গত ১৫ জানুয়ারি ব্রিটেনের হাউস অব কমন্সে ব্রেক্সিট চুক্তিটি নাকচ হয়ে গেছে। কিন্তু পরবর্তী আস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে টিকে গেছেন। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ব্রেক্সিট চুক্তিটির অবস্থা কী হবে?
২০১৬ সালের জুন মাসে অনাহূত এক গণভোটের আয়োজন করে কনজারভেটিভ দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুন এমন এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে ব্রিটেনের জনগণের মধ্যে ব্যাপক কোনও গণঅসন্তোষ ছিল না। ইউনিয়ন গঠনের পর কম উন্নত ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো থেকে চাকরির সন্ধানে মানুষ আসা আরম্ভ করে ব্রিটেনে। ব্রিটেনের মানুষ ইউরোপীয়দের সঙ্গে কখনও মিলে মিশে থাকেনি। যদিওবা ব্রিটেনও ইউরোপেরই একটা রাষ্ট্র। নবাগত মানুষদের সঙ্গে মিশে থাকতে তাদের অসুবিধা ব্যাপক বড় কোনও সমস্যা ছিল না।
অবশ্য ব্রিটেনের লোকেরা তাদের পূর্ববর্তী উপনিবেশসমূহের মানুষ, বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশের মানুষের সঙ্গ বেশি ভালোবাসে। ক্যামেরুন ২০১৬ সালে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কী থাকবে না তা জানতে চেয়ে গণভোট দিয়েছিলেন। গণভোটে মানুষ ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে ভোট দেয়। এ ভোটটা এত সমস্যা সৃষ্টি করেছে যে শুধু পুনরায় ইউরোপ খণ্ড-বিখণ্ড হবে তা নয়, ব্রিটেনও ভেঙে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে।
স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী নেতা নিকোলা স্টারজেন ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। ব্রিটেনের লোক যদি ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে থেকে যায় তবে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীরা পুনরায় স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার পক্ষে গণভোট চাইবে।
কারণ, তাদের ইচ্ছে তারা প্রয়োজনে স্কটল্যান্ডকে স্বাধীন করে হলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকতে ইচ্ছুক। গতবারের গণভোটে স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদীরা পরাজিত হয়েছিল। স্কটল্যান্ড ১৭০৭ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের অংশ ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে স্কটল্যান্ডের ক্ষমতাশালীরা এতই দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে পড়েছিল যে, স্কটল্যান্ডের লোকজন টিকে থাকার জন্য ব্রিটেনের সঙ্গে যুক্তরাজ্য গঠন করেছিলো।
সপ্তদশ শতাব্দীতে তারা পানামায় উপনিবেশ স্থাপন করতে গিয়ে ব্যর্থ হয় এবং আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। ব্রিটেনের সঙ্গে এক হওয়া ছাড়া তাদের উপায় ছিল না। এক হওয়ার পর তারা ব্রিটেনের বিরাট সাম্রাজ্য তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সুযোগ পায়। ওয়েলস ১৫৩৬ সালেই যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আয়্যারল্যান্ড ছিল ব্রিটেনের উপনিবেশ। আয়্যারল্যান্ডকেও ব্রিটেন তার যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের জনগণ তা মানেনি। বছরের পর পর আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। ১৯৪৮ সালে জাতীয়তাবাদী নেত্রী ডি ভেলারার হাতে ২৬টি জেলা ছেড়ে দিয়ে স্বাধীনতা প্রদান করে অবশিষ্ট ৬টি জেলা ব্রিটেন রেখে দেয়। এ ছয় জেলায় লন্ডন থেকে যাওয়া লোকের বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বেশি ছিল। তাকেই এখন উত্তর আয়ারল্যান্ড বলা হয়।
শিল্প বিপ্লবের পর সমগ্র বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ এলাকা ব্রিটেনের নিয়ন্ত্রণে আসে। ব্রিটেনের সেই জৌলুস এখন আর অবশিষ্ট নেই। ওয়াটার লুর যুদ্ধে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ানকে পরাজিত করে গ্রেফতার করে সেন্ট হেলেনায় বেঁধে রেখেছিল, সেখানেই ব্রিটেনের বন্দি হিসেবে নেপোলিয়ানের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর বহু বছর পর তার মৃতদেহ সেন্ট হেলেনার কবর খুঁড়ে ফ্রান্সের সরকার প্যারিসে নিয়ে গিয়েছিল। তার মৃতদেহ অবিকৃত ছিল। ফরাসি সরকার বলেছে, নেপোলিয়ানকে ব্রিটিশ সরকার খাদ্যে ফরমালিন নামক বিষ মিশিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। ফরমালিনের প্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু হলে নাকি মৃত্যুর পর লাশ অবিকৃত থাকে। তাদের এত গৌরব তারা বিস্মৃত হয় কীভাবে?
তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ২৭ দেশে এক মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে তখন কিন্তু ব্রিটেন এক মুদ্রা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়নি। একটা জাতির পৃথক মুদ্রা না থাকাকে তারা জাতীয় অপমান হিসেবে বিবেচনা করেছে। যাহোক, সবকিছু বিবেচনায় নিলে ব্রিটেনের জনগণ অবস্থার চাপে একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও কখনও উৎফুল্লবোধ করবে না।
ব্রেক্সিট নিয়ে থেরেসা মে নতুন করে পার্লামেন্টে একটা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। আদ্যোপান্ত পাঠ করলে এ প্রস্তাব পুরানো প্রস্তাবের চেয়ে উত্তম কিছু নয়। অন্যদিকে বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিনও ভিন্ন একটা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। এখন হবে দুই প্রস্তাবের চুলচেরা বিশ্লেষণ। গত ২১ জানুয়ারি সোমবার প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে তার নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তিনি দ্বিতীয় প্রস্তাবের নাম দিয়েছেন প্ল্যান বি। তিনি আবার চুক্তিহীন ব্রেক্সিটের কথাও বলেছেন।
১৫ জানুয়ারি থেরেসা মে’র উত্থাপিত প্রস্তাবটি সত্যিকার অর্থে তার প্রস্তাব নয়। প্রস্তাবটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুশাবিদা মতো প্রণয়ন করা হয়েছিল। থেরেসা মে ব্রেক্সিটের যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ এবং ইউরোপীয় আদালতের এখতিয়ার থেকে যুক্তরাজ্যকে বের করে আনার বাইরে বলতে গেলে আর তেমন কিছুই ছিল না।
থেরেসা মে যেভাবে ব্রেক্সিট ঘটাতে চান তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মাঝে কার্যকর বিচ্ছিন্নতা দেখা দেবে এবং উভয় পক্ষের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর বলা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে সুসম্পর্ক অব্যাহত থাকবে। কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা চাচ্ছেন সে বিষয়টা লিখিত আকারে হোক কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার আগে তারা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কোনও লিখিত চুক্তি করবে না।
ব্রেক্সিট প্রশ্নে যুক্তরাজ্য গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে আর এত কঠিন সংকটে পড়েনি। কোন প্রক্রিয়ায় যুক্তরাজ্য আলাদা হবে এবং ইউনিয়নের ২৭টি রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কেমন হবে তার জন্য ২১ মাস সময় প্রদান করা হয়েছিল। এ ২১ মাসের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। ভোটে পরাজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বিকল্প পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছেন খুবই গুরুতরভাবে কিন্তু কোনও অগ্রগতি এখনও হয়নি। লেবার পার্টি চুক্তিবিহীন ব্রেক্সিট কার্যকর করার পক্ষে নয় বরং তারা এর চেয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত থাকার পক্ষে।
রানি সাধারণত কখনও কোনও রাজনৈতিক বিষয়ে মুখ খোলেন না। কিন্তু রানিও এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে গিয়ে সব পক্ষকে সমঝোতায় পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এখন এ বিষয়টা নিয়ে ব্রিটিশ জাতি দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে।
এ বিভক্তি যুক্তরাজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেরতে পারে। দ্বিধাবিভক্ত পক্ষের মাঝে এক পক্ষ বলছে তারা ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে সার্বিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আবার অন্যপক্ষ বলছে যুক্তরাজ্য বের হয়ে গেলে ব্রিটেনে অভিবাসীর চাপ কমবে। ইউনিয়নের বিভিন্ন তহবিলে চাঁদা দেওয়া বন্ধ হবে। এবং সেটা সরকারের ব্যয় সংকোচনে বিরাট সহায়ক হবে।
ব্রেক্সিট নিয়ে তর্ক তো দীর্ঘদিন চলতে পারে না। এখন ব্রিটেনের সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উচিত আলাপ-আলোচনা করে একটা সমঝোতায় পৌঁছা। এ সংকটের সমাধান হওয়া প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টও বলেছেন ঝামেলার দ্রুত অবসান করতে হলে যুক্তরাজ্যের উচিত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থেকে যাওয়া।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।