কলোরেক্টাল ক্যান্সার একটি অতি পরিচিত নাম যা শুরু হয় অন্ত্র কিংবা পায়ুপথে। তবে সূত্রপাতের স্থানভেদে একে ‘কোলন ক্যান্সার’ অথবা ‘রেকটাম ক্যান্সার’ বলা হয়। কোলন আর রেকটাম ক্যান্সারের উপসর্গগুলো একই রকম হওয়ার কারণে এদেরকে একত্রে ‘কলোরেক্টাল’ ক্যান্সার বলা হয়।
রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোলন কিংবা রেকটাম-এর ভেতরের দেয়ালে মাংসের দলা তৈরি হয় যাকে বলা হয় ‘পলিপস’। সময়ের পরিক্রমায় এবং চিকিৎসার অভাবে এই ‘পলিপস’ পরিণত হয় ক্যান্সার কোষে। লক্ষণ বুঝে দ্রুত চিকিৎসা নিতে পারলে এ ধরনের নিরাময় সম্ভব।‘লার্জ ইন্টেস্টাইন’, ‘লার্জ বাওয়েল’ দুটোই হলো বৃহদান্ত্রের আরেক নাম, যাকে আবার ‘কোলন’ নামেই চিহ্নিত করা হয়।
অপরদিকে বৃহদান্ত্রের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পায়ুপথে গিয়ে শেষ হওয়া ‘চেম্বার’টি হলো ‘রেকটাম’। সাধারণত বংশগত কারণ, খাদ্যাভ্যাস, মদ্যপান, ধূমপান, ‘ইনফ্লামাটরি বাওয়েল ডিজিস (আইবিএস)’ ইত্যাদি এই রোগের অন্যমত প্রধান কারণ। পুরুষের এই রোগে মৃত্যুবরণ করার সম্ভাবনা বেশি। আবার নারী-পুরুষ উভয়েরই কোলন ক্যান্সার হওয়া সম্ভব হলেও, পুরুষদের রেকটাল ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
উপসর্গ বা যেসব লক্ষণ দেখা যায়:
* অন্ত্রের কার্যক্রমের গুরুতর পরিবর্তন। বেশির ভাগ সময় ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা। সাধারণ সময়ের চাইতে মলের আকার পরিবর্তন বা খুবই চিকন মলত্যাগ।
* পায়ুপথে রক্ত, রক্ত মিশ্রিত মলত্যাগ।
* সবসময় পেটে বা অন্ত্রে অস্বস্তি। যেমন- খিঁচুনি, গ্যাস ও ব্যথা।
* মলত্যাগের পরেও সব সময় অনুভূত হওয়া যে ভালোমতো পেট খালি হয়নি।
* দুর্বলতা ও কোনো কারণ ছাড়াই দ্রুত ওজন কমা।
চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার:
ক্যান্সার কোনো ‘স্টেজে’ বা কি অবস্থায় আছে তার ওপর নির্ভর করে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে ‘টিউমার’ অপসারণ করা হয়। ‘রেডিয়েশন থেরাপি’, ‘কেমোথেরাপি’ ইত্যাদিও চিকিৎসা দেয়া হয়। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে অস্ত্রোপচার হলো প্রথম চিকিৎসা। ক্যান্সার কোষে অন্ত্রের ভেতরে ছড়িয়ে পড়লে অন্ত্রের কিছু অংশ কেটে ফেলা সম্ভব, যাকে বলা হয় ‘পার্শিয়াল কলেকটমি’।
আরেকটি চিকিৎসা পদ্ধতি হলো ‘ওস্টোমি’। যেখানে অন্ত্রের সুস্থ অংশ থেকে পেটের বাইরে ‘ওপেনিং’ তৈরি করা হয় এবং সেখানে একটি ব্যাগ বসানো হয়। মল এই ব্যাগে এসে জমা হয়।
এ ছাড়াও আছে রেডিয়েশন থেরাপি যেখানে ‘এক্স-রে’ ও ‘প্রোটন’-এর সাহায্যে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা হয়।
প্রতিরোধে করণীয়:
মরণঘাতী এই ক্যান্সার থেকে বাঁচতে হলে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করতে হবে। শাকসবজি, শস্য জাতীয় খাবার, ভিটামিন, খনিজ, ভোজ্য আঁশ এবং ‘অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট’ থাকে এমন খাদ্যাভ্যাস বেছে নিতে হবে। এই উপাদানগুলো অন্ত্রের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে খুবই জরুরি।
ধূমপান ও মদ্যপান থেকে বিরত থাকতে হবে ও নেশা জাতীয় দ্রব্য বর্জন করতে হবে। সোজা কথা জীবনযাপন ও খাদ্যাভ্যাসে শৃঙ্খলা আনতে হবে। শারীরিক ওজন একটা স্বাস্থ্যকর মাত্রায় থাকতে হবে। এ ছাড়া বংশে এই ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী থাকলে পরিবারের সকল সদস্যের উচিত বয়স ৪৫ পেরোলে কিংবা তার আগে থেকেই নিয়মিত ‘কোলন ক্যান্সার’-এর পরীক্ষা করানো।
এক সময় এই ‘কলোরেক্টা’ ক্যান্সারকে ধরে নেয়া হতো পশ্চিমা বিশ্বের রোগ। কিন্তু তা এখন সত্য নয়। বাংলাদেশেও এই রোগ এখন বেশ দেখা যায়। তবে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রাচুর্য্য, অতিরিক্ত ওজন, অলস জীবনাযাত্রা ইত্যাদির কারণে এই রোগ আজ পুরো বিশ্বেই দেখা যাচ্ছে। এমনকি ৪০ বছরের কম বয়সীদের মাঝেও আজকাল এই রোগ দেখা দিচ্ছে এবং একবার অস্ত্রোপচার, ‘কেমোথেরাপি’ ও ‘রেডিয়েশন থেরাপি’র মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার পর আবার তা ফিরে আসছে। আবার বার বার অস্ত্রোপচার করতে হচ্ছে। একটা কথা বলবো- এসব রোগ হলে বেশ সচেতনতার সঙ্গে চিকিৎসা করুন।
লেখক, সহযোগী অধ্যাপক (কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ) কলোরেক্টাল, লেপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
Leave a Reply