শাহবাগে আয়োজিত সমাবেশের মঞ্চে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদকে বক্তৃতা দিতে না দেয়া কথিত ‘অগ্নিকন্যা’ লাকী আক্তারকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। তোফায়েল এতে অসম্মান বোধ করেছেন।
ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক লাকী আক্তারকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় সমাবেশস্থল থেকে গতরাত ১০টার দিকে পাশের বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। লাকীকে নির্যাতনের প্রতিবাদ জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়ন রাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজনের প্রস্তুতি নিলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতারা সংবাদ সম্মেলন করতে দেননি। বারডেম হাসপাতালের সামনে সাংবাদিকদের ছাত্র ইউনিয়নের নেতারা সংবাদ সম্মেলনের জন্য ফোন করে নিলেও পরে তারা জানিয়ে দেন, সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে না। পরে রাত পৌনে ১২টার দিকে কয়েক মিনিটের জন্য লাকী আক্তারকে শাহবাগের মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাইকে তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। কেউ একজন আমার মাথায় আঘাত করে পালিয়ে যায়। আমি নিশ্চিত করে জানি না, কে সে। তিনি বলেন, রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে আমরা যে আন্দোলন করছি ঐক্যবদ্ধভাবে তা চালিয়ে যেতে হবে। পরে রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে তিনি আবার বারডেমে ফিরে যান।
সংশ্লিষ্ট একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, লাকীর ওপর হামলাকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। ছাত্র ইউনিয়ন নেতারা লাকীর ওপর হামলার বিচার দাবি করেছে। গত মঙ্গলবার থেকে শাহবাগে শুরু হওয়া আওয়ামী-বাম শোডাউনের প্রথম দিন থেকে নানা স্লোগান দিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় চলে আসেন ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী লাকী। তিনি লিড স্লোগান দেন আর এতে উপস্থিত ও উৎসুক জনতা প্রতিউত্তর দেন।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ইউনিয়ন সূত্র জানায়, গতরাত সাড়ে ৯টার দিকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বক্তৃতা দিতে মঞ্চে উঠলে লাকী আখতার প্রতিবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য দেয়া চলবে না।’ তবে ছাত্রলীগের নেতাদের সহায়তায় তোফায়েল বক্তব্য দেন। তিনি বক্তব্য দিয়ে চলে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম ও তার ক্যাডাররা লাকীর ওপর হামলা করে। পেছন থেকে মাথায় আঘাত করলে লাকী সমাবেশস্থলে লুটিয়ে পড়েন।
লাকীর ঘনিষ্ঠজনেরা সাংবাদিকদের জানান, লাকীকে পেছন থেকে আঘাত করা হলে আহতাবস্থায় সে লুটিয়ে পড়ে। জরুরি ভিত্তিতে তখন তাকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগ নেতা ওবায়দুল্লাহ সনি, মুনিফ আম্মার, তানভীর আহমেদ, মাহমুদুল হাসান, শাহেদ শফিক, অরণ্য পাশা, ইমরান ও পিয়াল হাসান প্রমুখ লাকীকে পেটান। এরপর লাকীকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সহকারী শাকিল বিষয়টি নিয়ে সিপিবির নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। তিনি সেলিমকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা বলেন। পরে সেলিম ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সংবাদ সম্মেলন করতে বারণ করেন। রাত সোয়া ১১টার দিকে বারডেম হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলে সেখানে সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, রুহিন হোসেন প্রিন্সসহ দলটি ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে অবস্থান করতে দেখা যায়। তবে সাংবাদিকদের ১৫ মিনিট দাঁড় করিয়ে রাখার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে জরুরি বিভাগের ফটক বন্ধ করে দেন সিপিবি নেতারা। এ ঘটনাকে চাপা দেয়ার জন্য লাকী আক্তার টানা আন্দোলনে পানিশূন্যতায় ভুগছেন বলে প্রচার করা হয়।
তবে ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি পিনাক রায় পিন্টু গত রাতে আমার দেশ-কে টেলিফোনে এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে পরে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবাদ জানানো হবে।’ এ সময় বারডেম হাসপাতালে সাংবাদিকরা লাকীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে এবং তার পরিস্থিতি জানতে চাইলে তাতে বাধা দেয়া হয়। শুধু আওয়ামীপন্থী কিছু পত্রিকাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়।
এ সময় অন্য সাংবাদিকরা প্রতিবাদ করলে সিপিবি নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘লাকী সকাল থেকেই কিছুটা অসুস্থ। এখন সুস্থ আছেন। তিনি কিছুক্ষণের মধ্যে সমাবেশস্থলে গিয়ে বক্তব্য রাখবেন।’ তবে লাকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাকে পেছন থেকে মাথায় এবং পায়ে আঘাত করা হয়েছে।’ তবে আঘাতকারীদের কারো নাম তিনি উল্লেখ করেননি। যোগাযোগ করলে রমনা থানার এসআই হারুন-অর রশিদ পিপিএম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনাটি সত্য। লাকির ওপর হামলা হয়েছে। দোষীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। তাছাড়া বারডেমে লাকিকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে।’ তবে বারডেম হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকৎসকরা এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে রাজি হননি। এর আগে গতকাল বিকালে প্রথম দফায় বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন লাকী আক্তার। তখন বলা হয়েছিল, টানা আন্দোলনে পানিশূন্যতায় ভুগছিলেন তিনি। হাসপাতালে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করে সন্ধ্যার পর শাহবাগের সমাবেশে ফিরে যান।
জামায়াতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে তার ফাঁসির দাবিতে গত মঙ্গলবার বিকাল থেকে লাগাতার এ সমাবেশ শুরু হয়। ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফোরাম নামের একটি সংগঠনের নামে এ সমাবেশ শুরু হলেও প্রথম দিন থেকেই এর নেতৃত্বে আছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিক বিভিন্ন বাম দলের নেতারা। আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের নেতারা প্রথম দিন থেকেই এতে সংহতি জানাচ্ছেন।
Leave a Reply