রবিবার, ২৮ মে ২০২৩, ১১:১১

সূরা আল-মুনাফিকুন‌

সূরা আল-মুনাফিকুন‌

ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান / ১৮৬
প্রকাশ কাল: শুক্রবার, ৫ মে, ২০২৩

আজ শুক্রবার পবিত্র জুমাবার আজকের বিষয় ‘সূরা আল-মুনাফিকুন‌’ শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেনইসলাম বিভাগ প্রধান ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান

সূরা আল-মুনাফিকুন‌ (আরাবী ভাষা: المنافقون) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরানের ৬৩ তম সুরা , এর আয়াত অর্থাৎ বাক্য সংখ্যা ১১ এবং রুকু তথা অনুচ্ছেদ সংখ্যা ২। সূরা আল-মুনাফিকুন মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে।

নামকরণ
এই সূরাটির প্রথম আয়াতের إِذَا جَاءَكَ الْمُنَافِقُونَ বাক্যাংশের الْمُنَافِقُونَ অংশ থেকে এই সূরার নামটি গৃহীত হয়েছে; অর্থাৎ, যে সূরার মধ্যে المنافقون (‘মুনাফিকুন‌’) শব্দটি আছে এটি সেই সূরা।

নামকরণ
প্রথম আয়াতের অংশ থেকে এ সূরার নাম গ্রহণ করা হয়েছে । এটি এ সূরার নাম এবং বিষয়বস্তু শিরোনামও । কারণ এ সূরায় মুনাফিকদের কর্মপদ্ধতির সমালোচনা করা হয়েছে।

নাযিল হওয়ার সময়-কাল
বনী মুসতালিক যুদ্ধভিযান থেকে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ফিরে আসার সময় পথিমধ্যে অথবা মদীনায় পৌছার অব্যবহিত পরে এ সূরা নাযিল হয়েছিল । ৬ হিজরীর শা’বান মাসে বনী মুসতালিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল একথা আমরা সূরা নূরের ভূমিকায় ব্যাখ্যা -বিশ্লেষণসহ বর্ণনা করেছি । এভাবে এর নাযিল হওয়ার সময় সঠিকভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায় । এ বিষয়ে আমরা পরে আরো আলোচনা করব।

ঐতিহাসিক পটভূমি
যে বিশেষ ঘটনার পরিপ্রক্ষিতে এ সূরা নাযিল হয়েছিল তা আলোচনার পূর্বে মদীনার মুনাফিকদের ইতিহাসের দিকে একবার দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন । কারণ ঐ সময়ে যে ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল তা আদৌ কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিল না । বরং তার পেছনে ছিল একটি পুরো ধারাবাহিক ঘটনা প্রবাহ যা পরিশেষে এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল।

পবিত্র মদীনা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমনের পূর্বে আওস ও খাযরাজ গোত্র দুটি পারস্পরিক গৃহযুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছিল। তারা যথারীতি তাকে বাদশাহ বানিয়ে তার অভিষেক অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিও শুরু করেছিল। এমন কি তার জন্য রাজ মুকুটও তৈরী করা হয়েছিল। এ ব্যক্তি ছিল খাযরাজ গোত্রের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে উবাই ইবনে সালূল।

মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক বর্ণনা করেন, খাযরাজ গোত্রে তার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ছিল সর্বসম্মত এবং আওস ও খাযরাজ ইতিপূর্বে আর কখনো একযাগে এক ব্যক্তির নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। (ইবনে হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৩৪)।

এই পরিস্থিতিতে ইসলামের বাণী মদীনায় পৌছে এবং এই দুটি গোত্রের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করতে শুরু করে। হিজরাতের আগে আকাবার দ্বিতীয় বাইয়াতের সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যখন মদীনায় আগমনের জন্য আহবান জানানো হচ্ছিল তখন হযরত আব্বাস ইবনে উবাদা ইবনে নাদলা (রা) আনসারী এ আহবান জানাতে শুধু এ কারণে দেরী করতে চাচ্ছিলেন যাতে আবদুল্লাহ ইবনে উবাইও বাইয়াত ও দাওয়াতে শামিল হয় এবং এভাবে মদীনা যেন সর্বসম্মতিক্রমে ইসলামের কেন্দ্র হয়ে ওঠে।

কিন্তু যে প্রতিনিধি দল বাইয়াতের জন্য হাজির হয়েছিল তারা এই যুক্তি ও কৌশলকে কোন গুরুত্বই দিলেন না এবং এতে অংশগ্রহণকারী দুই গোত্রের ৭৫ ব্যক্তি সব রকম বিপদ মাথা পেতে নিয়ে নবী (সা) কে দাওয়াত দিতে প্রস্তুত হয়ে গেল। (ইবনে হিশাম, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৮৯) আমরা সূরা আনফালের ভূমিকায় এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ পেশ করেছি।

