সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৩:৫৪

ভারতে নিষিদ্ধ হলো তিন তালাক

ভারতে নিষিদ্ধ হলো তিন তালাক

শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: সর্বোচ্চ আদালতের এক যুগান্তকারী রায়ে ভারতে ‘তিন তালাক’ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। তবে রায়টি ছিল বিভক্ত। ৫ বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের ২ জন আপাতত তালাক প্রথা স্থগিত করে ৬ মাসের মধ্যে পার্লামেন্টকে নতুন আইন তৈরির নির্দেশনা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন।

তবে বেঞ্চের বাকি ৩ বিচারপতি মৌখিক তালাককে ইসলামের মূল চেতনার বিরোধী, নারীর জন্য অবমাননাকর এবং অসাংবিধানিক বলে আখ্যা দেন। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের আদেশে ভারতে তিন তালাক প্রথা নিষিদ্ধ হলো।

এখন ভারতীয় মুসলিম নাগরিকদের বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নতুন আইনের প্রয়োজন হবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজেপি নেত্বত্বাধীন এনডিএ জোট সরকার দ্রুত নতুন আইন করার ব্যাপারে আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিল।

তিন তালাকের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা ভারতীয় মুসলিম নারীদের কয়েকটি পিটিশনের ওপর সাম্প্রতিক শুনানি শেষে মঙ্গলবার (২২ আগস্ট) সকালে যুগান্তকারী এই রায় দিয়েছেন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। হিন্দুস্থান টাইমস-এর খবরে বলা হয়েছে, এ দিন বিচারপতি ইউ ইউ ললিত, আর এফ নরিম্যান এবং কুরিয়েন জোসেফ তালাক-এ-বিদাতকে (তিন তালাক) অসাংবিধানিক, ইসলামবিরোধী এবং কোরান বিরুদ্ধ আখ্যা দেন।

তাদের মতে, এই প্রথা ইসলামে নেই, কোরানেও এর কোনও উল্লেখ নেই। কেবল শরিয়তি আইনে এর উল্লেখ রয়েছে। সে কারণে তারা ‘দেশের সংবিধানের দাঁড়িপাল্লায় এই আইনকে নিরীক্ষণ করা’র কথা জানান। তারা জানান, নিরীক্ষা করে একে অসাংবিধানিক বলেই মনে করেছেন তারা।

বেঞ্চের অন্য দুই সদস্য প্রধান বিচারপতি জেএস খেহর এবং বিচারপতি এস আবদুল নাজির তিন তালাক প্রথাকে সংবিধান বিরোধী তকমা দেওয়ার বিরোধী ছিলেন।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবরে বলা হয়েছে, ওই দুই বিচারকের মতে, ইসলামে যার উল্লেখ রয়েছে, তাকে অসাংবিধানিক তকমা দেওয়াটা ঠিক নয়। তারা ওই প্রথার উপর ছ’মাসের স্থগিতাদেশ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তাদের অবস্থান ছিল ওই সময়ের মধ্যে এই বিষয়ে পার্লামেন্টকে নতুন আইন প্রণয়নের পরামর্শ দেওয়ার পক্ষে।। তবে শেষমেশ খেহর এবং নাজিরের মত ৩:২-এ হেরে যায়।

একাধিক মুসলিম দেশের উদাহরণ তুলে ধরে শীর্ষ আদালত প্রশ্ন করেছে, স্বাধীন ভারত কেন এই প্রথা থেকে মুক্ত হতে পারবে না। । ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, মুসলিম ব্যক্তিগত আইনের ইতিহাসে আজকের দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত থাকবে।

সম্প্রচারমাধ্যম এনডিটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত খবরে দিনটিকে ভারতীয় মুসলিম নারীদের জন্য ঐতিহাসিক বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মৌখিক তালাকের প্রথা অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় এখন দরকার পড়বে নতুন আইনের। এনডিটিভির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বিচারকরা নতুন আইন করার সময় যেন মুসলিম ধর্মীয় নেতাদের পরামর্শ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন।

ভারতীয় মুসলিম সমাজ ১৯৩৭ সালে কার্যকর হওয়া ‘মুসলিম পার্সোনাল আইন বা মুসলিম পারিবারিক আইন দ্বারা পরিচালিত। তবে মুসলিম ভারতীয় নারীরা তাদের পিটিশনে বলেছেন,তিন তালাক মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারের পরিপন্থী। একে নারীর মর্যাদা ক্ষুণ্নকারী একটা ব্যবস্থা বলেছেন তারা।

ভারতীয় সংবিধানের ২৫ (১) অনুচ্ছেদে নিজস্ব ধর্মাচরণ, ধর্মপ্রচারের যে অধিকার সুরক্ষিত আছে, তালাকের বিধান তার মধ্যে তা পড়ে না বলেও উল্লেখ করা হয় পিটিশনে। তিন তালাকের বিরুদ্ধে যারা শীর্ষ আদালতে পিটিশন ফাইল করেন, তারা হলেন সায়ারা বানু,আফরিন রহমান,ইসরাত জাহান,গুলশন পারভিন ও ফারহা ফয়েজ।

