শীর্ষবিন্দু আন্তর্জাতিক নিউজ ডেস্ক: লোমহর্ষক নির্যাতনের সাক্ষ্য দিলেন রোহিঙ্গা চট্টগ্রামের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী রাজিয়া সুলতানা। মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক গণ আদালতে তিনি এক রোহিঙ্গা নারীর বর্ণনা শুনিয়েছেন।
তার সঙ্গে রাজিয়া কথা বলেছিলেন গত বছর, তার ও অন্য ১৯ জন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষাতকারও নিয়েছিলেন। তার ভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতনের কাহিনী তিনি মঙ্গলবার বর্ণনা করেছেন মালয়েশিয়ার এই আন্তর্জাতিক গণ আদালতে। ওই রোহিঙ্গা নারী রাজিয়াকে বলেছেন, বেশির ভাগ নারীকে জোর করে গ্রাম থেকে বাইরে বের করে জমায়েত করা হয়। এরপর তাদেরকে ধর্ষণ করা হয়।
এভাবে কমপক্ষে ৭০ জন নারী ও যুবতীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণের পর তাদের কাউকে ফেরত পাওয়া গেছে। কিন্তু সবচেয়ে নৃশংসতার যে সাক্ষ্য তিনি দিয়েছেন তাতে বলেছেন, তার বাড়ি লুয়াং ডন গ্রামে। সেখানে সেনাদের প্রবেশ করতে দেখে তিনি পালিয়ে যান। বাড়িতে ফেলে যান তার এক বোনকে। তিনি সবেমাত্র একটি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। সেই সন্তান ও বোনকে পিছনে ফেলে তিনি পালাতে বাধ্য হন।
এরপর যখন তিনি গ্রামে ফিরে গেছেন তখন তাদেরকে পেয়েছেন ঠিকই, কিন্তু মৃত অবস্থায়। তিনি দেখতে পেয়েছেন তার বোনের স্তন কেটে নেয়া হয়েছে। পাশেই একটি বালিশের ওপর তা রেখে দেয়া হয়েছে। একটি রাইফেল ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে তার গোপনাঙ্গে। ইউনিভার্সিটি মালয়া’র ল’ ফ্যাকাল্টিতে আয়োজিত পারমানেন্ট পিপলস ট্রাইব্যুনালে দ্বিতীয় দিনে দেয়া সাক্ষ্যে ওই নারী মঙ্গলবার এসব বর্ণনা দেন। ১৮ থেকে ২২শে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই শুনানি চলবে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা, কাচিন ও অন্যান্য গ্রুপের ওপর রাষ্ট্রীয় অপরাধ সংঘটনের ওপর এই শুনানি চলছে।
এতে বিচারক প্যানেলে আছেন আর্জেন্টিনার দানিয়েল ফেইয়েরস্টেনি, আয়ারল্যান্ডের ডেনিস হ্যালিডে, মালয়েশিয়ার জুলাইহা ইসমাল, কম্বোডিয়া-অস্ট্রেলিয়ার হেলেন জারভিস, অস্ট্রেলিয়ার গিল এইচ জোয়েরিঙ্গার, ইন্দোনেশিয়ার নুরসাভানি কাতজুসুঙ্ককানা, ভারতের বেলুর নারায়ণস্বামী শ্রীকৃষ্ণ, ইরানের শাদি সদর ও ইতালির নেলো রোসি। গত ১৮ই সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া
ওই শুনানিতে এরই মধ্যে অতিক্রম হয়েছে দু’দিন। এর মধ্যেই সাক্ষীরা যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তা গা শিউরে উঠার মতো। লুয়াং ডন গ্রামের ওই নারী রাজিয়া সুলতানাকে বলেছেন, তিনি যেসব নারীর সাক্ষাতকার নিয়েছেন তারা তাকে জানিয়েছেন, তাদের ১৬টি শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। অনেকেই নিখোঁজ। রাজিয়া সুলতানা বলেছেন, ওই নারীদের এসব শিশুর মধ্যে দু’জনকে আগুনে জীবন্ত পোড়ানো হয়েছে। অন্য একজনের গলা কেটে দেয়া হয়েছে।
অন্য আরেকজনকে মাটিতে ছুড়ে ফেলা হয়েছে। এতে শিশুটির ব্রেনে প্রচ- আঘাত লেগেছে। এখনও সে স্বাভাবিক হয় নি। কমপক্ষে ৭০ জন নারী ও যুবতীকে তখন ধর্ষণ করা হয়েছে। তাদেরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। তার আগে তাদেরকে একত্রিত করা হয়। রাজিয়া সুলতানা সাক্ষ্যে আরও বলেছেন, একদল সেনা সদস্য ইয়াই খাত চাউং সন গ্রাম থেকে ধর্ষণের উদ্দেশে টিনেজ মেয়েদের জোর করে ধরে নিয়ে যায়। এসব মেয়ের বয়স ১০ বা ১২ বছরের মধ্যে।
