জাকিয়া আহমেদ: মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও খাদ্য-চিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি এ জনগোষ্ঠীর পরিবার পরিকল্পনার দিকেও মনোযোগ দিয়েছে সরকার।
গত তিন দিন ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা নারী-পুরুষদের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সুফল তুলে ধরা হচ্ছে। একইসঙ্গে বিতরণ করা হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীও। এছাড়া, প্রসবকালীন এবং নবজাতক ও প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্যসেবাকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতন ও গণহ্ত্যার মুখে গত ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত চার লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৬ হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা। ইতোমধ্যে ১৫টি শিশুর জন্ম হয়েছে। কক্সবাজারের পরিবার পরিকল্পনা অফিস সূত্রমতে,বিবাহিত রোহিঙ্গা নারীদের গড়ে সাত থেকে ১০টি করে সন্তান রয়েছে। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই অনেকগুলো করে ছোট শিশু রয়েছে।
বাংলাদেশে এর আগে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যাও কমপক্ষে চার লাখ। বিপুলসংখ্যক এই রোহিঙ্গার আশ্রয় ও খাদ্য-চিকিৎসা জনবহুল বাংলাদেশের জন্যে এমনিতেই বিশাল চাপ।
তারওপর রোহিঙ্গাদের অধিক সন্তান নেওয়ার প্রবণতা প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। একটি সূত্র জানায়, সবদিক বিবেচনা করেই রোহিঙ্গাদের পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আনার নির্দেশনা এসেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা যদি বাড়তে থাকে তাহলে তাদের ব্যবস্থাপনা, খাদ্য, বাসস্থানসহ নানামুখী সমস্যা দেখা দেবে।
জানা যায়, সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পরিদর্শন করেন। পরে তারা রোহিঙ্গাদের পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আনতে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেন।
এরপরই স্থানীয় পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয় মাঠে নামে। গত তিনদিন ধরে কাজ করছে তারা। এ বিষয়ে সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) কক্সবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক ডা. পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আজ আমরা উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি, ইনজেকশন ও কনডম বিতরণ করেছি। অন্তত দেড়শ নারীর মধ্যে বড়ি ও পঞ্চাশ জনের মতো পুরুষের মধ্যে কনডম বিতরণ করেছি।
এছাড়া, তিন মাসের বন্ধ্যাকরণ ইনজেকশনও প্রয়োগ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গারা এখনও ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় আছে। সরকারিভাবে নির্মিত ক্যাম্পে তাদের একত্রে রাখা হলে এবং নিবন্ধন কার্যক্রম শেষ হলে আমরা পুরোদমে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে পারব। তখন স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিও প্রয়োগ করা যাবে।
উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মিছবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। এর মধ্যে অনেক স্তন্যদাত্রী এবং অন্তঃসত্ত্বা মায়েরাও রয়েছেন। সামনের দিনগুলোতে যেন রোহিঙ্গাদের পরিবার পরিকল্পনা সেবার আওতায় আনা যায় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার একটা মৌখিক নির্দেশনা আমরা পেয়েছি।
তিনি আরও বলেন, ‘যেসব মায়েরা গর্ভবতী আছেন তারা যেন নিরাপদে প্রসব করতে পারেন সেজন্য আমাদের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কাছের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা ধাত্রী রাখার ব্যবস্থা করেছি।’ ঈদের পর থেকে উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন এবং বালুখালী স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে তিন জন মা সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির আওতায় আসা রোহিঙ্গা নারীদের কাছ থেকে কেমন রেসপন্স পাচ্ছেন জানতে চাইলে ডা. মিছবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা তো গত ২৬ আগস্ট থেকেই ওদের কাছে যাচ্ছি, ১৫ থেকে ১৬ হাজার শিশুকে টিকা দিয়েছি, রোহিঙ্গা শিবিরে যাচ্ছি–সে হিসেবে আমরা ওদের কাছে পরিচিত হয়ে গেছি। প্রচুর সাড়া পাচ্ছি, কোনও ধরনের বাধার সম্মুখীন হইনি, বরং দলে দলে মায়েরা আমাদের কাছে আসছে।
এদিকে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানিয়েছেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিবিরে রয়েছে কয়েক হাজার সন্তানসম্ভবা নারী। ইতোমধ্যে সেখানে মেডিক্যাল টিম পাঠানো হয়েছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলা হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০তে উন্নীত করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলের ৩০টি কমিউনিটি ক্লিনিকেরও সংস্কার করা হচ্ছে।