শীর্ষবিন্দু আর্ন্তজাতিক নিউজ: মানবপাচারের ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছে একটি চক্র। ইউরোপের দেশ স্পেনের কথা বলে যুবকদের পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে উত্তর আফ্রিকার দেশ আলজেরিয়ায়।
বলা হচ্ছে, আলজেরিয়া ট্রানজিট। সেখান থেকে তারা চলে যাবে মরক্কো। এরপর মরক্কো হয়ে সরাসারি স্পেন। সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের এমনটাই বলছে। এমনকি ট্রেনিং সেন্টারগুলোতেও একই কথা বলা হচ্ছে তাদের। দালালচক্রের এই বক্তব্য বিশ্বাস করাতে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে রাখা হয়েছে বিশ্ব মানচিত্র।
তাতে দেখানো হচ্ছে, সম্ভাব্য রুট। দূরত্ব বুঝিয়ে বাতলে দেয়া হচ্ছে স্পেন যাওয়ার কৌশল। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আলজেরিয়াতে যাওয়ার পর মানবতার জীবন-যাপন করছেন ভাগ্য বদলের আশায় বিদেশ পাড়ি জমানো বাংলাদেশিরা। কেউ কেউ মরক্কো পাড়ি দিলেও ভোগান্তির শেষ নেই। স্পেন যাওয়া তো দুঃস্বপ্ন মাত্র।
সম্প্রতি এমন ৪২ বাংলাদেশি বিদেশের মাটিতে আটকা পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। আটকে পড়া এসব হতভাগাদের পরিবারগুলোর আবদনের প্রেক্ষিতে তাদের উদ্ধারের জন্য ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডে আবেদন জানিয়েছে ব্র্যাক। বোর্ড থেকে এ ব্যাপারে দূতাবাসকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য চিঠিও দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে এই অবস্থা থেকে দেশে ফিরেছেন ৯ বাংলাদেশি।
এমনই ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন মুিন্সগঞ্জের ছেলে সুমন, দেলওয়ার, মহসিন, হেলাল ও আলমগীর। তাদের ভাষ্যমতে, রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের আলজেরিয়া পাঠায়। স্বপ্ন দেখায়, প্রতি মাসে ৪০-৫০ হাজার টাকা বেতনের। জানায়, আলজেরিয়া থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন যেতে পারবে। কিন্তু আলজেরিয়ায় আটকা পড়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নিরুপায় হয়ে দেশে ফেরার জন্য তারা আকুল আবেদন জানিয়েছেন তারা।
আলজেরিয়ায় আটকে পড়া প্রবাসী ও তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন, উচ্চ বেতন, ভালো কাজের সম্ভাবনা আর সহজ পথে স্পেন প্রবেশের রঙ্গিন স্বপ্ন দেখিয়ে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশি যুবকদের। স্বপ্ন দেখানোর জন্য নেয়া হচ্ছে নানা কৌশল, অফিসগুলোতে রাখা হয়েছে বিশ্ব মানচিত্র, দেখানো হচ্ছে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো আর মরক্কো থেকে স্পেনের দূরত্ব।
অভিযোগ ওঠেছে, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র নিয়েই কর্মী প্রেরণ করছে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা প্রতারিত হচ্ছেন। সম্প্রতি আলজেরিয়া থেকে দেশে ফিরেছেন ৯ বাংলাদেশি। স্পেনের উদ্দেশ্যে মরক্কোতে অবস্থান করছেন ৪ জন। আর আলজেরিয়াতে অবস্থা করছেন এখনও ৪২ বাংলাদেশি।
আলজেরিয়া ফেরত কর্মী মোহাম্মদ ফারুক জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জনপ্রতি তিন লাখ টাকা নিয়ে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর ছাড়পত্র দিয়ে মুন্সিগঞ্জ ও আশেপাশের এলাকার ৫৬ জন বাংলাদেশীকে আলজেরিয়াতে পাঠায় রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারাসীজ লি. (আর.এল-১৩১৪) ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টার।
আলজেরিয়া যাওয়ার পূর্বেই সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টার থেকে কর্মীদের বলা হয়- ভালো না লাগলে কয়েকদিন কাজ করে চাইলে স্পেন চলে যেতে পারবেন। কিন্তু আলজেরিয়াতে গিয়ে কাজ করালেও ঠিকমতো বেতন পাননি তারা। এসব কর্মীদের অভিযোগ, বেতন চাইলে মারধর করা হতো।
আলজেরিয়ায় আটকে পড়া ও ফেরত আসা যুবকরা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে এজেন্সি বলে- বিদেশ পাঠানোর কথা আমরা পাঠিয়েছি। এখন সেখানে সমস্যা থাকলে কী করবো?
