শুক্রবার, ০৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৮:৫২

অনিশ্চয়তার পথে আগামী নির্বাচন

অনিশ্চয়তার পথে আগামী নির্বাচন

 

হামিদ সরকার: প্রভাবশালীদের মন রক্ষা করে ও নির্বাচন কমিশনের দুই-একজন কমিশনারের মতের আলোকেই জাতীয় সংসদের আসনসীমানা পুনর্বিন্যাস করায় ক্ষুব্ধ দেশের সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তাদের বক্তব্য ইসি মহল বিশেষের স্বার্থে আসনগুলো ভেঙে তছনছ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সরকারি দলের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যেও অনেকে এই বিন্যাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সংলাপে সুশীলসমাজ ও রাজনৈতিক দলের মতামতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এই আসন বিন্যাস করল ইসি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সংবিধানে তাদের ক্ষমতা দেয়া আছে এটা ঠিক, কিন্তু ইসি যদি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার জন্য ভোগান্তির শিকার হবে সাধারণ মানুষ।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ, খসড়ায় জেলাওয়ারি আসন সংখ্যায় কোনো পরির্বতন না এলেও অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন এসেছে ব্যাপক। কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে, জনসংখ্যা বা ভোটার বৃদ্ধির বিষয়টিতে গুরুত্ব না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বেশির ভাগ আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। আসন পরিবর্তনে প্রভাবশালী মহলের তদবির এবং কমিশনের আঞ্চলিকতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে এই প্রথম সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ ১৯৭৬-এর বিধিবিধানের ব্যাপক লঙ্ঘন হয়েছে। ১৯৭৬ সালের সীমানা পুনর্নির্ধারণ অধ্যাদেশ অনুসারে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন জাতীয় সংসদের ৩০০টি নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ করে  একটি চূড়ান্ত তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে বৃহত্তর ঢাকায় সংসদীয় আসন ছিল ৩০টি। ১৯৭৯ সালে শুধু ঢাকা জেলায় সংসদীয় আসন ছিল ১১টি। ১৯৮৬ সালে দু’টি আসন বাড়ানো হয়। ফলে ২০০১ সাল পর্যন্ত জেলার আসন ছিল ১৩টি। কিন্তু ২০০৮ সালে বিগত নির্বাচন কমিশন হঠাৎ করেই আইন উপো করে ঢাকায় সাতটি সংসদীয় আসন বৃদ্ধি করে। ফলে বর্তমানে ঢাকা জেলায় আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০টিতে। যেখানে ঢাকা মহানগরীতে সংসদীয় আসন ছিল ১০টি, ২০০৮ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ১৫টিতে। শুধু ঢাকার মিরপুরের একটি আসনকে তখন ভেঙে তিনটি করা হয়। ঢাকার বিদ্যমান ১৫টি সংসদীয় আসন বহাল অথবা বাড়ানো হলে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ঢাকা-১৫ আসন ছিল ওয়ার্ড নম্বর ৪, ১৩, ১৪ ও ১৬ নিয়ে। এখন করা হয়েছে ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩ এবং সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নকে। যেটাকে ঢাকা-১৯ থেকে আলাদা করা হয়েছে। ঢাকা-১৯ আসনে সাভার উপজেলাকে নিয়ে করা হয়েছে। বাদ দেয়া হয়েছে কাউন্দিয়া ইউনিয়নকে। ফলে ওই এলাকার সাধারণ ভোটাররা এখন ক্ষুব্ধ। তাদের বক্তব্য আমরা কেন সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে ওপারে যাব। কার স্বার্থে ইসি এই বিভাজন করল? পর্যালোচনায় দেখা যায়, খসড়া প্রকাশে রাজনৈতিক দলের মতামতের তোয়াক্কাই করেনি ইসি। ইসির খসড়ায় নবাবগঞ্জ-দোহার উপজেলার পরিবর্তে শুধু দোহার উপজেলাকে নিয়ে ঢাকা-১ আসন করা হয়েছে। নবাবগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ঢাকা-২ আসন করা হয়েছে। কেরানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ঢাকা-৩ আসন করা হয়েছে। বিদ্যমান সীমানায় ঢাকা ২-এর কেরানীগঞ্জ উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নকে ঢাকা ৩-এ দেয়া হয়েছে।

এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড ২৩, ২৫, ৫৫, ৫৬ এবং কামরাঙ্গীচর ও হাজারীবাগ থানার সুলতানগঞ্জ ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-৪ আসন করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫, ৩৬ ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-৬ আসন করা হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫১ থেকে ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড এবং শ্যামপুর ও ধনিয়া ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-৮ আসন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭, ১৮, ২১, ২২ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ড এবং বাড্ডা, বেরাইদ, সাঁতারকুল ও ভাটারা ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-১২ আসন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯, ২০, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭, ৩৫ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-১৩ আসন গঠন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯, ১০, ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে ঢাকা-১৪ আসন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭, ৮, ১১, ১২, ১৩ এবং সভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-১৫ আসন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪, ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকা নিয়ে ঢাকা-১৬ আসন করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড, উত্তরা, তুরাগ, বিমানবন্দর, উত্তরখান, দক্ষিণ খান, হরিরামপুর এবং ডুমনি ইউনিয়ন নিয়ে ঢাকা-১৮ আসন করা হয়েছে। কাউন্দিয়া ইউনিয়ন ছাড়া সাভার উপজেলা নিয়ে ঢাকা-১৯ আসন গঠন করা হয়েছে।

মহাজোটের শরিক দল ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ খসড়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তার দল বলেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা না করে সীমানা পুনর্নির্ধারণ করাতে আসনগুলোর সীমা পুনর্বিন্যাসে সীমাহীন অসঙ্গতি ঘটেছে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর এই মন্তব্য করে জাতীয় পার্টি। তাদের বক্তব্য ছিল, ওই খসড়া বিজ্ঞপ্তিতে নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ৮৭টি আসনের এলাকা পুনর্নির্ধারণ করেছে, যাতে ১৯৭৬ সালের দ্য ডিলিমিটেশন অব ক্রস্টাসিয়াস ডেলিভারডের ৬ ধারার ২ উপধারায় প্রদত্ত ক্ষমতার উল্লেখ করা হয়েছে। অযৌক্তিকভাবে সীমানা পুনর্বিন্যাসের ফলে বিভিন্ন দল ও প্রার্থীর আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঘোরতর সমস্যার সৃষ্টি হবে। এমন অবস্থায় জাতীয় পার্টি এই সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয়টি গভীর গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। উদ্ভূত সমস্যাগুলো আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে এই আসন বিন্যাসের ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা ইসিতে এসে এ ব্যাপারে কথাও বলেন। সরকারি দলের নেতাদের প্রশ্ন ইসি কাদের স্বার্থে এই পুনর্বিন্যাস করেছে?

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমদের মতে, আসন বিন্যাসের ব্যাপারে সংবিধান ইসিকে এককভাবে ক্ষমতা দিয়েছে। তবে প্রতিটি আদমশুমারির পর জনসংখ্যার ওপর ভিত্তি করেই এই আসন বিন্যাস করার কথা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তারা যদি আকাশ-পাতাল পার্থক্য রাখে তাহলে তা সঠিক হবে না। তিনি বলেন, ইসির উচিত ছিল ঢাকা শহরের আসন সংখ্যা কমিয়ে ১০টিতে আনা। তারা যদি আসন বিন্যাসের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অন্যায় করে তাহলে তার জন্য ভোগান্তির শিকার হবে দেশের সাধারণ মানুষ।

আওয়ামী লীগের ঢাকা-১৫ আসনের এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তার নির্বাচনী এলাকা থেকে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডকে বাদ দিয়ে অহেতুক একটি ইউনিয়নকে যুক্ত করা হয়েছে। কোথায় সাভার আর কোথায় মিরপুর। কাউন্দিয়া ইউনিয়নের সাথে এই আসনের কী সম্পর্ক আমার বুঝে আসে না। তিনি এই আসন বিন্যাসের ব্যাপারে ইসিতে আপিল করবেন। তাকে কাউন্দিয়ায় যেতে হলে ঢাকা-১৪ আসনের ওপর দিয়ে যেতে হবে। কোন যৌক্তিকতায় এটা করা হয়েছে?




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024