এরপর অভিভাবকদের সামনেই ৩০ জন সেনা সদস্য ও বেসামরিক পোশাকে থাকা কিছু লোক তাদেরকে ধর্ষণ করে। অভিভাবকদের এ দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয়। ওই টিনেজ মেয়েগুলোকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। প্রতিটি মেয়েকে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ জন নরপিশাচ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করেছে।
এরপর তাদের কাপড় কেটে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে। মেয়েগুলোর মুখের ভিতর একটি ছুরি ঢুকিয়ে দেয়া হয়, যাতে তারা চিৎকার করতে না পারেন। এরপর ক্যামেরার সামনে তাদেরকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এসব ঘটনা অস্বীকার করতে বাধ্য করা হয।
রাজিয়া সুলতানা তার সাক্ষ্যে বলেছেন, মেয়েগুলোকে একটি পুলিশ স্টেশনের মাঠের ভিতর হাজির করা হয়। তাদের দিকে তাক করে রাখা হয় বন্দুক। তাদেরকে এ অবস্থায় জিজ্ঞেস করা হয় তোমাদের বাড়িঘর কে পুড়িয়েছে? তারা কি আরএসও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন)? আরএসও কি তোমাদের পিতামাতা ও ভাইবোনদের হত্যা করেছে?
এ সময় ওই মেয়েগুলো জানতো তারা যদি এসব প্রশ্নের উত্তরে ‘না’ বলে তাহলে তাদেরকে হত্যা করা হবে। তাই তারা জবাবে বলেছে, আরএসও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। হত্যাকা- চালিয়েছে।
সাক্ষ্যে রাজিয়া সুলতানা আরো বললেন, জানুয়ারিতে মংডু হামলার ওপর গঠিত জাতীয় তদন্ত কমিটির অন্তর্বর্তী এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ধর্ষণ অভিযোগের পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায় নি। এই কমিটির নেতৃত্বে ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক সেনাপ্রধান মিন্ট শয়ে। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা সফর করেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিউর।
এতে প্রমাণ মেলে রাখাইন রাজ্যে ভয়াবহ সব অভিযোগের পর অভিযোগের প্রমাণ মিলছে। রাজিয়া বলেন, জবাবে ১০ই মার্চ মিয়ানমারের ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি নেতৃত্বাধীন সরকারের মুখপাত্র বলেছেন, রাখাইনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের যে অভিযোগ জাতিসংঘ করছে তা অতিরঞ্জিত। সাক্ষ্য দেয়ার সময় রাজিয়া সুলতানা মিয়ানমারের সরকারের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করতে কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক অবরোধ সহ সব রকম পদক্ষেপ ব্যবহারের আহ্বান জানান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমারের নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা সম্প্রতি মংডুতে যে নৃশংসতা ঘটিয়েছে তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে আমাদেরকে। রোহিঙ্গাদের ওপর যে পর্যায়ক্রমিক নিষ্পেষণ চলছে তার ইতি ঘটাতে হবে। আজও এই ট্রাইব্যুনালে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। চলবে আগামী শুক্রবার পর্যন্ত।