বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৪২

প্রেসিডেন্ট হিসাবে ওবামার শপথ গ্রহন

প্রেসিডেন্ট হিসাবে ওবামার শপথ গ্রহন

কাউসার মুমিন (যুক্তরাষ্ট্র থেকে): মার্কিন প্রেসিডেন্টদের দ্বিতীয় মেয়াদের অভিষেক অনুষ্ঠানকে বিশ্লেষকরা বরাবরই দ্বিতীয় বিয়ের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন, যেখানে প্রথম বিয়ের মতো আবেগ ও উদযাপনের ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামা বলে কথা। আমেরিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার প্রথম মেয়াদের অভিষেকে মার্কিন ইতিহাসের এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণের একটি আলাদা ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল। তাই বলে ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের অভিষেক নিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাস আর উপস্থিতির কমতি নেই। ক্যাপিটল ভবনের তিন মাইল ব্যাসার্ধ জুড়ে যান চলাচল বন্ধ, তীব্র শীতের প্রকোপ আর অভিষেক কমিটির অতিমাত্রিক কঠোর নিয়ম কানুন-সবকিছু উপেক্ষা করে আজ সোমবার অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের অভিষেক অনুষ্ঠানে বিপুল মানুষের উপস্থিতি ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদকেও ঐতিহাসিক মর্যাদায় নিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই দিন নয় লাখ মানুষের উপস্থিতি ধারণা করছে সিএনএন।

আমেরিকার বিভিন্ন সরকারি অফিস-আদালতে ব্যবহারের জন্য হোয়াইট হাউস গত শুক্রবার দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামার যে অফিসিয়াল পোর্ট্রেট প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গে প্রথম মেয়াদের পোর্ট্রেটকে মিলিয়ে দেখলেই দ্বিতীয় মেয়াদের প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কে একটি সম্ভাব্য ধারণা পাওয়া যায়। প্রথম মেয়াদের প্রেসিডেন্ট ওবামার অফিসিয়াল পোর্ট্রেটে ছিল দুই দু’টি যুদ্ধ, আর অর্থনৈতিক মহামন্দার অজানা শঙ্কায় ভারাক্রান্ত একজন গম্ভীর, স্মিতহাস্য, দ্বিধান্বিত ওবামা। সে তুলনায় গত ৬ই ডিসেম্বর হোয়াইট হাউস ফটোগ্রাফার পিট্‌ সুজা’র তোলা ‘ওভাল অফিসে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে দুই হাত আড়াআড়ি করে, ভারমুক্ত, আত্মবিশ্বাসী আর হাস্যোজ্জ্বল ওবামা’র ছবি যেন ‘দি অডাসিটি অব হোপ’-এ বর্ণিত ব্যক্তি ওবামার নিকট দায়বদ্ধ প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রতিশ্রুত পরিবর্তনের পূর্ণাঙ্গ পরিণতিরই সমূহ পূর্বাভাস। কিন্তু একটি চলমান প্রক্রিয়া ‘পরিবর্তন’ বিশেষ করে মার্কিন ধারার রাজনীতিতে যে কতটা কঠিন এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ওবামার চেয়ে বেশি এই মুহূর্তে আর কেউ জানেন না। আর এ রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও বেশি জটিল করেছে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা বিশেষ করে মার্কিন সরকারের বাজেট সীমাবদ্ধতা। ওবামার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দর্শনের সমর্থক সহ নিরপেক্ষ অর্থনৈতিক বিশ্লেষকগণও মত প্রকাশ করেছেন, সর্বোত্তম ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র বাজেট সীমাবদ্ধতার কারণে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ওবামা গৃহীত কর্মসূচি প্রত্যাশিত সফলতা পাবে না। বাজেট বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১১ সালে সরকারি খরচের ঊর্ধ্বমুখী ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরতে প্রেসিডেন্ট ওবামা নিজ হাতে যে আইন স্বাক্ষর করেছেন, আইন মোতাবেক সেই মাত্রায় খরচ করে শিক্ষা, বিজ্ঞান গবেষণা ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সহ অন্যান্য খাতে বেশি মাত্রায় বিনিয়োগের মাধ্যমে বর্তমান অত্যধিক প্রতিযোগিতাপূর্ণ ও দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির দুনিয়ায় আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখা কঠিন হবে। হোয়াইট হাউসের হিসেবে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি খরচের নির্ধারিত মাত্রা আর বৃদ্ধি করা না হলে, ২০১৭ সাল নাগাদ যখন ওবামা হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাবেন তখন বর্তমানের চেয়ে সরকারি খরচ ১৬ শতাংশ কম করতে হবে, যা সার্বিক উন্নয়ন কর্মসূচিকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। এমন একটি বাস্তবতাকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ গ্রহণ উপলক্ষে গত শনিবার সমগ্র আমেরিকাজুড়ে ‘ন্যাশনাল ডে অব সার্ভিস’ পালনের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে তিনদিনব্যাপী প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠান। এবারের অভিষেক অনুষ্ঠানটি আমেরিকার ইতিহাসে ৫৭তম। আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা এ বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ক্যাপিটল ভবনের পশ্চিম প্রান্তে জনসম্মুখে শপথ গ্রহণ করবেন আগামীকাল ২১শে জানুয়ারি, সোমবার। শপথ গ্রহণ শেষে প্রেসিডেন্ট ওবামা তীব্র শীত উপেক্ষা করে প্রায় ৬ ঘণ্টা সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে, সমগ্র বিশ্ব তথা আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্য প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে আগত আনুমানিক ৯ লাখ মানুষের এক বিশাল সমাবেশে তার দ্বিতীয় মেয়াদের অভিষেক বক্তৃতা প্রদান করবেন। এ বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট ওবামা কোন কোন ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন সে বিষয়ে পূর্বধারণা দিতে ইতিমধ্যেই অপারগতা প্রকাশ করেছেন হোয়াইট হাউস মুখপাত্র জে কার্নি। তবে এ বিষয়ে প্রাক্তন প্রেসিডেন্টদের স্পিচ রাইটারগণ প্রায় সকলেই বলছেন, প্রথম মেয়াদের চেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের অভিষেক বক্তৃতা বিষয়টি সবসময়ই খুব কঠিন কাজ। এ বিষয়ে ওবামার স্পিচ রাইটার জন ফাভ্রু মিডিয়াকে জানান, ‘বক্তৃতা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত ওবামা বারবার সংশোধন করতেই থাকবেন।’ এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, অভিষেক বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট বিতর্কিত ইস্যুগুলো এড়িয়ে জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দেবেন। এমনকি বক্তৃতায় স্প্যানিশ ভাষায় একটি শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করে বিপুল হইচই বাঁধিয়ে দিতে পারেন প্রেসিডেন্ট ওবামা। এর আগে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রক্ষার্থে গতকাল ২০শে জানুয়ারি, রোববার প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ করবেন। প্রথমে ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আজ মার্কিন সময় সকাল ৮-১৫ মিনিটে নেভাল অবজারভেটরিতে শপথ নেবেন। ভাইস প্রেসিডেন্টকে শপথ বাক্য পাঠ করাবেন ইউ এস সুপ্রিম কোর্টের এসিস্ট্যান্ট জাস্টিস। শপথ পাঠ করানোর দায়িত্বে প্রথম মহিলা ও লাতিনো বিচারপতি সোনিয়া সাটোমেয়ার। জন বাইডেন তার পারিবারিক বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেবেন। অপরদিকে সকাল ১১-৫৫ মিনিটে হোয়াইট হাউসের ব্লু রুমে আমেরিকার ৪৪তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য শপথ নেবেন বারাক হোসেন ওবামা (৫১)। প্রেসিডেন্ট ওবামাকে শপথ বাক্য পাঠ করাবেন যুক্তরাষ্ট্র সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস জুনিয়র। দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ অনুষ্ঠানে এবার ওবামা দু’টি বাইবেলে হাত রেখে শপথ নেবেন, যার একটি প্রেসিডেন্ট লিংকন এবং অন্যটি মার্টিন লুথার কিং-এর ব্যক্তিগত বাইবেল।