সিঙ্গাপুর ট্রেনিং সেন্টারে যোগাযোগ করলে তারা জানিয়েছে, আলজেরিয়াতে তাদের লোক আছে। তারা স্পেনে লোক পাঠায়। আপনারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্পেন চলে যেতে পারেন। এসব কথা শোনার পর তাদের সঙ্গে থাকা ৪ কর্মী আক্তার মিয়া, ইব্রাহিম, রিপোন মোল্লা ও উজ্জল স্পেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো গেছে। কিন্তু মরক্কো গিয়ে বিপদের মধ্যে পড়েছেন তারা।
সম্প্রতি ফেরত আসা ফারুক জানান, পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় তিনিসহ ৯ জন দেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এরা হলেন, জসিম, মুহিন আহাম্মেদ, শামীম শেখ, হৃদয় শেখ, মো. সুমন, রুবেল, ইসমাইল ও আল আমিন।
তারা জানান, জীবন বাঁচানোর তাগিদে পরিবার থেকে টাকা নিয়ে নিজ থেকে বিমান টিকিট কেটে শুন্য হাতে দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরত আসার পর কর্মীরা সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি বন্যা বিজয় ওভারাসীজ লি. ও সিঙ্গাপুর স্কিল ট্রেনিং সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যোগাগযোগের পর থেকে তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে।
চলতি বছরের জুলাই মাসে মরক্কো থেকে দেশে ফেরত আসা দুই কর্মী রায়হান ও মো. ওমর ফারুক জানান, ২০১৭ সালে রিক্রুটিং এজেন্সি মেসার্স আর এস লিংকার্স (আর.আল নং ৯৬) তাদেরকে জনশক্তি ব্যুরোর ছাড়পত্র দিয়ে আলজেরিয়া পাঠান। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তারা মরক্কো হয়ে স্পেন যাওয়ার চেষ্টা করেন।
এছাড়া একইভাবে আলজেরিয়া থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন যেতে ব্যর্থ হয়ে দেশে ফেরত এসেছেন মো. মিজানুর রহমান, মো. মহিউদ্দিন, মো: রায়হান। তারাও একই ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছেন।
এ ব্যাপারে ব্র্র্যাকে মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, আলজেরিয়াতে আটকে পড়া ৭ জনের পরিবার আমাদের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন। আলজেরিয়াতে অবস্থানরত ওই বাংলাদেশিদের নিরাপদে দ্রুত দেশে ফেরত আনতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডকে গত ৯ই অক্টোরর আমরা লিখিতভাবে আবেদন করেছি। বোর্ড থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে। তবে সার্বিক ঘটনা শুনে আমাদের মনে হচ্ছে, স্পেনে পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়ে তাদেরকে আলজেরিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। বিষয়টা উদ্বেগজনক। আশা করছি, সেখানকার দূতাবাস থেকে সরকারকে এ ব্যাপারে করণীয় জানানো হবে। দ্রুত এই ধরনের প্রতারণা বন্ধ করতে না পারলে আরও অনেককে বিপদে পড়তে হবে। দেশের ভাবমুর্তিও ক্ষুন্ন হবে বলেও মনে করেন তিনি। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান শরিফুল হাসান।