দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী। গতকাল নয়াদিল্লিতে হায়দ্রাবাদ হাউজে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ওই বৈঠকের পর দুই দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ৭টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। পরে আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে আলোচনার বিষয় তুলে ধরেন দুই প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল অভিহিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সমাধান করা অন্যান্য অনেক সমস্যার মতোই তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ সকল অমীমাংসিত সমস্যা শিগগিরই সমাধান হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে এবং আগামী দিনে এ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে বলে মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা, অভিন্ন নদীগুলোর পানি বণ্টন, রোহিঙ্গা, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, মাদক ও মানব পাচার মোকাবিলার মতো পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো প্রাধান্য পায়।
বাংলাদেশ সময় দুপুর ২টার দিকে বৈঠকটি শেষ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবৃতিতে বলেন, ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে পরিচিত।
গত এক দশকে উভয় দেশই বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। দুটি দেশ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার চেতনায় অনেক অমীমাংসিত ইস্যু সমাধান করেছে এবং অবিলম্বে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষর করাসহ সকল অমীমাংসিত ইস্যুর সমাধান আশা করছি।
দুই দেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিসহ ৫৪টি অভিন্ন নদ-নদীর পানি বণ্টনের মতো সব সমস্যার সমাধান করা হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ও তার ভারতীয় সমকক্ষ নরেন্দ্র মোদি আরেক দফা ফলপ্রসূ আলোচনা শেষ করেছেন এবং এর ফলাফল উভয় দেশের জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
তিনি বলেন, আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বৈঠক করেছি। আগামী দিনগুলিতে আমাদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে আমরা দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি আরও বলেন, আলোচনার সময় তারা অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সম্ভাব্য উপায়গুলো সম্পর্কে এবং পারস্পরিক কল্যাণের লক্ষ্যে একে অপরের অগ্রাধিকারগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা বলেন, সংযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, নিরাপত্তা, সীমানা এবং লাইন অব ক্রেডিট সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি। গত ৫০ বছরে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব তৈরি করে উভয় দেশ পারস্পরিক স্বার্থে ক্রমবর্ধমান ব্যাপক বিষয়ে কাজ করছে।
শেখ হাসিনা আরও বলেন, আমি এবং প্রধানমন্ত্রী মোদি আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এবং আমাদের দুই দেশে ও এ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে সম্মত হয়েছি। বাংলাদেশ ও ভারত যদি অংশীদার হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তাহলে এটি শুধু দেশগুলোর জন্যই নয়, বরং সমগ্র অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে। ৫৪টি অভিন্ন নদী এবং ৪ হাজার কিলোমিটার সীমান্ত বেষ্টিত বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত কল্যাণে বদ্ধপরিকর বলেও জানান শেখ হাসিনা।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিবৃতিতে বলেন, গত বছর আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্যাপন করেছি। আমরা প্রথম ‘মৈত্রী দিবস’ উদ্যাপন করেছি। আগামী দিনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। মোদি বলেন, বাংলাদেশ আজ ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার এবং এই অঞ্চলে আমাদের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। জনগণের সহযোগিতায় সম্পর্কের ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে।
আমরা তথ্য প্রযুক্তি, মহাকাশ ও পারমাণবিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিয়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। তিনি আরও বলেন, আমরা বন্যা প্রশমনে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্যা সংক্রান্ত রিয়েল-টাইম ডেটা শেয়ার করছি এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়েও আলোচনা করছি। এটা অপরিহার্য, কারণ আমরা একসঙ্গে সেইসব শক্তির মোকাবিলা করি যেগুলো আমাদের প্রতিপক্ষ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত কয়েক বছরে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করেছি। করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। নরেন্দ্র মোদি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি নদী প্রবাহিত হয় এবং উভয় দেশের মানুষের জীবন-জীবিকার সঙ্গে এসব নদী যুক্ত।
