নিয়াজ মাহমুদ: রাজনৈতিক কারাবন্দিদের নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৪ হাজারেরও বেশি নেতা কারাবন্দি রয়েছেন দেশের বিভিন্ন কারাগারে। কারাগারে আটক কর্মী-সমর্থকদের বিষয়ে দলগুলোর কাছে কোন তথ্য না থাকলেও এ সংখ্যাটি নেতাদের চেয়ে কয়েক গুণ হবে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।
রাজনৈতিক বন্দির আধিক্যের কারণে ৬৮টি কারাগারে ধারণক্ষমতার প্রায় ৩ গুণ বেশি হাজতি রয়েছেন। কারাবন্দি হাজতিদের বেশির ভাগই বিনা বিচারে আটক। সরকারবিরোধী আন্দোলন-কর্মসূচি পালনকালে কিংবা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের রোষানলে পড়ে প্রতিদিনই মিথ্যা মামলায় আসামি হয়ে কারাগারে যেতে হচ্ছে অনেককে। আটককৃতদের সামাল দিতে কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের পাশাপাশি কারাবন্দিদেরও দুর্ভোগের শেষ নেই।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও বিভিন্ন সূত্র জানায়, কারাগারে প্রায়ই লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার। রাত কাটাতে হয় গাদাগাদি করে কারাবন্দি নিরপরাধ অনেক মানুষকে। ভিআইপি বন্দিদের জন্য কারাগারগুলোতে উপযুক্ত সেল নেই। অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত কারাগারে বন্দিরা মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। বিপুল সংখ্যক বন্দি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে নিরাপত্তার অজুহাতে বন্দিদের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে স্থানান্তর করায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের বেশির ভাগ কারাগারের পরিবেশ অত্যন্ত নাজুক। বন্দির চাপে সৃষ্টি হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের। সহকারী কারা মহাপরিদর্শক জহির উদ্দিন বাবর মানবজমিনকে বলেন, দেশের ১৩টি কেন্দ্রীয় ও ৫৫টি জেলা কারাগারের ধারণক্ষমতা ৩৩ হাজার ৮শ’ ২৪ জনের। সেখানে বর্তমানে বন্দির সংখ্যা ৭৯ হাজার ৫শ’ ৯৪। মহিলা বন্দির জন্য থাকার জায়গা রয়েছে ১১২৮ জনের। মহিলা কারাবন্দি রয়েছেন ২২৭৯ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ২৩ হাজার ৯শ’ ৬৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ হাজার ৬শ’ ৫৩ জন, সিলেট বিভাগে ৪ হাজার ৮শ’ ৫১ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯ হাজার ৯শ’ ৪৬ জন, রংপুর বিভাগে ৫ হাজার ৬শ’ ১০ জন ও খুলনা-বরিশাল বিভাগে ১১ হাজার ৫শ’ ৬৭ জন কারাবন্দি রয়েছে। অপর একটি সূত্র জানায়, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের। ধারণক্ষমতা ২৭০০ জনের। বর্তমানে ১০ হাজার বন্দি রয়েছে সেখানে। ১শ’ ৩৪ জনের জায়গায় বর্তমানে রয়েছে ৬শ’ মহিলা বন্দি। তাদের সঙ্গে রয়েছে ১১ শিশু। অতিরিক্ত বন্দির কারণে কারাগারের পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠেছে।
ফলে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বন্দিরা। বন্দিদের চিকিৎসার জন্য একটি কারা হাসপাতাল থাকলেও এর শয্যা সংখ্যা মাত্র ৮০। সেখানে ভর্তি কৃত রোগীর সংখ্যা প্রায় ২০০। গাজীপুর শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে কেন্দ্রীয় কারাগার কাশিমপুর-১ ও কাশিমপুর-২। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ভিআইপি বন্দিদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেককে সেখানে পাঠানো হয়। সূত্র জানায়, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা, কিবরিয়া হত্যা, বিডিআর বিদ্রোহ, যুদ্ধাপরাধ মামলায় আটক হয়ে বিরোধী দলের দুই ডজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে কারাভোগ করছেন। নতুন করে নানা অজুহাতে বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তারকৃতদের হরতালে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর, পিকেটিং, পুলিশকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ইত্যাদি বিষয়ে মামলা দেয়া হচ্ছে।
