এটি একটি রাশিয়ার রূপকথা। একটি ছোট্ট মেয়ে তার ভাইকে কীভাবে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে, সেই কাহিনি লেখা আছে এই রূপকথায়।
“মা-মণি,” মা তার মেয়েকে বলল, “আমরা কাজে যাচ্ছি। তোমার ছোট্ট ভাইটিকে দেখ। তুমি খুব ভালো মেয়ে, তাই না? ঘরের বাইরে যাবে না। ফেরার সময় আমরা তোমার জন্য একটি নতুন পুতুল নিয়ে আসব।”
বাবা-মা দুজনই বেরিয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটি তার মায়ের উপদেশ ভুলে গেল। সে তার ভাইকে জানালার পাশে বসিয়ে ঘরের বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে লাগল।
হঠাৎ এক ঝাঁক রাজহংসী জানালার পাশে এসে নামল। তারা ছেলেটিকে পাখায় তুলে নিয়ে চলে গেল। মেয়েটি ফিরে এসে দেখল, তার ছোট্ট ভাইটি নেই। এ কী! কোথায় গেল? গেল কোথায়?
সে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করল। খুঁজল চারদিকে। কিন্তু না, কোথাও নেই! মেয়েটি কান্নাকাটি শুরু করে দিল আর চিৎকার করে ভাইকে ডাকতে লাগল। একসময় সে খোলা মাঠে ভাইয়ের খোঁজে দৌড়াতে লাগল। দূরে কতগুলো রাজহাঁস উড়ে যাচ্ছিল। সেগুলো যাচ্ছিল অন্ধকার বনের দিকে। মেয়েটি নিশ্চিত হল, এই রাজহাঁসগুলোই তার ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে। সে আগেই জেনেছিল, রাজহাঁসেরা সুযোগ পেলেই ছোট্ট বাচ্চাদের চুরি করে নিয়ে যায়।
তাই পাখিগুলোর পেছন পেছন সেও ছুটল।
ছুটছে…
ছুটছে…
ছুটছে!
ছুটতে ছুটতে সে এসে থামল এক বিরাট আগুনের চুল্লির সামনে। সেই চুলার উপর ছিল রাই দিয়ে বানানো একটি রুটি।
মেয়েটি চুলাকে জিজ্ঞেস করল, “চুলা, চুলা, রাজহাঁসগুলো কোথায় উড়ে গেল তা বলতে পারবে?”
চুলা বলল, “আমার কাছ থেকে এক টুকরো রুটি খাও। তারপর বলব তোমাকে।”
“কী? আমি রাই দিয়ে বানানো রুটি খাব? বাবার দেওয়া গমের রুটিই আমি খাই না।”
চুলা তাকে কিছুই বলল না।
মেয়েটি আবার ছুটল। সামনে পড়ল একটা বুনো আপেলগাছ। মেয়েটি অস্থির হয়ে গাছকে বলল, “আপেলগাছ, আপেলগাছ, রাজহাঁসগুলো কোথায় উড়ে গেল আমাকে বলতে পার?”
“আমার কাছ থেকে একটি বুনো আপেল খাও।” আপেলগাছ বলল।
“আমাদের নিজেদের বাগানের আপেলই খাই না আমি! আমি যাব ঐ বুনো আপেল খেতে!”
আপেলগাছও তাকে কিছু বলল না।
মেয়েটি আবার দৌড়াতে লাগল। এবার সে গিয়ে পৌঁছল একটি নদীর কাছে। সেই নদী দুধের নদী। তার দুই তীর মাখন দিয়ে বাঁধানো।
সে নদীকে বলল, “নদী, নদী, রাজহাঁসগুলো কোথায় উড়ে গেল আমাকে বলবে?”
“আমার কাছ থেকে তুমি মাখন ও দুধ খাও, তবে তোমাকে আমি বলব।”
“বাবার মেখে দেওয়া জেলি-দুধই আমি খাই না। আর আমি কিনা তোমার বুকের দুধ আর পাড়ের মাখন খেতে যাব।”
নদীও তাকে কিছু বলল না।
মেয়েটি সারাদিন মাঠে, বনে-বাদাড়ে ছুটে বেড়াল। সন্ধ্যা হয়ে গেল। কিন্তু ভাইয়ের কোনো সন্ধানই সে করতে পারল না। হঠাৎ তার নজরে পড়ল একটা ছোট্ট কাঠের ঘর। সেই ঘরে আছে ছোট্ট একটি জানালা। সে ঘুরে ঘুরে দেখল ঘরের চারপাশ। জানলা দিয়ে উঁকি দিল মেয়েটি। দেখল, ঘরের ভেতর এক ডাইনিবুড়ি। বুড়ি বসে বসে চরকায় সুতো কাটছে। পাশে একটি টুল। আর সেই টুলে কিনা তার ছোট্ট ভাইটি বসে আছে। সে একটি রুপোলি আপেল নিয়ে খেলছে।
মেয়েটি ঘরে ঢুকল। ঢুকেই ঠোঁটে আঙুল রেখে ভাইকে চুপ থাকতে ইশারা করল। তারপর বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “শুভেচ্ছা, বুড়িমা!”
“শুভেচ্ছা!” ডাইনি বলল, “তুমি এখানে কেন এসেছ?”