এরপর নবী (সা) যখন মদীনায় পৌছলেন তখন আনসারদের ঘরে ঘরে ইসলাম এতটা প্রসার লাভ করেছিল যে, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই নিরূপায় হয়ে পড়েছিল। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষার জন্য তার নিজের জন্য ইসলাম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।

তাই সে তার বহু সংখ্যক সহযোগী ও সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করে। এদের মধ্যে উভয় গোত্রের প্রবীণ ও নেতৃত্ব পর্যায়ের লোকেরা । অথব তাদের সবার অন্তর জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছিল।

বিশেষ করে আবদুল্লাহ ইবনে উবায়ের অন্তরজ্বালা ও দুঃখ ছিল অত্যন্ত তীব্র। কারণ সে মনে করতো, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার রাজত্ব ও বাদশাহী ছিনিয়ে নিয়েছেন। তার এই মুনাফেকীপূর্ণ ঈমান এবং নেতৃত্ব হারানোর দুঃখ কয়েক বছর ধরে বিচিত্র ভঙ্গিতে প্রকাশ পেতে থাকল।

একদিকে তার অবস্থা ছিল এই যে, প্রতি জুমআর দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বরে উঠে বসতেন তখন আবদুল্লাহ ইবনে উবাই উঠে বলতো, “ভাইসব, আল্লাহর রসূল আপনাদের মধ্যে বিদ্যমান। তাঁর কারণে আল্লাহ তা’আলা আপনাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন। তাই আপনারা সবাই তাঁকে সাহায্য, সহযোগিতা করুন। এবং তিনি যা বলেন গভীর মনযোগ সহকারে শুনুন এবং তার আনুগত্য করুন। “(ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা, ১১১)।

অপরদিকে অবস্থা ছিল এই যে, প্রতিদিনই তার মুনাফেকীর মুখোশ খুলে পড়ছিল এবং সৎ ও নিষ্ঠাবান মুসলমানদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, সে ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা ইসলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ঈমানদারদের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা পোষণ করে।

একবার নবী (সা) কোন এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় পথে আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তাঁর সাথে অভদ্র আচরণ করে।

তিনি হযরত সা’দ ইবনে উবাদাকে বিষয়টি জানালে সা’দ বললেন, “হে আল্লাহর রসূল, আপনি এ ব্যক্তির প্রতি একটু নম্রতা দেখান। আপনার আগমনের পূর্বে আমরা তার জন্য রাজমুকুট তৈরী করেছিলাম। এখন সে মনে করে, আপনি তার নিকট থেকে রাজত্ব ছিনিয়ে নিয়েছেন। “ (ইবনে হিশাম, তৃতীয় খন্ড , পৃষ্ঠা ২৩৭, ২৩৮

শানে নুজুল

মদিনার মোনাফেক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অনেক কাহিনী খোদ কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মোনাফেক চক্রের নাম অনুসারে ২৮ পারার ৬৩ নং সূরাটির নাম করা হয়েছে ‘মোনাফিকুন’ নামে। এ সূরার ৭ ও ৮ নং আয়াতে মোনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের যে কাহিনীর প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে তা প্রণিধানযোগ্য।

আয়াত দ্বয়ের অর্থ হচ্ছে: ‘ওরা বলে, তোমরা আল্লাহর রাসূল (সা:)-এর সহচরদের জন্য ব্যয় করো না, যাতে ওরা সরে পড়ে। আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীর ধন ভান্ডার তো আল্লাহরই, কিন্তু মোনাফেকগণ তা বুঝে না।’ ‘ওরা বলে, তোমরা মদিনায় প্রত্যাবর্তন করলে তথা হতে প্রবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিষ্কার করবে। কিন্তু শক্তি তো আল্লাহরই, আর তাঁর রাসূল ও মোমেনদের।

তবে মোনাফেকগণ এটা জানে না।’
এ দু’টি আয়াত এর ‘শানে-নুজুল’ বা অবতীর্ণ হওয়া বিষয়ে এমন একটি ঘটনা রয়েছে, যার সাথে জড়িত রয়েছে মোনাফেক আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের মিথ্যাচার ও একজন কমবয়সী সাহাবীকে মিথ্যাবাদী রূপে প্রতিপন্ন করার ঘৃণ্য অপচেষ্টা।

ঘটনাটি নিম্নরূপ: ‘বনু মোছতালেক’ নামক বিখ্যাত যুদ্ধ সংঘটিত হয় হিজরী পঞ্চম সালে। এ সময় একজন মোহাজের ও একজন আনসারের মধ্যে পরস্পর ঝগড়া বেঁধে যায়। অতি সাধারণ এ ব্যাপারটি তীব্র আকার ধারণ করে। তারা উভয়ে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাহায্য প্রার্থনা করে।

