শীর্ষবিন্দু নিউজ: তিন দশকে ভাগ্য বদলের আশায় অনেকেই পাড়ি দিয়েছেন সৌদি আরবে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন পুরোটাই শ্রমিকদের বিরুদ্ধে।
সামর্থের সবটুকু দিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে স্বপ্নের দেশ সৌদি আরবে গিয়েছিলেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি তাদের। সৌদি আরবে গিয়ে কেউবা পুলিশের হাতে আটক হয়েছেন, কেউবা দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
গত ৯ মাসে দেশে ফিরে এসেছেন ১৮ হাজার শ্রমিক। সর্বশেষ গত দুইদিনে পুলিশি ধরপাকড়ে গত দুদিনে প্রবাসী ৩৭৩ জন কর্মী ঢাকায় ফেরত এসেছেন। আমাদের অর্থনীতি
হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক সূত্র জানিয়েছে, শুক্রবার রাতে ২০০ জন এবং শনিবার রাতে ১৭৩ জন ফিরে আসেন। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ব্যক্তিগত গাড়ির চালক হিসেবে সৌদি আরবে যান নারায়ণগঞ্জের সাইফুল ইসলাম। সেখানে গৃহকর্তার বাসার এবং বাগানের পরিচর্যার কাজও করতে হতো তাকে। দিনের কাজ শেষে রাত ১০টা থেকে ৩টা পর্যন্ত গাড়ি চালাতেন। এত পরিশ্রমের পর চার ঘণ্টাও ঘুমাতে পারতেন না। এভাবে পাঁচ মাস কাজ করার পর পালিয়ে যান তিনি। ১৮ অক্টোবর রিয়াদে সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
গত শুক্রবার রাতে ফিরে আসার পর গণমাধ্যমের কাছে এই বর্ণনা দিয়েছেন সাইফুল। তিনি বলেন, ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ করে সৌদিতে যান। পাঁচ মাসের বেতন সৌদি আরবের নিয়োগদাতা কোম্পানির কাছে জমা আছে। দেশে কোনো টাকা পাঠাতে পারেননি। ফিরে এসেছেন এককাপড়ে। সাইফুলের মতোই শূন্য হাতে সৌদি আরব থেকে গত ১০ মাসে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন প্রায় ১৮ হাজার কর্মী।
সাইফুলের মতোই শূন্য হাতে ফিরেছেন চট্টগ্রামের আবদুল্লাহ। ২০১৬ সালের শেষ দিকে শ্রমিক ভিসায় সৌদি আরবে যান। এক বছরের মাথায় অবৈধ হয়ে পড়েন। গত দেড় বছর পালিয়ে থেকে কাজ করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। গোপালগঞ্জের সমরাট শেখ আড়াই বছর আগে গিয়েছিলেন।
তার দাবি, আকামা (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) থাকলেও পুলিশ তাকে ফেরত পাঠিয়েছে। গত শুক্রবার সৌদি এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজে এই তিনজনসহ ফিরেছেন ২০০ প্রবাসী কর্মী। তাদের বক্তব্য, সৌদি আরবে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। রাস্তায়, গাড়িতে, কারখানায়, থাকার জায়গায় সবখানে তল্লাশি করছে দেশটির পুলিশ। কাগজপত্রে কোনো অসংগতি থাকলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড সূত্র জানায়, ফিরে আসা কর্মীরা নানা কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছিলেন। তাদের ট্রাভেল পাস (ভ্রমণের বৈধ অনুমতিপত্র) দিয়ে ফিরিয়ে আনা হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ফিরে এসেছেন প্রায় ১৮ হাজার কর্মী। এর আগে ২০১৭ সালে ফিরেছেন ১৬ হাজার ও ২০১৮ সালে ফিরেছেন ২৪ হাজার কর্মী। আর গত ১০ বছরে দেশটি থেকে শূন্য হাতে ফিরে এসেছেন ২ লাখের বেশি বাংলাদেশি কর্মী।
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, অবৈধ শ্রমিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে সৌদি পুলিশ। গত আড়াই বছরে বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ কর্মীকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
দূতাবাসের এক কর্মকর্তা জানান, কাজ নিয়ে সৌদি আসা কর্মীদের মালিক (কফিল) বা কাজ পরিবর্তনের সুযোগ নেই। যে কাজ নিয়ে তারা আসেন, তার বাইরে কিছু করার আইনগত অধিকার নেই তাদের। তাই বৈধভাবে আসার পরও অনেকে কাজ পরিবর্তন করার কারণে অবৈধ হয়ে পড়েন।
অভিবাসন খাত নিয়ে কাজ করা বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রামরুর পরিচালক সি আর আবরার বলেন, যে কাজের কথা বলে নেয়া হয়, তা দেয়া হয় না। তাই বাধ্য হয়েই অন্য কোনো কাজের দিকে যান কর্মীরা। বৈধভাবে গিয়ে অবৈধ হয়ে পড়ার বিষয়টি ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত সরকারের।
এদিকে ফেরত আসা কর্মীদের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহযোগিতায় বিমানবন্দরে জরুরি খাবার-পানিসহ নিরাপদে বাড়ি পৌঁছানোর সহায়তা দেয় ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম।
স্বপ্ন ভঙ্গের এমন নানা সব ঘটনা প্রতিদিনই বিমানবন্দরে শুনতে হচ্ছে জানিয়ে ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, সাধারণত ফ্রি ভিসার নামে গিয়ে এক নিয়োগকর্তার বদলে আরেক জায়গায় কাজ করতে যাওয়ার প্রবণতা চলছে অনেকদিন ধরে। এভাবে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়ে অনেকেই ফেরত আসতেন। কিন্তু এবার অনেকেই বলছেন, তাদের আকামা থাকার পরেও ফেরত পাঠানো হচ্ছে।
বিশেষ করে যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই অনেককে ফিরতে হচ্ছে যারা খরচের টাকার কিছুই তুলতে পারেননি। এভাবে গিয়ে লোকজন যেন প্রতারিত না হয় সেটা সবাই মিলে নিশ্চিত করতে হবে। তার আগে দূতাবাস ও মন্ত্রণালয়ের উচিত ফেরত আসার কারণগুলো চিহ্নিত করে এগুলোর প্রতিকার করা।