রবিবার, ০২ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:৫৩

ব্রিটিশ ‘নলি’ সমাচার

ব্রিটিশ ‘নলি’ সমাচার

মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান / ১৭০৪
প্রকাশ কাল: সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১
ছবিতে ‘নলি‘র সাথে জিল্লুল হক জিলা

নলি নিয়ে দৌড় ঝাপ দিবেন না। প্রতারিত হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। একটু বুঝে নিন নলি কি ও ব্রিটেনে আসার ক্ষেত্রে তার আইনগত অধিকার। দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় বা অসৎ আইন ব্যবসায়ীদের থেকে দূরে থাকুন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো এর ব্যাখ্যা করতে বাকিটুকু আপনাদের বিচার বিবেচনা।

নলি বলতে যা বুঝায় আসলে তা হল শিফিং এর ভাষায় বলা হয় ‘Continuous Certificate of Discharge’ সহজ কথায় জাহাজের নাবিকদের কাজের ধারাবাহিকতার রেকর্ড। একজন নাবিক কোন জাহাজে কোন পোর্টে জয়েন করলেন এবং কোথায় গিয়ে কাজ শেষ করলেন তার সন তারিখ সময় বিবরণ সেথায় লিপিবদ্দ্ব থাকে।

ছবিতে প্রদর্শিত ‘নলি’টি সিলেট মৌলভীবাজারের বড়কাপন পোস্ট অফিসের অধীন বিরাহিমা বাদ গ্রামের প্রয়াত নাইওর মিয়া সাহেবের। উনার নাতী জনাব জিল্লুল হক জিলা সাহেবকে (বর্তমান ইউপি মেম্বার, ১নং একাটুনা, মৌলভীবাজার) ধন্যবাদ জানাই সংযুক্ত কাগজপত্র ও উনার ছবি দিয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করার জন্য। উনার সাথে আলাপ সাপেক্ষে এই সচেতনতামূলক বিষয়টি উঠে আসে। তাই একটা শিক্ষামূলক পোস্ট প্রদানে ব্রত হলাম।

আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব এই নলির কোন আইনগত ভিত্তি আছে কিনা খতিয়ে দেখতে। সেই সুবাদে নলির মালিক বা তার উত্তরাধিকারীদের লন্ডনে আসার কোন আইনগত অধিকার ইমিগ্রেশন আইন দেয় কিনা?

ব্যাখ্যা হল এই যে, ১৯৪৮ সালের আগে (B.N. Act 1948) (i.e. British Nationality Act) আইন পাশ করার পূর্বে দুনিয়ার সব প্রান্তের ব্রিটিশ মুল্লুকের সবাই কালো-সাদা-বাদামি লন্ডনের মাটিতে জন্ম হউক বা না হউক বা তাদের বাপ-দাদাদের ব্রিটেনের মাটির সাথে সরাসরি কোন অধিকার আছে কিনা তার কোন বিচার না করে সবার ব্রিটেনে প্রবেশে ছিল অবাধ অধিকার। সবাই ছিলেন ব্রিটিশ সাবজেক্ট। লন্ডনের যে কোন সাদা মানুষ বাংলাদেশে (তখনকার ইন্ডিয়য়) বসবাসে কোন বাঁধা বা প্রশ্ন ছিল না। তেমনি বাংলাদেশের (তখনকার ইন্ডিয়া) কোন মানুষ ব্রিটেনে বসবাস করতেও কোন আইনগত বাঁধা ছিল না। শুধু মূল ব্যপার হতে হবে ব্রিটিশ সাবজেক্ট কি না।

এই ব্রিটিশ সাবজেক্টের মধ্যে যারা মূল ব্রিটেনের বাহিরে বসবাস বা জন্ম তাদের অধিকার খর্ব হয়ে গেল ১৯৪৮ সালের আইনের মাধ্যমে।