উভয়পক্ষের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। কিন্তু কিছু লোক মধ্যস্থতা করে সন্ধি করিয়ে দেয়, ব্যাপারটি এখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মোনাফেকদের গুরু ঠাকুর আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই ছিল মুসলমানদের চরম বিরোধী। ঘটনাটির শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হয়ে যাওয়া তার কাছে অসহ্য ছিল।

সে ঘটনাটি জানার পর রসূলূল্লাহ (সা:)-এর শানে অশালীন উক্তি করে এবং বন্ধু-বান্ধবদের উদ্দেশ্যে বলে; ‘এসব ঘটনার জন্য তোমরাই দায়ী, তোমাদের কারণেই এসব ঘটেছে। তোমরা এসব লোককে তোমাদের শহরে আশ্রয় দিয়েছ, ধন-সম্পদ তাদের মধ্যে আধা-আধি ভাগ করে দিয়েছ।

যদি তোমরা তাদের সাহায্য করা বন্ধ করে দাও, তা হলে তারা এখনই চলে যেতে বাধ্য হবে।’ সে আরও বলে; আল্লাহর কসম! আমরা মদীনায় পৌঁছলে আমরা সম্মানিত ব্যক্তিরা মিলিতভাবে নিকৃষ্টদের সেখান হতে বহিষ্কার করব।’
 তার ধৃষ্টতাপূর্ণ উক্তিগুলো সেখানে উপস্থিত কমবয়স্ক সাহাবী হজরত জায়দ ইবনে আরকাম (রা:) শুনছিলেন।

তিনি রাগে ক্ষোভে বলে উঠেন; ‘আল্লাহর কসম! তুমিই নিকৃষ্ট, তোমার সম্প্রদায়ের মধ্যে তোমাকে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তোমার কোন সমর্থনকারী নেই। রসূলুল্লাহ (সা:) সম্মানিত, আল্লাহর পক্ষ হতে তাকে সম্মান প্রদান করা হয়েছে এবং তিনি তাঁর কওমের মধ্যে সম্মানের অধিকারী।’

এ কথা শোনবার পর আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই বলে; ‘আচ্ছা, হয়েছে এবার চুপ কর। আমি তো মশকরা করে বলেছি।’ হজরত জায়দ (রা:) রসূূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট গিয়ে মোনাফেকের সব কথা বলেদেন।

হযরত উমর (রা:) ঘটনার কথা শুনে রসূলুল্লাহ (সা:)-এর নিকট অনুরোধ জানান যে, এ কাফেরকে হত্যা করা হোক। কিন্তু হুজুর (সা:) হত্যার অনুমতি দিলেন না।

এ খবর অবগত হওয়ার পর আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই হুজুর (সা:)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে মিথ্যা শপথ করে বলে; সে এরূপ বাক্য উচ্চারণ করেনি। জায়দ মিথ্যা বলেছেন। আনসারদের কিছু লোকও উপস্থিত হয়ে হুজুর (সা:)-এর নিকট সুপারিশ করে যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাই তাদের সম্প্রদায়ের নেতা, সে বড় লোকদের অন্তর্ভুক্ত। একজন বাচ্চার কথা তার মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

সম্ভবত শ্রবণে কিংবা বুঝাতে তার ভুল হয়ে গেছে। রসূলুল্লাহ (সা:) আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের উজর গ্রহণ করলেন এবং হযরত জায়দের কথা প্রত্যাখ্যান করলেন। অত:পর তিনি লজ্জায় কোথাও বের হওয়া বন্ধ করে দেন।

এমতাবস্থায় সূরা ‘মোনাফিকুন’ নাজিল হলে তার সম্মান বেড়ে যায় এবং আব্দুল্লাহ ইবনে ওবাইয়ের মোনাফেকি চরিত্র ফাঁস হয়ে যায়। মোনাফেক চক্র ইসলামের শুরু থেকে যুগে যুগে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি ও সর্বনাশ করার জন্য নানাভাবে অপতৎপরতা চালাতে থাকে এবং আজও তা অব্যাহত রয়েছে।

নানা দেশে ওদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও তৎপরতা বহু রাষ্ট্রেরও পতন ঘটিয়েছে। ওদের চেনা যেমন অতি প্রয়োজন, ওদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা আরও অধিক প্রয়োজন। আল্লাহ তায়ালা মোনাফেকদের স্থান নির্ধারণ করেছেন জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে- ‘আসফালুস সাফেলিন’।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2022