আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘সূরা তাহরীম কুরআন শরীফের ৬৬তম সূরা’।
শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
সূরা আত-তাহরীম (আরাবী ভাষায় : التّحريم) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরানের ৬৬ তম সুরা, এর আয়াতবা বাক্য সংখ্যা ১২ এবং রুকু তথা অনুচ্ছেদ সংখ্যা ২। সূরা আত-তাহরীম মদিনায় অবতীর্ণ হয়।
দ্রুত তথ্য শ্রেণী, নামের অর্থ …
নামকরণ
এই সূরাটির প্রথম আয়াতের لِمَ تُحَرِّمُ বাক্যাংশ থেকে এই সূরার নামটি গৃহীত হয়েছে; অর্থাৎ, যে সূরার মধ্যে التّحريم (‘তাহরীম’) শব্দটি আছে এটি সেই সূরা।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
এ সূরার মধ্যে তাহরীম সম্পর্কিত যে ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে সে সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসের বর্ণনাসমূহে দু’জন মহিলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা দুজনই নবীর (সা) স্ত্রী। তাঁদের একজন হলেন হযরত সাফিয়া (রা) অন্যজন হযরত মারিয়া কিবতিয়া (রা)।
তাদের মধ্যে একজন অর্থাৎ হযরত সাফিয়া (রা) খায়বার বিজয়ের পরে নবীর (সা) সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আর সর্বসম্মত মতে খায়বার বিজিত হয় ৭ম হিজরীতে। দ্বিতীহ মহিলা হযরত মারিয়াকে (রা) মিসরের শাসক মুকাওকিস ৭ম হিজরী সনে নবীর(সা) খেদমতের জন্য পাঠিয়েছিলেন।
৮ম হিজরীর যুলহাজ্জ মাসে তাঁরই গর্ভে নবীর(সা) পুত্র সন্তান হযরত ইবরাহীম (রা) জন্ম লাভ করেন। এসব ঐতিহাসিক ঘটনা থেকে এ বিষয়টি প্রায় সুনির্দিষ্ট হয়ে যায় যে, এ সূরাটি ৭ম অথবা ৮ম হিজরীর কোন এক সময় নাযিল হয়েছিল।
বিষয়বস্তু ও মুল বক্তব্য
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূরা । এ সূরার মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সল্লামের পবিত্র স্ত্রীগণের সাথে জড়িত কিছু ঘটনার প্রতি ইংগিত দিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।
একঃ হালাল হারাম এবং জায়েজ নাজায়েযের সীমা নির্ধারণ করার ইখতিয়ার চূড়ান্তভাবে আল্লাহ তা’আলার হাতে। সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা খোদ আল্লাহ তা’আলার নবীর (সা) কাছেও তার কোন অংশ হস্তান্তার করা হয়নি।
নবী হিসেবে কোন জিনিসকে হারাম বা হালাল ঘোষণা করতে পারেন কেবল তখনই যখন এ বিষয়ে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে কোন ইংগিত থাকে। সে ইংগিত কুরআন মজীদে নাযিল হয়ে থাক কিংবা তা অপ্রকাশ্য অহীর মাধ্যমে নাযিল হয়ে থাক তাতে কিছু এসে যায় না। কিন্তু খোদ আল্লাহ কর্তৃক মোবাহকৃত কোন জিনিসকে নিজের পক্ষ থেকে হারাম করে নেয়ার অনুমতি কোন নবীকেও দেয়া হয়নি । এ ক্ষেত্রে অন্য কোন মানুষের তো প্রশ্নই ওঠে না।
দুইঃ মানব সমাজে নবীর স্থান ও মর্যাদা অত্যন্ত নাজুক । একটি সাধারণ কথা যা অন্য কোন মানুষের জীবনে সংঘটিত হলে তা তেমন কোন গুরুত্বই বহন করে না, কিন্তু অনুরূপ ঘটনাই নবীর জীবনে সংঘটিত হলে আইনের মর্যাদা লাভ করে।