উল্লেখ্য, মার্কিন সংবিধানের ২০তম সংশোধনী মোতাবেক ২০শে জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের মেয়াদ থাকে এবং ওইদিন বেলা ১২টার আগেই নতুন প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব পালনের শপথ নিতে হয়। মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের প্রথম ধারায় বর্ণিত ৩৫টি শব্দের লিখিত শপথ বাণী পাঠ করে প্রেসিডেন্ট শপথ নিয়ে থাকেন। যদিও প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সময় থেকেই শপথ গ্রহণের শেষ বাক্য হিসেবে ‘সো, গড হেল্প মি’ বলে শপথ শেষ করার একটি ঐতিহ্য চলে এসেছে, কিন্তু সমপ্রতি বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, লাইব্রেরি অব কংগ্রেস, ভারমন্টে অবস্থিত প্রথম প্রেসিডেন্টের বাড়ি এবং সিনেটের সমস্ত ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটেও তারা এই দাবির পক্ষে কোন দালিলিক প্রমাণ খুঁজে পান নি। এদিকে ২০শে জানুয়ারি রোববার হওয়ায় প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ পিছিয়ে ২১শে জানুয়ারি সোমবার নেয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত ৭ বার। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে রোববার সুপ্রিম কোর্টের সরকারি ছুটির কথা বলা হলেও এমন জবাবে খুশি নয় কোন কোন মার্কিন মিডিয়া, কেননা, ২১শে জানুয়ারি সোমবার মার্টিন লুথার কিং দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি রয়েছে।

এদিকে প্রেসিডেন্টের অভিষেক উপলক্ষে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী উৎসবের প্রথম দিন গতকাল আমেরিকা জুড়ে ‘ন্যাশনাল ডে অব সার্ভিস’ পালন করেছে মার্কিনিরা। চার বছর আগে মহান মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং-এর কর্ম ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে প্রেসিডেন্ট ওবামা ১৯শে জানুয়ারিকে ন্যাশনাল ডে অব সার্ভিস ঘোষণা করেন। ইতিমধ্যেই দিনটি সত্যিকার অর্থে একটি জাতীয় উদ্‌যাপনের দিন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবছর এই দিনে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পরিবার সহ পুরো আমেরিকা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চা, পরিবেশ সুরক্ষা, কম্যুনিটি পরিসেবা ও যুদ্ধফেরত সৈনিকদের দেখাশোনা বিষয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে থাকেন। এ উপলক্ষে গতকাল ৫০০ স্বেচ্ছাসেবক সঙ্গে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবার ওয়াশিংটন ডিসির বার্ভিল এলেমেন্টারি স্কুলে ভলান্টারি শ্রম দেন। প্রেসিডেন্ট ও মিশেল ওবামা ওই স্কুলের একটি বুকসেলফে রঙ লাগানোর কাজ করেন। এ সময় প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এ-ই হলো (জাতির জন্য কাজ করা) সত্যিকারের আমেরিকা, আমরা যা উদযাপন করি তা মূলত এই আত্মত্যাগের শিক্ষা-ই।’ প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘গণতন্ত্র কতটা সুসংহত ভাবে কাজ করে, কত মসৃণভাবে আমরা ক্ষমতা হস্তান্তর করি-তার উজ্জ্বল প্রতীক হলো অভিষেক অনুষ্ঠান।’




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024