আর্ন্তজাতিক নিউজ ডেস্ক: ‘প্রতিদিনই শত শত বেসামরিক লোককে হত্যা করা হতো। শহরের এমন কোনো স্থান ছিল না, যেখানে লাশ ছিল না। লাশের গন্ধে সব সময় পেট ফুলে থাকতো। ৮/১০ বছরের মেয়েরাও ধর্ষণের হাত থেকে রেহাই পেতো না। বাসা থেকে মেয়েদের তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। অনেক সময় বাবা-ভাইয়ের চোখের সামনেই তাদের ধর্ষণ করা হতো।’
মিনি ভট্রিন নামে এক মার্কিন নাগরিকের বর্ণনায় নানকিংয়ে জাপানি বাহিনীর নিষ্ঠুরতার এই চিত্র উঠে এসেছে। সে সময় নানকিনের জিনলিং উইমেন কলেজের ডিন ছিলেন তিনি। ১৯৩৭ সালের ১৩ ডিসেম্বরে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়।
এ সময় জাপান চীনের তৎকালীন রাজধানী নানকিং (বর্তমান নাম নানজিং) দখল করে নেয়। সেদিন থেকে শুরু করে ছয় সপ্তাহের ব্যবধানে নানকিংয়ে জাপানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও ব্যাপক ধর্ষণ ইতিহাসে ‘নানকিন গণহত্যা’ বা ‘দ্য রেপ অব নানকিন’ নামে পরিচিত। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে স্বল্পতম সময়ে সংঘটিত সবচেয়ে ভয়াবহতম ও জঘন্যতম হত্যা ও ধর্ষণ অধ্যায়। এই সময়ে জাপানি বাহিনী প্রায় ৩ লাখ বেসামরিক ও নিরস্ত্র লোককে হত্যা করে। ধর্ষণ করে কয়েক লাখ শিশু, কিশোরী, তরুণী এমনকি বৃদ্ধাকেও। পাশাপাশি চালায় লুটতরাজ।
যুদ্ধের প্রথম দিন ১৩ ডিসেম্বর প্রায় ৩০ জন সৈন্য নানচিং-এর দক্ষিণ-পূর্ব অংশে হসিং লু কুতে একটি চীনা বাড়িতে আসে এবং ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ দাবি করে। হা নামের একজন মোহাম্মেদান দরজা খোলেন। তারা তৎক্ষণাৎ একটি রিভলভার দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর পর মিসেস হা তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসেন এবং আর কাউকে হত্যা না করার জন্য অনুরোধ করেন। মিসেস হা তাদের কাছে জানতে চান যে, কেন তারা তাঁর স্বামীকে মেরেছে। তারা তাঁকে গুলি করে। মিসেস হসিয়াকে গেস্ট হলের একটি টেবিলের নিচ থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করা হয় যেখানে তিনি তাঁর ১ বছরের বাচ্চাকে নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁকে নগ্ন করার পর এবং এক বা একাধিক সৈন্য তাঁকে ধর্ষণ করার পরে তাঁর বুকে বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তাঁর যোনির মধ্যে একটি বোতল ঢুকিয়ে দেয়া হয়। শিশুটিকে বেয়োনেট দিয়ে হত্যা করা হয়।
এরপর কিছু সৈন্য পরের কক্ষে যায়, যেখানে মিসেস হসিয়ার বয়স্ক পিতা-মাতা এবং ১৬ ও ১৪ বছর বয়সী দুই মেয়ে ছিলেন। সৈন্যরা তাদেরকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হলে তাদের নানি তাদেরকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। সৈন্যরা একটি রিভলভার দিয়ে তাঁকে হত্যা করে। তাঁর স্বামী স্ত্রী দেহ আঁকড়ে ধরেন এবং তাঁকেও হত্যা করা হয়। এরপর মেয়ে দুইটিকে নগ্ন করা হয়; বড়টিকে ২–৩ জন এবং ছোটটিকে ৩ জন ধর্ষণ করে। বড় মেয়েটিকে এরপর বেয়োনেট দিয়ে আঘাত করা হয় এবং তার যোনিতে একটি বেত প্রবেশ করানো হয়। ছোট মেয়েটিকেও বেয়োনেটবিদ্ধ করা হয় কিন্তু তার মা ও বোনের সঙ্গে যে ভয়ানক আচরণ করা হয়েছে তা থেকে তাকে রেহাই দেয়া হয়। এরপর সৈন্যরা ঐ কক্ষে থাকা ৭–৮ বছর বয়সী আরেক বোনকে বেয়োনেটবিদ্ধ করে।
বাড়িটির শেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় হা-এর যথাক্রমে ৪ ও ২ বছর বয়সী দুই ছেলে। বড়টিকে বেয়োনেটবিদ্ধ করা হয় এবং ছোটটির মাথা তরবারি দিয়ে কেটে ফেলা হয়। চ্যাং ঝি কিয়াং। তখন তার বয়স ছিল নয় বছর। সে তার মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। পথে তাদেরকে আটকে ফেলে সৈন্যরা। তার মাকে ধর্ষণ করতে চায়। কিয়াং বাধা দিলে তাকে ধরে ছুড়ে ফেলে দেয়। তার মাকে বিবস্ত্র হতে বলে। কিয়াংয়ের মা তা না করলে তাকে স্তনে বায়োনেট দিয়ে সজোরে আঘাত করে। এতে তার মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মৃত