১৯৪৮ এর আইনের পর যারা ব্রিটেনে জন্ম ও বসবাস করে আসছেন (১৯৪৮ সালের পূর্ব থেকে) এবং এখন থেকে জন্ম হবে বা বসবাস করতে থাকবেন তারা হয়ে গেলেন সিটিজেন অব ইউনাইটেড কিংডম (কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া)। সেই সময় আমাদের অনেক মুরুব্বিরা এই দেশে বসবাস করছিলেন। উনারা কিন্ত অটোমেটিক ব্রিটিশ সিটিজেন অব ইউনাইটেড কিংডম এন্ড কলোনির হয়ে গেলেন না। তাদেরকে বলা হল কমলওয়েলথ সিটিজেন কিন্ত তাদের এই দেশে থাকার অধিকার খর্ব হল না। যেহেতু ইন্ডিয়া কলোনি থেকে স্বাধীন দেশের স্ট্যাটাসে চলে গেলেও কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত হল।

আর যে সব দেশ তখনও কলোনি ছিল তাদের অধিকার থেকে গেলে অবাধে ব্রিটেনে প্রবেশাধিকার ও বসবাসের এবং তাদেরকে মিলিয়ে নতুন নাম হল ‘CUKC’ বাংলায় যাকে বলে সিটিজেন অব ইউনাইডে কিংডম এন্ড কলোনিস।

এখানে মনে রাখা দরকার আমরা বাংলাদেশ (তখনকার ইন্ডিয়া) ১৯৪৭ সালে আইনগতভাবে স্বাধীন দেশ হয়ে গেল। তাই নাগরিকত্বও আলাদা হয়ে গেল। আমাদের মুরুব্বিরা যারা এই দেশে কিছু দিন নাবিক হিসাবে এসেছেন বা থেকেছেন তাদের কোন নাগরিকত্ব ব্রিটিশ আইনে আর থাকল না। এখানে ভুল করলে চলবে না নাগরিকত্ব ও ভিসা ছাড়া প্রবেশ দুটি ভিন্ন বিষয়। কমনওয়েলথ গঠন করার পর ঐ সব নাগরিকদের ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত বিনা ভিসায় পোর্ট এন্টির মাধ্যমে বিলেতে প্রবেশ করতে পারতেন।

যাক জিনিসটা আরো জটিল হতে থাকে ১৯৬২/১৯৬৮/১৯৭১/১৯৮১ সালে বিভিন্ন ইমিগ্রশন আইনের মাধ্যমে। আমি এই স্বল্প পরিসরে আইনের হালকা উল্লেখ করার মাধ্যমে বুঝাতে চাচ্ছি যাদের নলি ছিল বা ইংল্যান্ডে আসা যাওয়া করেছেন শুধু সেই সুত্রে আপনি বা আপনার কোন সন্তানাদি ব্রিটেনে প্রবেশে কোন অধিকার নেই, তা ঐ ১৯৪৮ সালের আইনে রহিত হয়ে গেল।

নলি বা ব্রিটিশ জাহাজি/নাবিক সম্পর্কে আর দুটি লাইন লিখে আমি দুইটা উদাহরণ তুলে ধরব। বিষয়টা আশা করি সবার কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে।

১) ব্রিটিশ আমলে ইন্ডিয়া থেকে একটা নলি ইস্যু হত Indian Article (উনাদেরদেরকে সিলেটের স্থানীয় ভাষায় বলা হত কলকাত্তি জাহাজি/নাবিক)। ঐ সব নলিতে দেখবেন লেখা থাকবে ‘Issued by the Government of India’

