মে দিবস দুনিয়ার মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের ও প্রেরণার রক্তস্নাত ইতিহাস। আজ থেকে ১২৭ বছর আগের কথা। তখন দেশে দেশে পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের কষ্টের সীমা ছিল না। মালিকেরা নগণ্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে দরিদ্র মানুষের শ্রম কিনে নিতেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাড়ভাঙা শ্রম দিয়েও শ্রমিক তার ন্যায্য মূল্য পেতেন না। মালিকেরা উপযুক্ত মজুরি তো দিতেনই না, বরং তারা শ্রমিকের সুবিধা-অসুবিধা, নুন্যতম মানবিক অধিকার ও দুঃখ-কষ্ট পর্যন্ত বুঝতে চাইতেন না। মালিকেরা তাদের অধীনস্থ শ্রমিককে দাসদাসীর মতো মনে করতেন। আর তাদের সাথে পশুর মতো ব্যবহার করতেন। সুযোগ পেলেই মালিকেরা শ্রমিকের ওপর চালাতেন নানা শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন। বলতে গেলে শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকারও তখন রক্ষিত হতো না।
শরীরের ঘাম আর সীমাহীন শ্রমের বিনিময়ে মালিকের সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠত। অথচ তার ছিটেফোঁটাও শ্রমিকের ভাগ্যে জুটত না। পরিবার-পরিজন নিয়ে শ্রমিকের জীবন ছিল দুর্বিষহ। তখন শ্রমিকের জন্য কাজের নির্দিষ্ট সময় যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না নির্দিষ্ট কোন মজুরির, ছিল না কোন নিয়ম-কানুন। ফলে শ্রমিকের শ্রমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে মালিক অর্জন করতেন সীমাহীন সম্পদ। ফলে শোষণ-নিপীড়ন ও বঞ্চনাই শ্রমিকের ভাগ্যের লিখন হয়ে দাঁড়াল। এভাবে মালিকের সীমাহীন অনাচার, মুনাফারলোভ ও একপাক্ষিক নীতির ফলে শ্রমিকদের মনে জমতে শুরু করে প্রচন্ড ক্ষোভ ও দ্রোহ।
শ্রমিকের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের আকার ধারণ করল আর ১৮৮৬ সালে ঘটল মে দিবসের সূচনা আজকের সভ্যতার অহঙ্কারী দেশ আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে। কাজের সময় ৮ ঘণ্টা নির্ধারণ, মজুরির পরিমাণ বৃদ্ধি ও কাজের উন্নত পরিবেশ তৈরি করাসহ শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৮৮৬ সালের পয়লা মে হে মার্কেটের শিল্প শ্রমিকেরা ধর্মঘটের ডাক দিলেন। এ ধর্মঘটে যোগ দেন ৩ লাখ শ্রমিক। তারা কলকারখানা বন্ধ রেখে নেমে এলেন রাজপথে। এতেও মালিকেরা নতি স্বীকার করলেন না। তারা শ্রমিকদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে পিছু হটানোর কৌশল গ্রহণ করলেন। এদিকে পুলিশও কঠোর হলো সে ধর্মঘট দমন করার জন্য শ্রমিকের ওপর চড়াও হলো।
পুলিশি অ্যাকশনের প্রতিবাদে ৩ মে ধর্মঘটী শ্রমিকেরা এক সমাবেশের ডাক দিলে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকা থেকে শ্রমিকেরা এসে এতে যোগ দেন। সেদিন হে মার্কেটের বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন শ্রমিক নেতা অগাস্ট স্পিজ। এই সময় মালিক পক্ষের লেলিয়ে দেয়া সন্ত্রাসীরা সমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটালে ঘটনাস্থলে একজন পুলিশ সদস্য মারা যায়। এতে বিক্ষুব্ধ পুলিশ বাহিনী সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ শ্রমিদের ওপর। এতে মুহুর্তের মধ্যেই মারা যান ১১ জন শ্রমিক। এ সময় শ্রমিদের ন্যায়ানুগ দাবিকে দাবিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে মালিকেরা আরো কঠোর হন। এদিকে শ্রমিক ধর্মঘট সংঘটিত করার অপরাধে শ্রমিক নেতা আগস্টসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। শুধু তাই নয়, অভিযুক্তদের প্রহসনমূলক বিচারের মুখোমুখি করে সরকার।
তারপর ১৮৮৭ সালে সাজানো মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। প্রহসনমূলক এই বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহনের পূর্বে অগাস্ট স্পিজ বলেছিলেন, “আজ আমাদের এই নি:শব্দতা, তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে”। ২৬শে জুন, ১৮৯৩ ইলিনয়নের গর্ভণর অভিযুক্ত আটজনকেই নিরপরাধ বলে ঘোষণা দেন এবং হুকুম প্রদানকারী পুলিশের কমান্ডারকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়। লুইস লিং নামের এক শ্রমিক ফাঁসির আগের দিন কারাগারের ভেতর আত্মহত্যা করেন। আরেকজনের ১৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়।
এত কিছুর পরও শ্রমিক আন্দোলন দাবিয়ে রাখা যায় নি। বরং সারা দুনিয়ায় শিকাগোর রক্তাক্ত ঘটনার উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকায়ও এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী শ্রমিক আন্দোলনের প্রভাব ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করে। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের “দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার” দাবী অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায়। আর পহেলা মে বা মে দিবস প্রতিষ্ঠা পায় শ্রমিকদেও দাবী আদায়ের দিন হিসেবে।
১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফরাসী বিপ্লবের শতবার্র্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। উক্ত অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষনা করা হয় এবং তখন থেকেই অনেক দেশে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনের উক্ত গৌরবময় অধ্যায়কে স্মরণ করে ১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছরের ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালন হয়ে আসছে “মে দিবস” বা “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস”।
আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগেও মেহনতি মানুষের অধিকার ভুলন্টিত হচ্ছে…
তাই মে দিবসের গুরুত্ব আজও অপরিসীম। দুনিয়ার সকল মেহনতি মানুষকে লাল সালাম…
লেখক: প্রনব জ্যোতি পাল, সদস্য, বাসদ, সিলেট জেলা