তাই আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে অত্যন্ত কঠোরভাবে নবী-রসূলদের জীবন পর্যবেক্ষণ ও তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে তাদের অতি ক্ষুদ্র কোন পদক্ষেপও আল্লাহর ইচ্ছার পরিপন্থি না হয়। নবীর দ্বারা এমন কোন ক্ষুদ্র কাজও সংঘটিত হয়ে গেলে সংগে সংগে তা সংশোধন করে দেয়া হয়েছে, যাতে ইসলামী আইন ও তার উৎস সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ রূপে শুধু আল্লাহর কিতাব আকারে নয় বরং নবীর “উসওয়ায়ে হাসানা” বা উত্তম জীবন আদর্শরূপে আল্লাহর বান্দাদের কাছে পৌছে এবং তার মধ্যে অণু পরিমাণও এমন কোন জিনিস সংমিশ্রিত হতে না পারে, আল্লাহর ইচ্ছা ও মর্জির সাথে যার কোন মিল নেই ।
তিনঃ ওপরে বর্ণিত মূলনীতির আলোকে আপনা থেকেই যে বিষয়টি বুঝা যায় তা এই যে, একটি ক্ষুদ্র বিষয়েও যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ভুল দেখিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তা শুধু সংশোধনই করা হয়নি, বরং রেকর্ডভুক্তও করা হয়েছে তখন তা অকাট্যভাবে আমাদের মনে এ আস্থা সৃষ্টি করে যে, নবীর (সা) পবিত্র জীবনকালে যেসব কাজকর্ম ও হুকুম-আহকাম বর্তমানে আমরা পাচ্ছি, এবং যেসব কাজকর্ম ও হুকুম আহকাম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে কোন তিরস্কার ব সংশোধনী রেকর্ডে নেই তা পুরোপুরি সত্য ও নির্ভুল এবং আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সম্পূর্ণরূপে সংগতিপূর্ণ । ঐ সব কাজকর্ম ও আদেশ নিষেধ থেকে আমরা পূর্ণ আস্থার সাথে হিদায়াত ও পথনির্দেশ গ্রহণ করতে পারি ।
কুরআন মজীদের এই বাণী থেকে চতুর্থ যে বিষয়টি সামনে আসে তা হচ্ছে, যে পবিত্র রসূলের সম্মান ও মর্যাদাকে আল্লাহ নিজে বান্দাদের ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংগ হিসেবে গণ্য করেন সেই রসূল সম্পর্কে এ সূরাতে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তিনি তাঁর স্ত্রীদের খুশী করার জন্য একবার আল্লাহর হালালকৃত একটি জিনিসকে নিজের জন্য হারাম করে নিয়েছিলেন। আর নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণ, আল্লাহ নিজে যাদেরকে ঈমানদারদের মা বলে ঘোষণা করেন এবং যাঁদেরকে সম্মান করার জন্য তিনি নিজে মুসলমানদের নির্দেশ দিয়েছেন কিছু ভুল-ত্রুটির জন্য তাদেরকেই আবার তিনি কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন।
তাছাড়া নবীকে তিরস্কার এবং তার স্ত্রীদেরকে সাবধান চুপিসারে করা হয়নি, বরং তা সেই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যা সমস্ত উম্মাতকে চিরদিন পড়তে হবে। আল্লাহ তা’আলা তার রসূল এবং উম্মুল মু’মিনীনদেরকে ঈমানদারদের দৃষ্টিতে হেয়প্রতিপন্ন করার অভিপ্রায়ে তাঁর কিতাবে এসব উল্লেখ করেননি।
আল্লাহ তা’আলার এরূপ কোন অভিপ্রায় ছিল না, কিংবা তা থাকতেও পারে না। একথা স্পষ্ট যে, পবিত্র কুরআনের এ সূরা পাঠ করে কোন মুসলমানের অন্তর থেকে তাদের সম্মান ও মর্যাদা উঠে যায়নি । তাহলে কুরআনে এ কথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কি হতে পারে যে, আল্লাহ তা’আলা ঈমানদারদেরকে তাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে সম্মান প্রদর্শনের সঠিক সীমারেখার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চান।