গত মে মাসে মুসলিম নারীদের দায়ের করা পিটিশনগুলোর ওপর শুনানি করেন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বাধীন সংবিধান বেঞ্চ। গ্রীষ্মকালীন অবকাশে টানা ছয়দিনের ম্যারাথন শুনানির শেষে গত ১৮ মে এই মামলার রায়দান স্থগিত রেখেছিল প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চ।

শুনানির সময় আদালত জানিয়েছিল যে, বহুগামিতার বিষয়টি এই মামলায় বিবেচনা করা নাও হতে পারে। মুসলিম ধর্মে তিন তালাক অবিচ্ছেদ্য মৌলিক অধিকার কিনা,শুধুমাত্র এই বিষয়টিই খতিয়ে দেখা হয়। পিটিশনের পাশাপাশি ২০১৫-র অক্টোবরে শীর্ষ আদালতেরই এক বেঞ্চের নির্দেশের ওপর আজ রায় দেওয়া হয়।

সুপ্রিমকোর্টের এই রায় ঘোষণার পর মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদে এবার নতুন আইনের প্রয়োজন পড়বে। আগেই বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিয়ে রাখা হয়েছিল, সর্বোচ্চ আদালত তিন তালাক অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করলে তারা মুসলিমদের বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ সংক্রান্ত নতুন আইন প্রনয়ণ করবে। তারা তিন তালাক প্রথার বিরোধিতা করে একে একতরফা ও বিচারবিভাগবহির্ভূত বলে মন্তব্য করেছিল।

তাদের মতে, সমস্ত পার্সোনাল ল-এরই সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকা উচিত। কেন্দ্রর পক্ষ থেকে আরও যুক্তি দেওয়া হয় যে, তিন তালাক ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়। এটি সংখ্যাগরু বনাম সংখ্যালঘু সংক্রান্ত কোনও ইস্যুও নয়। এটা মুসলিম পুরুষ ও বঞ্চিত নারীদের মধ্যে সংঘাত।

তিন তালাক প্রথা সম্পর্কে সাতটি আবেদনের মধ্যে পাঁচটি দায়ের করেছিল মুসলিম নারীরা। আর্জিতে তিন তালাক প্রথাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন তারা। শুনানির সময় আদালত তার পর্যবেক্ষণে বিবাহবিচ্ছেদের জন্য মুসলিম সমাজে প্রচলিত তিন তালাক প্রথা ‘জঘন্য’ বলেও মন্তব্য করেন। বিবাহবিচ্ছেদের এ ধরনের প্রথা আদৌ ‘কাঙ্খিত নয়’ বলেও মন্তব্য করেছিল আদালত।

যদিও মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মহলে ওই প্রথাকে বৈধ বলে দাবি করা হয়। রাম জেঠমালানি সহ বিশিষ্ট আইনজীবীরা তাদের সওয়ালে সমতার অধিকার সহ সাংবিধানের বিভিন্ন ধারার পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রথা বন্ধের পক্ষে সওয়াল করেন। আদালতে যুক্তি দেওয়া হয় যে, তিন তালাক প্রথা লিঙ্গ বৈষম্যের সামিল। পবিত্র কোরানের শিক্ষার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

প্রধান বিচারপতি খেহর সে সময় বলেছিলেন,প্ রথমত দেখতে হবে,তিন তালাক ইসলামের অবিচ্ছেদ্য বিষয় কিনা। এটি ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলে দেখতে হবে,সেখানে আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি কিনা। দ্বিতীয়ত, বিবেচনায় নিতে হবে এই প্রথা ধর্মীয় সংস্কারমূলক কিনা। তৃতীয়ত, কোনও প্রয়োগযোগ্য মৌলিক অধিকার এই প্রথার ফলে লঙ্ঘিত হচ্ছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে।

এদিকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে প্রবীণ আইনজীবী কপিল সিব্বল বলেন, তিন তালাক আসলে একটি বিশ্বাসের ব্যাপার৷ সেখানে কোনও সাংবিধানিক নৈতিকতার প্রশ্ন নেই৷ অযোধ্যায় রামের জন্মও যেমন বিশ্বাসের ব্যাপার, ঠিক সেরকমই তিন তালাকও একটি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস বলে মনে করা হয়৷

তিনি বলেন, ৬৩৭ খ্রীস্টাব্দ থেকে এই প্রথা প্রচলিত রয়েছে। একে কোনওভাবেই অ-ইসলামি বলা যায় না। এই বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ বাঞ্ছনীয় নয় বলেই দাবি করেছিল মুসলিম বোর্ড৷ মুসলিম সম্প্রদায় নিজেই এর সমাধান খুঁজে বের করতে পারবে বলেও জানানো হয়েছিল৷




Comments are closed.



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024