ঠান সর্বশেষ ২০১৬ সালে ১৮ লাখ জোড়া চপ্পল রপ্তানি করেছে। এতে রপ্তানি আয় হয়েছে ১৯ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। চলতি বছর এর দ্বিগুণ অর্থাৎ ৩০ লাখ জোড়া জুতা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উদ্যোক্তারা জানান, চামড়াজুতা রপ্তানিতে সরকারি প্রণোদনা থাকলেও চামড়াবিহীন জুতাতে নেই কোনো প্রণোদনা এবং নীতি সহায়তা। অথচ গত অর্থবছরে দেশ থেকে মোট জুতা রপ্তানির ৩০ শতাংশ এসেছে চামড়াবিহীন জুতা খাত থেকে। প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দেওয়া হলে চামড়ার জুতা রপ্তানি করে গত ২০ বছরে যে রপ্তানি আয় হয়েছে, চামড়াবিহীন জুতায় তা ১০ বছরে পূরণ করা সম্ভব।
এর পরও উৎপাদন শুরুর মাত্র তিন বছরেই এই জুতা বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের পছন্দের শীর্ষে উঠে এসেছে। বর্তমানে ম্যাফ সুজের চপ্পল কিনছে ফ্রান্সের বিখ্যাত ডিক্যাথলন, এইচ এন্ড এম, কাপ্পা, স্কেচারসসহ ইউরোপের অনেক দেশ, এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর, ভারত ও তুরস্ক। এর আগে এসব দেশ চীন থেকে এসব জুতা কিনত।
জানতে চাইলে ম্যাফ সুজের নির্বাহী পরিচালক জসীম আহমেদ বলেন, ‘২০১০ সাল থেকে আমরা বিভিন্ন ডিজাইনের সিনথেটিক বা চামড়াবিহীন কেডস, স্পোর্টস সুজ উৎপাদন শুরু করি। ২০১২ সালে ৩ লাখ ৮৩ হাজার জুতা রপ্তানি করে ইউরোপের ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে সক্ষম হই। এর পাশাপাশি আমরা জুতার আউটসোল বা তলা রপ্তানি করতে থাকি। ’
‘আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ঠিক রেখে উৎপাদন, গুণগতমান এবং প্রতিযোগিতামূলক দাম দিয়ে বিদেশের বিখ্যাত ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করি। এর ফলে চীনের পাশাপাশি আমরা এই জুতা সেসব দেশে রপ্তানি করতে সক্ষম হই। ২০১৪ সালে মাত্র চার হাজার ফ্লিপফপ জুতা রপ্তানি করে ম্যাফ সুজ বাংলাদেশে এখন একমাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ’-যোগ করেন জসীম।
ম্যাফ সুজ কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রায় চার লাখ বর্গফুট আয়তনের মেঝেতে একসঙ্গে কাজ করেন সাড়ে চার হাজার শ্রমিক।
এই শ্রমিক সংগ্রহেও প্রথমদিকে বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল উদ্যোক্তাদের। এ প্রসঙ্গে জসীম আহমেদ বলেন, এই খাতে শ্রমিক পাওয়া কঠিন ছিল। তাই প্রথম থেকে একেবারে নতুন শ্রমিক নিয়ে তাঁদেরকে হাতে-কলমে কাজ শিখিয়ে এই খাতে দক্ষ করে তুলি। ধাপে-ধাপে তাঁদের সুযোগ-সুবিধা পদোন্নতি বাড়তে থাকে। এসব শ্রমিক আমাদের উৎপাদনের প্রাণশক্তি। যার কারণে এই কারখানা ছেড়ে শ্রমিক চলে যাওয়ার সংখ্যা একেবারে নগণ্য।
জানা গেছে, কারখানায় অন্য চামড়াবিহীন জুতার পাশাপাশি ২০১৪ সালে প্রথম ফ্লিপফপ জুতা উৎপাদন শুরু করে ম্যাফ সুজ। সেই বছর ফ্রান্সে মাত্র চার হাজার স্যান্ডেল রপ্তানি করে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর থেকে বিদেশি ক্রেতারা এই জুতার জন্য ম্যাফকেই বেছে নেয়।
২০১৫ সালে ফ্লিপ ফপ জুতা রপ্তানি একলাফে বেড়ে ৪ লাখ ৬২ হাজার জোড়ায় উন্নীত হয়। আর গত বছর সেটি বেড়ে ১৮ লাখ জোড়ায় পৌঁছায়। চলতি ২০১৭ সালে ৩০ লাখ জোড়া জুতা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এছাড়া ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি কেডস, স্পোর্টস সু ও ফ্লিপফপ জুতা মিলিয়ে মোট জুতা রপ্তানি করে ৫৩ লাখ জোড়া। ২০১৭ সালে রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৮৬ লাখ জোড়া।
জসীম আহমেদ মনে করেন, বিশ্বব্যাপী জুতা উৎপাদন ও রপ্তানিতে চীন এখনো বিশ্বে শীর্ষে। কিন্তু শ্রমব্যয় বেড়ে যাওয়ায় চীনের কারখানা বিশ্বের অন্য দেশে বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করা হচ্ছে। এই সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে পারে বাংলাদেশ।
উদ্যোক্তারা জানান, কেরিফোর, এইচঅ্যান্ডএম, কাপ্পা, পুমা, ফিলা, টিম্বারল্যান্ড, ডাইচম্যান, প্রাইমার্কের মতো বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের কাছে জুতা রপ্তানি করছে। সমপ্রতি বিশ্বখ্যাত ওয়ালমার্ট, টার্গেট, টেসকোসহ অনেক ব্র্যান্ড দেশিয় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে এই জুতা কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
ম্যাফ সুজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসনাত মোহাম্মদ আবু ওবায়দা (মার্শাল) বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পের শীর্ষ বিদেশি ক্রেতারা এখন পোশাকের পাশাপাশি এই সিনথেটিক জুতা বাংলাদেশ থেকে আমদানি করতে চাইছে। বাংলাদেশ যেহেতু এই শিল্পে ইতিমধ্যে দক্ষতা দেখিয়ে ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করেছে সুতরাং তাদের কাছ থেকে সিনথেটিক জুতার অর্ডার নেওয়া খুব সহজ। ’
তিনি আরো বলেন, চামড়ার জুতা রপ্তানি করে ২০ বছরে যে রপ্তানি আয় হয়েছে, চামড়াবিহীন জুতায় তা ১০ বছরে সম্ভব। তবে এ জন্য চামড়াবিহীন জুতাকেও নীতি সহায়তা দিতে হবে।
এ খাতে চামড়ার জুতার মতো নগদ সহায়তা দাবি করে তিনি বলেন, শ্রমঘন শিল্প হওয়ায় এ খাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি। স্থানীয় উৎস থেকে কাঁচামাল ব্যবহার করা হলে মূল্য সংযোজনও ৬৫ শতাংশের বেশি হবে।
দেশিয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে ম্যাফ সুজ এই খাতে বাংলাদেশে বড় সফলতা দেখাতে চায়। এ জন্য প্রবৃদ্ধির সাথে মিল রেখে কারখানা সম্প্রসারণ করছে। তাঁদের দাবি, বর্তমান সরকার যদি এই খাতে ২০ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয় তাহলে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত সমপ্রসারণ করা সম্ভব।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে চামড়াবিহীন জুতা রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৯১ লাখ ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি। জুতা রপ্তানির মোট আয়ের ৩০ শতাংশ এসেছে চামড়াবিহীন জুতা থেকে। প্রতিবছর এই খাত আরো বড় হচ্ছে এবং প্রবৃদ্ধিও বেশি হচ্ছে।