আজ আমরা কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। দুই প্রধানমন্ত্রী হায়দ্রাবাদ হাউজে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে স্বাক্ষরিত ৭টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) বিনিময় প্রত্যক্ষ করেন। উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই সমঝোতা স্মারকগুলো স্বাক্ষরিত হয়।
এগুলো হলো- অভিন্ন সীমান্ত নদী কুশিয়ারা থেকে ভারত ও বাংলাদেশের পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে ভারত সরকারের জলশক্তি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সরকারের পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, ভারতে বাংলাদেশের রেলওয়ে কর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে ভারতের রেল মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশের রেলওয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য এফওআইএস ও অন্যান্য আইটি অ্যাপ্লিকেশনের মতো আইটি সিস্টেমে সহযোগিতার জন্য ভারতের রেল মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশের রেলওয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক।
অন্য সমঝোতা স্মারকগুলো হচ্ছে- ভারতে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল অফিসারদের প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা বৃদ্ধি কর্মসূচির বিষয়ে ভারতের ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে সমঝোতা স্মারক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহযোগিতার বিষয়ে ভারতের কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর) ও বাংলাদেশের কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্টিয়াল রিসার্চ (বিসিএসআইআর) এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক, মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক এবং প্রসার ভারতীয় ও বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)’র মধ্যে সম্প্রচার সহযোগিতা সংক্রান্ত স্মারক।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদি ভার্চ্যুয়ালি খুলনার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মৈত্রী পাওয়ার প্ল্যান্টের ইউনিট-১ যৌথভাবে উদ্বোধন করেন। কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে ভারতীয় উন্নয়ন সহায়তা হিসাবে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি স্থাপন করা হচ্ছে।
চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট এবং কোভিড-১৯ মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই সফরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে বাংলাদেশ ও ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার নিকটতম প্রতিবেশী দেশ দুটি এই সংকটগুলো কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা করেছে। দ্বিপাক্ষিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগে, দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একটি একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে, শেখ হাসিনা হায়দ্রাবাদ হাউসে পৌঁছালে নরেন্দ্র মোদি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেখানে গার্ড অব অনারও প্রদান করা হয়।
এ সময় দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। এ উপলক্ষ্যে একটি ভিডিও ক্লিপে মৈত্রী বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রূপসা সেতু, সড়ক নির্মাণ যন্ত্রপাতি ও মেশিনারি সরবরাহ, খুলনা-দর্শনা রেলওয়ে লাইন এবং পার্বতীপুর কাউনিয়া রেলওয়ে লাইন প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর একটি বই নরেন্দ্র মোদিকে উপহার দেন।
ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশন বইটি প্রকাশ করেছে। শেখ হাসিনা তার সম্মানে হায়দ্রাবাদ হাউজে নরেন্দ্র মোদি আয়োজিত একটি মধ্যাহ্নভোজনেও অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী গতকাল সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে যাওয়ার মাধ্যমে ভারতে তার ৪ দিনের সফরের দ্বিতীয়দিন শুরু করেন। এ সময় নরেন্দ্র মোদি তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভ্যর্থনা জানান। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শেখ হাসিনা রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে যান। সেখানে তিনি এই মহান ভারতীয় নেতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান।
ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও উপ-রাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখারের সঙ্গে গতকাল বিকালে পৃথক সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ভারত সফরের প্রথমদিনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শংকর আইটিসি মৌর্য্য হোটেলে প্রধানমন্ত্রীর স্যুইটের সম্মেলন কক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগা জিয়ারত করেন এবং নফল নামাজ আদায়, ফাতেহা পাঠ ও মুনাজাত করেন।
সফরের তৃতীয়দিন আজ বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়িক ফোরামে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ভারতীয় শহীদ এবং যুদ্ধাহত সৈনিকদের পরিবারের সদস্যদের মাঝে মুজিব স্কলারশিপ প্রদান অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। বৃহস্পতিবার জয়পুরে আজমীর শরীফ যাবেন প্রধানমন্ত্রী। এদিনই তার ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে।
Leave a Reply