আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘সূরা ইয়াসীন (আরবি ভাষায়: سورة يس)’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
সূরা ইয়াসীন (আরবি ভাষায়: سورة يس) পবিত্র কোরআনুল কারিমের ৩৬ তম সূরা, এর আয়াত সংখ্যা ৮৩টি এবং এর রূকুর সংখ্যা ৫টি। সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।
হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুরই একটা হৃদয় থাকে আর কোরআনের হৃদয় হলো সূরা ইয়াসিন।
ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন একবার পড়বে, মহান আল্লাহ তাকে দশবার পুরো কোরআন পড়ার সওয়াব দান করবেন।’ (তিরমিজি)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন, ‘সূরা ইয়াসিন কোরআনের রূহ বা হৃৎপিণ্ড। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের কল্যাণ লাভের জন্য সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে তার জন্য রয়েছে মাগফিরাত বা ক্ষমা।
সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াতের ফজিলত
(তাবেঈ) হযরত আতা ইবনে আবি রাবাহ (রহ.) বলেন, আমার নিকট বিশ্বস্ত সূত্রে একথা পৌঁছেছে যে,
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
যে ব্যক্তি দিনের প্রথম দিকে (অর্থাৎ ফজরের পর) “সূরা ইয়াসিন পড়বে, তার সমস্ত হাজত আল্লাহ তায়ালা পূর্ণ করে দিবে।
(দারেমী মুরসালরূপে)
মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসিন পাঠ করা
হযরত মাকেল ইবনে ইয়াসার মুযানী (রা.) বলেন, নবী কারীম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শুধু সন্তোষলাভের উদ্দেশ্যে “সূরা ইয়াসিন ” পড়ে, তার পূর্ববর্তী গোনাহ সমূহ মাফ করা হবে।
সুতরাং তোমরা তোমাদের মৃত ব্যক্তির নিকট তা পড়। (বাইহাকী-শুআবুল ঈমান)
সুরা ইয়াসিন কোরানের হৃদয়ঃ
তাফসিরে জালালাইনশরীফের হাশিয়া ৩৬৮ পৃষ্ঠার মধ্যে বায়জাভী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একখানা হাদীসশরীফ নকল করা হয়েছে- ‘রাসূলেপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, নিশ্চয় প্রত্যেক বস্তুর ‘কলব’ রয়েছে এবং কোরআনশরীফের কলব হচ্ছে ‘সূরায়ে ইয়াসিনশরীফ’।
হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর একটি হৃদয় আছে। আল-কোরআনের হৃদয় হলো সূরা ইয়াসিন। যে ব্যক্তি একবার সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তায়ালা ১০ বার কোরআন খতমের সওয়াব দেবেন।’ (তিরমিজি : ২৮৯১)।
সুরা ইয়াসিন গুনাহ মাফের মাধ্যমঃ
মানুষ মাত্রই দৈনন্দিন কাজকর্মে ভুল-ত্রুটি করে থাকে। ভুল-ত্রুটি করা হলো গোনাহের কাজ। গোনাহের কাজ মানুষকে জাহান্নামের দিকে ধাবিত করে। জাহান্নাম থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হলো নেক আমল বা তওবা করা। যে ব্যক্তি নিয়মিত সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তায়ালা সন্তুষ্ট হয়ে তার অতীত জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।
হজরত মাকাল বিন ইয়াসার (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তার অতীত জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৩১২১, বায়হাকি : ২১৭৮)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাতে সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, আল্লাহ তার ওই রাতের সব গোনাহ মাফ করে দেবেন।’ (সুনানে দারেমি : ৩৪৬০)।
সুরা ইয়াসিন হাজত (প্রয়োজন) পূরণের মাধ্যমঃ
মানুষ মাত্রই অবস্থান অনুযায়ী নানা ধরনের অভাব-অনটনে বা হাজত থাকে। শুধু পরিশ্রম করে কিংবা অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে অভাব-অনটন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না।
পরিশ্রমকারী বা অর্থ উপার্জনকারীর ওপর আল্লাহর বিশেষ রহমত থাকতে হয়। সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত-বরকত আসে। সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করলে মনের হাজত বা মনের আশা পূর্ণ হয়।
হজরত আতা বিন আবি রাবাহ (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শুনেছি যে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দিনের বেলায় সূরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করবে, তার সব হাজত পূর্ণ করা হবে।’ (সুনানে দারেমি : ৩৪৬১)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রা: বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি সূরা ইয়াসিন অভাব-অনটনের সময় পাঠ করে তাহলে তার অভাব দূর হয়, সংসারে শান্তি ও রিজিকে বরকত লাভ হয়।
(মাজহারি) ইয়াহইয়া ইবনে কাসীর বলেন, ‘যে ব্যক্তি সকালে সূরা ইয়াসিন পাঠ করবে সে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুখে-স্বস্তিতে থাকবে। যে সন্ধ্যায় পাঠ করবে সে সকাল পর্যন্ত শান্তিতে থাকবে (মাজহারি)।
সুরা ইয়াসিন মৃত্যু-কষ্ট লাঘবের মাধ্যমঃ
যদি কোন মুসলমানের সকরাতুল মউতের সময় তার নিকট সূরায়ে ইয়াসিনশরীফ পাঠ করা হয়, বেহেশত হতে রেদওয়ান ফেরেশতা, বেহেশতের সুসংবাদ না দেওয়া পর্যন্ত মালাকুল মউত তার রূহ কবজ করবেন না। রূহ কবজের সঙ্গে সঙ্গে সে ব্যক্তি ‘রাইয়ান’ নামক বেহেশতে থাকবে।
(হাশিয়ায়ে জালালাইনশরীফ- ৩৬০ পৃ.) হজরত আবু যর (রা:) বলেন, আমি রাসূল সা:-এর কাছ থেকে শুনেছি তিনি বলেছেন, মৃত্যু পথযাত্রী ব্যক্তির কাছে সূরা ইয়াসিন পাঠ করলে তার মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ হয়ে যায়। (মাজহারি) হযরত মা’কিল ইবনে ইয়াসার ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত।
তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “এটা তোমাদের মুমূর্ষু ব্যক্তিদের নিকট পাঠ করো।” অর্থাৎ সূরা ইয়াসীন। -( আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাযাহ, মুসনাদে আহমাদ ) ইমাম আহমাদ ( রঃ ) বলেছেন- আমাদের প্রবীণরা বলতেন, মুমূর্ষু ব্যক্তির নিকট সূরা ইয়াসীন পাঠ করা হলে আল্লাহ তাঁর কষ্ট লাঘব করে দেন।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা- ১৫৪ ) আল্লাহর সাহায্য ছাড়া ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কোরআন তেলাওয়াত হলো বিপদাপদ এবং জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত লাভের উত্তম উছিলা। দুনিয়াবি সব ধরনের পেরেশানি থেকে মুক্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে, সূরা ইয়াসিন বেশি বেশি তেলাওয়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা সবাইকে তৌফিক দান করুন।
Leave a Reply