বর্তমানে কারাগারে আটক রয়েছেন বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। যুদ্ধাপরাধ মামলায় বিএনপি নেতাদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন: স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রী আব্দুল আলীম। পাশাপাশি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস দুলু, সাবেক এমপি নাসিরউদ্দিন পিন্টু সহ প্রায় ১২০০ রাজনৈতিক বন্দি কারাগারে রয়েছেন বলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত সম্পাদক রুহুল কবির রিজভী আহমেদ জানান।
যুদ্ধাপরাধ মামলায় জামায়াত নেতাদের মধ্যে দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার রায় হয়েছে। ১৭ই সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এ রায় দেয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এটিই প্রথম কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায়।
এছাড়া, আপিল বিভাগে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে আরও চারটি মামলা। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ এরই মধ্যে ৬টি মামলায় রায় ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ও গোলাম আযমের মামলার রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-১। এছাড়া, আব্দুল কাদের মোল্লা, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবুল কালাম আযাদের রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-২।
এর মধ্যে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মুজাহিদ, কামারুজ্জামান ও আবুল কালাম আযাদের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হলেও গোলাম আযমকে ৯০ বছর কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতের একটি সূত্র জানায়, আমীর, নায়েবে আমীর, কর্মপরিষদ সদস্য, নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও মহানগরী পর্যায়ের আমীরসহ ৫২ জন শীর্ষ নেতাসহ তাদের প্রায় ৩০০০ সদস্য রয়েছে কারাগারে।
ওদিকে, পুলিশ হেডকোয়ার্টার সূত্রে জানা যায়, রুটিন অভিযানে ঢাকা মহানগরী সহ সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি গ্রেপ্তার হচ্ছে। আদালত থেকে জামিন না পাওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারেই থাকতে হয়। অপর একটি সূত্র জানায়, কারাগারে সাধারণত গরিব ও নিরপরাধ মানুষরা বেশি থাকে; তারা টাকার অভাবে আইনগত সহায়তা খুবই কম পায়। আর অপরাধীরা টাকার জোরে আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বেরিয়ে আসে। দীর্ঘ দিন ধরে কারাগারের উন্নয়ন ঘটেনি। চিকিৎসার অভাবে পরিবেশগত সমস্যা তো রয়েছেই। কারাগার সংস্কার করার ব্যাপারে বহু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা বাস্তবতার মুখ দেখেনি।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন-এর প্রধান নির্বাহী এডভোকেট এলিনা খান বলেন, কারাগারে বিনাবিচারে মানুষকে আটক রেখে সরকার নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তিনি বলেন, একজন আসামি অপরাধী প্রমাণিত হোক বা না হোক সংবিধানে তার মানবাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কারাবিধিতেও তা উল্লেখ রয়েছে। কারাবন্দির মানবিক বিষয় দেখার দায়িত্ব কারা কর্তৃপক্ষ ও সরকারের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য তারা সে দায়িত্ব পালন করছেন না।
কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কর্মকর্তা জানান, কারাবিধি মোতাবেক সব হাজতি তাদের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে। এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোন সুযোগ নেই। তবে অতিরিক্ত হাজতির কারণে বাড়তি সমস্যা সামাল দিতে হচ্ছে। সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) জহির উদ্দিন বাবর বলেন, ১৫ কোটি জনসংখ্যার দেশে আসন সংখ্যার চেয়ে প্রায় ৩ গুণ কারাবন্দি বেশি নয়।
সৌজন্য: মানবজমিন