“আমার ফ্রকটা ভিজে গেছে। সেটা শুকোতে এলাম।” বলল মেয়েটি।
“ঠিক আছে, বস।” ডাইনিবুড়ি বলল, “চরকায় একটু সুতো কেটে দাও।” ডাইনি বুড়ি তাকে সুতো কাটার মাকু ধরিয়ে দিল। তারপর চলে গেল বাইরে।
মেয়েটি বসে বসে সুতো কাটছে। ভাইটি তার কথামতোই চুপ করে বসে আছে। হঠাৎ একটা ইঁদুর সেখানে এল। মেয়েটিকে বলল, “এই মেয়ে, আমাকে একটু খাওয়াবে? আমি তোমাকে খুব একটা দরকারি কথা বলব।”
মেয়েটি তাকে খেতে দিল।
খাওয়া শেষ করে ইঁদুরটি চুপিচুপি বলল, “ডাইনিবুড়ি রান্নাঘরে আগুন জ্বালাতে গেছে। সে তোমাকে ধুয়ে রান্না করবে। তোমাকে রোস্ট বানিয়ে খাবে। তারপর তোমার হাড়গোড় ঝুলিয়ে রাখবে।”
এ কথা শুনে মেয়েটি খুব ভয় পেল। একেবারেই কেঁদেই দিল।
ইঁদুরটি বলল, “কেঁদো না। তুমি তোমার ভাইকে নিয়ে এক্ষুণি পালিয়ে যাও। আমি তোমার হয়ে সুতো কেটে দিচ্ছি। তুমি যাও! তাড়াতাড়ি।”
দেরি না করে মেয়েটি তার ভাইকে কোলে তুলে নিল। তারপর ঘর থেকে বের হয়ে ছুটতে লাগল।
ডাইনিবুড়ি জানালার পাশে এসে জিজ্ঞেস করল, “এই মেয়ে। তুমি সুতো কাটছ?”
ভেতর থেকে ইঁদুর জবাব দিল “হ্যাঁ, কাটছি বুড়িমা।”
ডাইনিবুড়ি চুলোয় আগুন জ্বালিয়ে মেয়েটিকে নিতে এল। কিন্তু এ কী! ঘর তো খালি। ডাইনি চিৎকার করে উঠল, “উড়ে যাও রাজহাঁসেরা, মেয়েটি তার ছোট্টভাইকে নিয়ে পালিয়েছে।”
ছুটতে ছুটতে মেয়েটি দুধনদীর কাছে চলে এল। ততক্ষণে রাজহাঁসগুলো মেয়েটিকে দেখে ফেলেছে। তারা পেছন পেছন ছুটতে লাগল। মেয়েটি কেঁদে কেঁদে নদীকে বলল, “নদী, নদী, আমাদের একটু লুকিয়ে রাখো।”
নদী বলল “আমার কাছ থেকে একটু মাখন ও দুধ খাও।”
মেয়েটি চটপট একটু মাখন আর দুধ খেয়ে নিল। নদীও তখন মেয়েটিকে মাখন ও দুধের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল।
রাজহাঁসগুলো তাদের দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল।
ছোট্ট মেয়েটি আবার দৌড়াতে শুরু করল। রাজহাঁসগুলোও ঠিক তক্ষুণি ছোট্ট ভাইসহ মেয়েটিকে দৌড়ে যেতে দেখে ফেলল। রাজহাঁসগুলো আবার ওদের পেছনে ছুটল। মেয়েটি এবার ছুটে গেল আপেলগাছের কাছে, “আপেলগাছ, আপেলগাছ, আমাকে লুকিয়ে ফেলতে পারবে?”
“আমার একটি বুনো আপেল খাও।”
ছোট্ট মেয়েটি চট করে একটা আপেল খেয়ে নিল। আপেলগাছ এবার ছোট্টভাইসহ মেয়েটিকে ডালপালা দিয়ে ঢেকে ফেলল।
রাজহাঁসগুলো তাদের দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে গেল।
মেয়েটি আবার তার ছোট্টভাইকে তুলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। যখন তারা প্রায় বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেল, তখনই রাজহাঁসগুলো আবার তাদের দেখতে পেল। রাজহাঁসগুলো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করল, পাখা ঝাপটাল। হঠাৎ মেয়েটির কোল থেকে তার ভাইটি পড়ে গেল। কিন্তু তা কেবল মুহ‚র্তের জন্য। সে আবার ভাইকে নিয়ে দৌড়ে সেই চুলার কাছে এসে পড়ল। “চুলা, চুলা, আমাকে তুমি লুকিয়ে ফেলতে পারবে?”
“আমার কাছ থেকে একটা রাইয়ের রুটি খাও।”
ছোট্ট মেয়েটি গপ করে একটি রুটি মুখে পুরল। তারপর তার ভাইকে নিয়ে একটু নিচু হয়ে চুলার ভেতর ঢুকে পড়ল।
রাজহাঁসগুলো চুলার চারপাশে চক্কর দিল। চিৎকার চেঁচামেচি করল। কিন্তু কোনো ফল হল না। হাঁসগুলো ছোট্টভাইসহ মেয়েটিকে আর দেখতে পেল না। শেষমেশ তারা ডাইনিবুড়ির কাছে ফিরে গেল।
ছোট্ট মেয়েটি চুলাকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার ভাইকে নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটে গেল। বাবা-মা ঘরে ফেরার আগেই তারা পৌঁছে গেল।