২) অন্যটা ইস্যু হত বিলেত থেকে ‘English Article’ (আমাদের দেশের জাহাজিদের মধ্যে যারা ঐসব নাবিক ছিলেন তাহাদেরকে বলা হত ‘ইংলিশ সনি জাহাজের নাবিক’)। আমাদের বেশ সংখ্যক সিলেটি অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে যারা বিলেতের মাটিতে উঠে বসবাস শুরু করেন, তাদের প্রায় সবাই ‘English Article’ এর নাবিক ছিলেন। উনাদের নলিতে লেখা থাকতো- ‘ISSUED BY THE MINISTRY OF TRANSPORT/OR BOARD OF TRADE’ এবং কাগজের কোথায় না কোথায় লেখা থাকতো ‘মারচেন্টাইল মেরিন অফিস’।

আমাদের এখানে সংযুক্ত নাইওর উদ্দিন সাহেবের নলি ও জনাব ছমির উল্ল্যা সাহেবের নলি (সঙ্গত কারনে সংযুক্ত করা গেল না) দিয়ে উদাহরণ দিলে সহজ হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে-

১) নাইয়র সাহেবের নলি ইস্যু হয়েছে ইন্ডিয়া থেকে ১৯৩৬ সালে। তাই উনাকে বলা হত ইন্ডিয়ান আরটিকেলে কাজ করা নাবিক/জাহাজি/কলিকাত্তা জাহাজী।

২) ছমির উল্ল্যা সাহবের নলি ইস্যু হয়েছে বিলেত থেকে উনারা হলেন ইংলিশ আরটিকেলে কাজ করা নাবিক/জাহাজি/মারচেন্টাইল মেরিন।

একি ব্রিটিশের জাহাজে কাজ করলেও এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ ছিল ব্যাপক। যাহারা ইংলিশ আরটিকেলে কাজ করতেন উনাদের নিয়োগের পূর্বে ইংলিশে ইন্টারভিউ হত ও নিজেদের ইংলিস ফর্ম নিজেরাই ফিলাপ করার মত ন্যূনত্ব যোগ্যতার সাথে কাজের দক্ষতার সার্টিফিকেটও থাকতে হতো। ছমির উল্ল্যা সাহবেদের মত আমাদের কিছু পূর্ব পুরুষরা পরবর্তীতে হয়ে যান ‘সিটিজেন অব ইউনাইটেড কিংডম এন্ড কলোনি’। তাই উনাদের সন্তান-পরিবার এখনও বাংলাদেশ থেকে আসতে পারেন।

কিন্ত পরিতাপের বিষয় নাইয়র মিয়া সাহবেরা ব্রিটিশ জাহাজে কাজ করলেও এবং বিলেতে আসা যাওয়া করে থাকলেও উনারা বা উনাদের সন্তানেরা এই বিলেতে আসার কোন অধিকার নেই। উনারা ছমির উল্ল্যা সাহেবদের মত ইংলিশ আরটিকেলের নাবিক ছিলেন না।

তাই সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে, আমাদের যে ভাইয়েরা বাংলাদেশে ‘নলি’ এই আশায় আকড়ে ধরেছেন যে, বিলেতে আসা যাবে বা বিভিন্ন দালাল বা বাটপার লোক দ্বারা মিথ্যা প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়ে আশায় বুখ বেধেছেন তারা এই লেখার মাধ্যমে সতর্ক হউন। কেননা এখানে সংযুক্ত জনাব জিল্লুল সাহেব বলছেন, কিছুদিন আগে মৌলভিবাজারের অধীন সরকার বাজারের কাছের এক উকিলের পরামর্শে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা গচ্ছা দিয়েছেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমার এই লেখা নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছি। আপনি যদি ভুক্তভোগী হয়ে থাকেন তাহলে এই বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন আইনজীবির সাথে আলাপ করে পরামর্শ নিন।

লেখক: মোহাম্মদ ছালিকুর রহমান, এডভোকেট, ২নং বার, জজ কোর্ট সিলেট (সাবেক কর্মস্থল), M.S.S (D.U), LLM. (U.E), LONDON)। বর্তমানে বিলেত প্রবাসী।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
All rights reserved © shirshobindu.com 2022