ভেবে সৈন্যরা চলে যায়। কিয়াং এবার গিয়ে তার মাকে ডেকে তোলার চেষ্টা করে। তার বুকের ক্ষত পরিমাপ করতে বস্ত্র সরাতেই ক্ষুধার্ত ছোট ভাইটি মায়ের স্তনে মুখ দেয়। কিন্তু তার মুখ ভরে ওঠে রক্তে। ততক্ষণে তার মা সত্যিই না ফেরার দেশে চলে গেছে। ঝ্যাং জিউ হংয়ের বয়স তখন ১২ বছর ছিল। তার বাবা-মা কিছুদিন আগেই প্রাণ হারিয়েছে সৈন্যদের হাতে। সৈন্যরা তাদের বাসায় এসে তাকে নিয়ে যেতে চায়। তার দাদা বাধা দিলে তাকে হত্যার হুমকি দেয়। তবু হংকে ছাড়তে চান না তার দাদা। তিনি বলেন, ‘উৎসর্গ হওয়ার মতো বয়স এখনো তোমার হয়নি।’
তবে হং জানে সৈন্যদের সঙ্গে না গেলে সে ও দাদা দুজনকেই প্রাণ হারাতে হবে। এর চেয়ে একজনের প্রাণ যাওয়াই ভালো। দাদার বাধা সত্ত্বেও সে সৈন্যদের সঙ্গে যায়। সৈন্যরা পাশের কক্ষে নিয়ে তাকে পাশবিকভাবে ধর্ষণ করে। ধর্ষণ শেষে অজ্ঞান হংকে সৈন্যরা রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে যায়। মাত্র ৪২ দিনে চ্যাং ঝি কিয়াং ও ঝ্যাং জিউ হংয়ের মতো লাখো মানুষ তৎকালীন বর্বর জাপানি বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়। ওয়াং ওয়েন য়ুর বয়স তখন ছিল ১৭। তিনি বলেন, ‘আমাদের ঘরবাড়ি সবকিছু আগেই জাপানি বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এরপর যখন তারা নানকিং দখল করল, তখন থেকে শুরু হলো অমানুষিক নির্যাতন। আমার চরম সৌভাগ্য যে আমি মৃত্যুকে এড়াতে সক্ষম হয়েছিলাম। ওরা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘শহরের এখানে-সেখানে লাশ পড়ে থাকত। আমি এক আত্মীয়ের সঙ্গে নানকিং ছাড়তে সক্ষম হই। আমরা পালিয়ে যাওয়ার সময় যখনই দেখতাম জাপানি সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, আমরা লাশের সঙ্গে শুয়ে পড়তাম। তারা আমাদেরকে লাশ ভেবে চলে যেত। এত লাশ ছিল যে, তার সঙ্গে মিশে থাকলে বোঝার উপায় ছিল না।’ এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কয়েকটি দূতাবাসের চেষ্টায় একটি ‘সেফ জোন’ গড়ে তোলা হয়। সেখানে আশ্রয় নেওয়াদের বেশির ভাগই ছিল নারী ও শিশু। তবে সেখানেও চীনা সৈন্যদের খুঁজে বের করার নামে ‘সেফ জোন’ তছনছ করে ফেলে জাপানি সৈন্যরা।
জর্জ ফিচ নানকিনে তখন মিশনারির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘নানকিং মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছিল। মানুষের পালানোর মতো জায়গা ছিল না। চোখের সামনে আমি বহু বেসামরিক লোককে হত্যা করতে দেখেছি। গুলি করে হত্যার পাশাপাশি বহু মানুষকে শিরশ্ছেদও করা হয়েছে।’
নানকিং দখলের আগে নৌবাহিনীর সহায়তায় সাংহাই দখল করে জাপানি বাহিনী। এরপর তারা নানকিন দখল করতে অগ্রসর হয়। সে সময় সৈন্যদের সঙ্গে থাকা এক জাপানি সাংবাদিক বলেন, ‘১০ম আর্মি নানকিং দখল করার জন্য খুব দ্রুত এ জন্য এগেচ্ছিল যে, সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের মাঝে এই ধারণা ছিল, তারা সেখানে ইচ্ছেমতো লুট ও ধর্ষণ করতে পারবে।’
জাপানি ঔপন্যাসিক তাৎসুজো ইশিকাওয়া তার ‘ইকিতেইরু হেইতেই’ (বেঁচে থাকা সৈন্যরা) উপন্যাসে নানকিনে জাপানি সৈন্যদের ভয়াবহ অত্যাচারের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি ১৯৩৮ সালের জানুয়ারিতে জাপানি সৈন্যদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উপন্যাসটি রচনা করেন।
নানকিনে জাপানি সৈন্যদের নিষ্পেষণ কতটা ভয়াবহ ছিল, তা ফুটে উঠেছে সেই সময় জাপানি ভাষার পত্রিকা ‘টোকিও নিচি নিচি শিম্বুন’ ও জাপানি ইংরেজি ভাষার পত্রিকা ‘জাপান অ্যাডভারটাইজার’ এ। পত্রিকা দুটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘দুজন জাপানি সৈন্য এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে- কে আগে শুধু তরবারি দিয়ে ১০০ লোককে হত্যা করতে পারে।’ নানকিনে জাপানি বাহিনীর বর্বরতা এতোটাই নির্মম ছিল যে, তার জের ধরে আজও জাপানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারেনি চীন।