রাজধানী ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে কনকনে ঠান্ডা শীত ও প্রচন্ড কুয়াশা উপেক্ষা করে দেশ-বিদেশ থেকে আগত লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের উপস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের ৪৭তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়েছে শুক্রবার। ভারতের মাওলানা মো. ইসমাইল হোসেন গোদরার বাদ ফজর বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব। তাঁর বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মো. নূরুল রহমান। দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দিনে আড়াই হাজার বিদেশি মুসল্লি অংশ নিয়েছেন। আজ রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে দুই পর্বের এবারের বিশ্ব ইজতেমা।
গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগতীরে শুক্রবার শুরু হওয়া বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পবে জুমার নামাজে লাখো লাখো মুসল্লি অংশ নেন। নামাজে ইমামতি করেন ঢাকার কাকরাইল মসজিদের ইমাম মাওলানা জোবায়ের। ইজতেমায় যোগদানকারী মুসল্লি ছাড়াও জুমার নামাজে অংশ নিতে ঢাকা-গাজীপুরসহ আশপাশের লাখো মানুষ হাজির হন। দুপুর ১২টার দিকে ইজতেমা মাঠসহ আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। মাঠে জায়গা না পেয়ে মুসল্লিরা মহাসড়ক ও অলিগলিসহ যে যেখানে পেরেছেন, হোগলাপাটি, চটের বস্তা ও খবরের কাগজ বিছিয়ে জুমার নামাজে শরিক হন।
বাংলার পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষায় মূল বয়ান তরজমা করা হয়। বয়ানে মাওলানা ইসমাইল হোসেন বলেন, দ্বীন টিকে থাকবে দাওয়াতের মাধ্যমে। যুগে যুগে নবী-রাসুলগণ দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে গেছেন। ফেরাউনের কাছেও দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিতে আল্লাহ হজরত মুসা (আ.)-কে পাঠিয়েছিলেন। নবী-রাসুলদের আল্লাহ বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন। আল্লাহ সুবহানাতায়লা সারা দুনিয়ায় িদ্বীনের দাওয়াত দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে পাঠিয়েছিলেন হজরত মুহামদ (সা:)-কে । আজ তিনি নেই।কিন্তু এ কাজের জিম্মাদারী অপিত করে গেছেন দুনিয়ার তার সকল উম্মতের ওপর।
গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত হূদেরাগ, শ্বাসকষ্ট ও বার্ধক্যজনিত কারনে আক্রান্ত হয়ে চারজন মুসল্লি মারা গেছেন। মৃতরা হলেন: বগুড়ার ধুনট উপজেলার হাতিয়াপাড়া এলাকার হাজি আফজাল হোসেন (৬০), কুমিল্লা সদরের হোসেনপুর সাতবাড়ি এলাকার মো. নাজির আহমদ (৫৫), গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার নীলফা এলাকার মো. বাদল ফকির (৭০) ও খুলনা সদরের সোনাডাঙ্গা এলাকার শামসুল হক (৭০)।
গাজীপুরের সিভিল সার্জন সৈয়দ হাবিব উল্লাহ জানান, টঙ্গী হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত তিনটি মেডিকেল ক্যাম্পে গত দুই দিনে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত তিন হাজার ৮২৭ জন মুসল্লি চিকিৎসা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট ও হৃদরোগজনিত কারণে অসুস্থ ১৪ জনকে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে এবং ১৫ জনকে টঙ্গী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাদ্য পরিবেশন এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির অভিযোগে ইজতেমাস্থল ও আশপাশের খাবারের দোকান-হোটেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ৯টি মামলা ও ৬৪ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছেন।
এর আগে ১১ থেকে ১৩ জানুয়ারি ইজতেমার প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ইজতেমায় আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে ট্রেন, বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, ট্যাক্সি, স্কুটার, নৌকা ও পায়ে হেঁটে তুরাগ তীরে সমবেত হচ্ছেন। ইজতেমা মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় পুলিশসহ পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী নিয়োজিত রয়েছে। বাইনোকুলার ও মেটাল ডিটেক্টর নিয়ে টহল চলছে। কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে। ইজতেমা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ৯টি ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি রা্বও নিরাপত্তা রক্ষায় নিয়োজিত রয়েছে। রাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রাশেদুল আলম জানান, দ্বিতীয় দফায়ও রাব সদস্যরা ৪টি সেক্টরে ভাগ হয়ে ইজতেমার ময়দান ও আশপাশে নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। মুসল্লিদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিতে বেসরকারি ৫৯ অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়াও টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের ৫০ শয্যা বাড়ানো হয়েছে। গুরুতর অসুস্থ মুসল্লিদের হাসপাতালে নেয়ার জন্য সার্বক্ষণিক পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে ১৯৪৬ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা হয়ে আসছে। শুরুতে ঢাকার কাকরাইল মসজিদে ইজতেমা হতো। ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামের হাজি ক্যাম্পে এবং ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা হয়। ইজতেমায় মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকায় ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়। এরপর থেকে এখানেই ইজতেমা হচ্ছে। মুসুল্লিদের কষ্ট দুভোগের কথা বিবেচনা করে ২০১০ সাল থেকে বিশ্ব ইজতেমা দুই পর্বে সম্পন্ন হচ্ছে। যা যথারীতি এবারও সম্পন্ন হবে।
Leave a Reply