নবীগণ কেবল নবীই, তাঁরা খোদা নন যে, তাদের কোন ভুল -ত্রুটি হতে পারে না । বরং নবীর মর্যাদা এ কারণে যে, তিনি আল্লাহর ইচ্ছার পূর্ণাঙ্গ বাস্তব রূপ । তাঁর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভুল -ত্রুটিকেও আল্লাহ সংশোধন না করে ছেড়ে দেননি। এভাবে আমরা এ আস্থা ও প্রশান্তি লাভ করি যে, নবীর রেখে যাওয়া আদর্শ আল্লাহর ইচ্ছার বাস্তব প্রতিনিধিত্ব করছে।
একইভাবে সাহাবা কিরাম হোন বা নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণ হোন, তাঁরা সবাই মানুষ ছিলেন, ফেরেশতা বা মানব সত্তার উর্ধে ছিলেন না। তাদেরও ভুল-ত্রুটি হওয়া সম্ভব ছিল । তাঁরা যে মর্যাদা লাভ করেছিলেন তার কারণ ছিল এই যে, আল্লাহর রসূলের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাদেরকে মানবতার সর্বোত্তম নমুনা বানিয়ে দিয়েছিল। তাদের যা কিছু সম্মান ও মর্যাদা তা এ কারণেই । তাঁরা ভুল-ত্রুটি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন এরূপ অনুমান ও মনগড়া ধারণার ওপর তাদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত নয়।
এ কারণেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কল্যাণময় যুগে সাহাবা কিরাম কিংবা নবীর (সা) পবিত্র স্ত্রীগণের দ্বারা মানবিক দুর্বলতার কারণে যখনই কোন ভুল-ত্রুটি সংঘটিত হয়েছে তখনই তাদের সতর্ক করা হয়েছে ও ভুল -ত্রুটি ধরিয়ে দেয়া হয়েছে । নবী (সা) নিজেও তাদের কিছু কিছু ভুল-ত্রুটি সংশোধন করেছেন যা হাদীস গ্রন্থসমূহের বহু সংখ্যক জায়গায় উল্লেখ আছে।
আল্লাহ তা’আলা নিজেও কুরআন মজিদে তাদের কিছু কিছু ভুল-ত্রুটির উল্লেখ করে তা সংশোধন করেছেন যাতে মুসলামনগণ কখনেই তাদের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে সম্মান দেখানোর এমন কোন অতিরঞ্জিত ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে না নেয় যা তাদেরকে মানুষের পর্যায় থেকে উঠেয়ে আল্লাহর মর্যাদার বসিয়ে না দেয়। আপনি যদি চোখ খুলে কুরআম মজীদ অধ্যয়ন করেন তাহলে আপনার সামনে এর দৃষ্টান্ত একের পর এক আসতে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা সূরা আলে ইমরানে ওহুদ যুদ্ধের আলোচনা প্রসংগে সাহাবা কিরামদের সম্বোধন করে বলেছেনঃ
“আল্লাহ তা’আলা (সাহায্য -সহযোগিতার ) যে প্রতিশ্রুতি তোমাদের দিয়েছিলেন তা তিনি পূরণ করেছেন যখন তোমরা তাদেরকে তাঁর ইচ্ছায় হত্যা করছিল । অবশেষে তোমরা যখন দুর্বলতা দেখালে এবং কাজের ব্যাপারে মতানৈক্য করলে আর যে জিনিসের আকাংখা তোমরা করছিলে আল্লাহ তা’আলা যেই মাত্র তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন (অর্থাৎ গণিমতের সম্পদ) তখনই তোমরা তার হুকুমের নাফরমানি করে বসলে। তোমাদের মধ্যে কেউ ছিল পার্থিব স্বার্থের প্রত্যাশী এবং কেউ ছিলে আখেরাতের প্রত্যাশী। এ অবস্থায় তোমাদের পরীক্ষার জন্য আল্লাহ তাদের মোকাবেলায় তোমাদের পরস্ত করে দিলেন। আল্লাহ ঈমানদারদের প্রতি অত্যন্ত সদয়, ও মেহেরবান । (আয়াত ১৫২)।
Leave a Reply