রুদ্র মিজান এমন ভোট আগে কখনো দেখেনি সিলেট। অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অবাধে ব্যালটে সিল, জালভোট, কেন্দ্র দখল, সহিংসতা কোনো কিছু থেকেই বাদ যায়নি। ভোটের আগের রাত থেকেই গুঞ্জন ছিল ব্যালটে সিল দিয়ে বাক্স ভরা হচ্ছে। সকালে কিছু কিছু কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতির চেয়ে প্রয়োগকৃত ভোটের সংখ্যা ছিল রহস্যজনকভাবে বেশি। নানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সিলেট-১ আসনের প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে নানা অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এমনকি বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রধান ফটকে তালা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা
ব্যালটে সিল দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। দুপুর ১২টায় মেজরটিলার দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বাইরে জড়ো হয়ে আছেন যুবকরা।
ভোটকেন্দ্রের প্রধান ফটকে তালা। ভেতরে একজন পুলিশ সদস্য। জানালেন, বাইরে সংঘর্ষের কারণে ফটক বন্ধ। ভেতরে সাংবাদিকও যেতে পারবেন না। প্রিজাইডিং কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাইলে, তাকে ডেকে আনা হয়। ইতিমধ্যে দেখা গেল কেন্দ্রের ভেতরে ১৫-২০ যুবক। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা মো. শাহীদ আলী জানান, তারা ভোটার। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে বাইরের ভোটারদের কেন্দ্রের ভেতরে যেতে দিচ্ছেন না। কিছুক্ষণ আগে এখানে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
দীর্ঘ এক ঘণ্টা সেখানে দাঁড়িয়ে দেখা গেছে ১৫-২০ যুবকের একজনেরও ভোট দেয়া সম্পন্ন হয়নি। তারা কেউ বাইরে বের হচ্ছেন না। এ বিষয়ে কথা বলার একপর্যায়ে নৌকার ব্যাজ পরিহিত কয়েক যুবক বুথ থেকে বের হলেও ফটকের বাইরে বের হননি। তখন বাইরে সাধারণ ভোটাররা সারি বেঁধে দাঁড়ালেও তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না। এসব কারণে ভোটার ও বিএনপি নেতাকর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। বিএনপি কর্মীরা জানান, পুলিশ ও আওয়ামী লীগ এক হয়ে তাদের ওপর হামলা করেছে। বাধ্য হয়ে তারা ভোটকেন্দ্র ছেড়ে চলে যান।
ষাট বছর বয়সী ভোটার গুলজার উন নেসা চৌধুরী জানান, দীর্ঘদিন পর জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেয়ার সুযোগ পেয়ে কেন্দ্রে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন তিনি। কেন্দ্রে ঢুকে জানতে পেরেছেন, তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। একই কায়দায় দখল করা হয় নগরীর কাজলশাহ এলাকার রাধা রাণী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, গৌছ উদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাসদবির সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দারুস সালাম, হলি সিটি, শাহ মীর প্রাথমিক বিদ্যালয়, খাদিমপাড়ার জাহানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রসহ অর্ধশতাধিক কেন্দ্র। এরমধ্যে এমসি কলেজসহ বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে বিএনপির কোনো এজেন্টই ছিলো না। সাধারণ কোনো ভোটারকে এসব কেন্দ্রে যেতে না দেখলেও ভোট সম্পন্ন হয়েছে দ্রুত গতিতে। সকাল ১১টার পর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় নগরীর শিবগঞ্জের স্কলার্স হোম কেন্দ্রে। স্থানীয় কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ সকাল ১১টায় ওই ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। তিনি বের হয়ে যেতেই ভোটারদের ওপর হামলা চালায় ৩০ জনের একটি সশস্ত্র দল।
এ সময় ভোটাররা পাল্টা ধাওয়া করলে হামলাকারীরা কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। থেমে থেমে সংঘর্ষ হয় দীর্ঘ সময়। সংঘর্ষের পর কেন্দ্রের বাইরে দফায় দফায় মিছিল করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। হামলার পর ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইলে প্রিজাইডিং অফিসার আমিন মোহাম্মদ সাইদ মানবজমিন-এর প্রতিবেদকসহ দুইজন সাংবাদিককে ভেতরে নিয়ে যেতে চাইলেও দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা বাধা দেন। তিনি একটু পরে যেতে বলেন। প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জানান, সকাল ১১টা পর্যন্ত এই কেন্দ্রে ৫০ ভাগ ভোট প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল থেকে সাধারণ ভোটারদের বাধা দেয়ায় ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। নগরীর বন্দরবাজারের দুর্গাকুমার পাঠশালায় সকাল পৌনে ১১টায় প্রিজাইডিং কর্মকর্তা জানান, ১৪শ’ ভোট প্রয়োগ হয়েছে। যদিও ভোটার উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য ছিল না। ওই কেন্দ্রের মোট ভোটার ২ হাজার ৮৫৫।
সকালেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে সিলেট। খাদিম পাড়ায় আলামিন জামেয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকাল সাড়ে ১০টায় ধানের শীষের এজেন্টদের জোর করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়। পুনরায় কেন্দ্রে প্রবেশের চেষ্টা করলে সশস্ত্র অবস্থায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীরা হামলা চালায় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর। একপর্যায়ে দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হলে হান্নান নামে এক যুবলীগ নেতা শটগান দিয়ে গুলিবর্ষণ করেন। এ ছাড়াও বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটে। এ সময় যুবদল নেতা কামাল আহমদ আহত হন। আশপাশে পুলিশ থাকলেও এ সময় তারা নিস্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে বলে অভিযোগ করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
শাহ মীর প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটারদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছিলো সকাল থেকেই। খবর পেয়ে ছুটে যান সাংবাদিকরা। সেখানে একটি কক্ষের দরজা খুলতেই মেঝেতে ব্যালট বাক্স ও এলোমেলোভাবে ব্যালট ও সিল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
দুপুরে শেখঘাটের মুক বধির স্কুল কেন্দ্রে জোর করে ব্যালট বক্স নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। পরবর্তীতে বাক্স পরিবর্তন করে ব্যালট ভর্তি একটি বাক্স রেখে যায় তারা। প্রতিবাদ করলে লাঞ্ছনার শিকার হন কেন্দ্রের ধানের শীষের এজেন্টরা। খবর পেয়ে ধানের শীষের প্রার্থীর প্রধান এজেন্ট জাকির চৌধুরী ও বিএনপি নেতা মিফতাহ সিদ্দিকী সেখানে ছুটে গেলে তাদের ওপর হামলা করা হয়। হামলায় গুরুতর আহত হন পারভেজ খন্দকার, কয়েস আহমদসহ বেশ কয়েকজন।
বিএনপি মনোনীত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী খন্দকার আবদুল মুক্তাদির অভিযোগ করেছেন, প্রতিটি কেন্দ্রে নানাভাবে অনিয়ম করা হয়েছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ কেন্দ্রে ভোট শুরুর আগেই ভোট দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রগুলো থেকে এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে ১২টার মধ্যেই।
তবে বিএনপির এসব অভিযোগ সত্য না বলে দাবি করেছেন, তেমন কোনো সমস্যা কোথাও হয়নি। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। সিলেট সিটি করপোরেশন ও সিলেট সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত মর্যাদাপূর্ণ সিলেট-১ আসনের মোট ভোটার ৫ লাখ ৪২ হাজার ৯৩৬ জন। পুরুষ ২ লাখ ৮৮ হাজার ৫২৮ জন ও মহিলা ২ লাখ ৫৪ হাজার ৪০৮ জন। সিটি করপোরেশন ও আটটি ইউনিয়নের এই আসনে ভোটকেন্দ্র ২১৫টি ও ভোটকক্ষ ১ হাজার ৭৭টি। বিভিন্ন দল থেকে এই আসনে প্রার্থী হয়েছেন ১০ জন। তারা হচ্ছেন, বিএনপির ধানের শীষের প্রতীকের খন্দকার আবদুল মুক্তাদির, আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ড. একে আবদুল মোমেন, সমাজতান্ত্রিক দল বাসদের মই প্রতীকের প্রণব জ্যোতি পাল, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের মাহবুবুর রহমান চৌধুরী, ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকের রেজওয়ানুল হক চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কোদাল প্রতীকের উজ্জ্বল রায়, মুসলিম লীগের হারিকেন প্রতীকের আনোয়ার উদ্দিন বুরহানবাদী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের বটগাছ প্রতীকের নাসির উদ্দিন, ইসলামী ঐক্যজোটের মিনার প্রতীকের ফয়জুল হক, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির আম প্রতীকের ইউসুফ আহমদ।