আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘সূরা আল-কলম’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
সূরা আল-কলম (আরাবী ভাষায় القلم) মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুর-আনের ৬৮ তম সুরা , এর আয়াত অর্থাৎ বাক্য সংখ্যা ৫২ এবং রুকু তথা অনুচ্ছেদ সংখ্যা ২। সূরা আল-কলম মককায় অবতীর্ণ হয়েছে।
নাযিল হওয়ার সময়-কাল
এটিও মক্কী জীবনের প্রথম দিকে নাযিল হওয়া সূরা সমূহের অন্যতম। তবে এর বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট হয় যে, এ সূরাটি যে সময় নাযিল হয়েছিলো তখন মক্কা নগরীতে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিলো।
কলমের অর্থ এবং কলমের ফযীলতঃ
এখানে কলমের অর্থ সাধারন কলমও হতে পারে। এতে ভাগ্যলিপির কলম এবং ফেরেশতা ও মানবের লেখার কলম অন্তর্ভুক্ত। এখানে বিশেষতঃ ভাগ্যলিপির কলমও বোঝানো যেতে পারে। হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) – এর উক্তি তাই।
এই বিশেষ কলম সম্পর্কে হযরত ওবাদা ইবনে সাবেত (রাঃ) – এর রেওয়ায়েতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ সর্বপ্রথম আল্লাহ্ তায়ালা কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার আদেশ করেন। কলম আরয করলঃ কি লিখব? তখন খোদায়ী তকদীর লিপিবদ্ধ করতে আদেশ করা হল।
কলম আদেশ অনুযায়ী অনন্তকাল পর্যন্ত সম্ভাব্য সকল ঘটনা ও অবস্থা লিখে দিল। সহীহ্ মুসলিমে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ আল্লাহ্ তায়ালা সমগ্র সৃষ্টির তকদীর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বে লিখে দিয়েছিলেন।
হযরত কাতাদাহ্ (রহঃ) বলেনঃ কলম আল্লাহ্ প্রদত্ত একটি বড় নেয়ামত। কেউ কেউ বলেছেনঃ আল্লাহ্ তায়ালা সর্বপ্রথম তকদীরের কলম সৃষ্টি করেছেন। এই কলম সমগ্র সৃষ্টজগৎ ও সৃষ্টির তকদীর লিপিবদ্ধ করেছে। এরপর দ্বিতীয় কলম সৃষ্টি করেছেন।
এই কলম দ্বারা পৃথিবীর অধিবাসীরা লিখে এবং লিখবে। সূরা ইক্রার “আল্লামা বিল্ক্বলামি” আয়াতেও এই কলমের উল্লেখ আছে।
সারকথা, আয়াতে কলম এবং কলম দ্বারা যা কিছু লেখা হয়, তার শপথ করে আল্লাহ্ তায়ালা কাফেরদের দোষারোপ খণ্ডন করে বলেছেনঃ “মা~আনতা বিনি’মাতি রব্বিকা বিমাজ্বনুন্” অর্থাৎ, আপনি আপনার পালনকর্তার অনুগ্রহে ও কৃপায় কখনও পাগল নন।
এখানে “বিনি’মাতি রব্বিকা” যোগ করে দাবীর স্বপক্ষে দলীলও দেয়া হয়েছে যে, যার প্রতি আল্লাহ্র অনুগ্রহ ও কৃপা থাকে, সে কিরূপে পাগল হতে পারে? তাকে যে পাগল বলে, সে নিজেই পাগল।
আলেমগন বলেনঃ কুরআন পাকে আল্লাহ্ তায়ালা যে বস্তুর শপথ করেন, তা শপথের বিষয়বস্তুর পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমান হয়ে থাকে। এখানে “অমা-ইয়াস্ত্বুরুন্” বলে বিশ্ব-ইতিহাসের যা কিছু লিখা হয়েছে এবং লিখা হচ্ছে, তাকে সাক্ষ্য-প্রমানরূপে উপস্থিত করা হয়েছে।
বলা হয়েছে, বিশ্ব-ইতিহাসের পাতা খুলে দেখ, এমন মহান চরিত্র ও কর্মের অধিকারী ব্যক্তি পাগল হতে পারে কি? এরূপ ব্যক্তি তো অপরের জ্ঞান-বুদ্ধির সংস্কারক হয়ে থাকে। অতঃপর উপরোক্ত বিষয়বস্তুর সমর্থনে বলা হয়েছে।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
এতে তিনটি মূল বিষয় আলোচিত হয়েছে। বিরোধীদের আপত্তি ও সমালোচনার জবাব দান, তাদেরকে সতর্কীকরণ ও উপদেশ দান এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ধৈর্যধারণ ও অবিচল থাকার উপদেশ দান।
বক্তব্যের শুরুতেই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলা হয়েছে , এসব কাফের তোমাকে পাগল বলে অভিহিত করছে। অথচ তুমি যে কিতাব তাদের সামনে পেশ করছো এবং নৈতিকতার যে উচ্চ আসনে তুমি অধিষ্ঠিত আছো তা-ই তাদের এ মিথ্যার মুখোশ উন্মোচনের জন্য যথেষ্ট। শিগগিরই এমন সময় আসবে যখন সবাই দেখতে পাবে , কে পাগল আর কে বুদ্ধিমান।
অতএব তোমার বিরুদ্ধে বিরোধিতার যে তাণ্ডব সৃষ্টি করা হচ্ছে তা দ্বারা কখনো প্রভাবিত হয়ো না। আসলে তুমি যাতে কোন না কোনভাবে প্রভাবিত হয়ে তাদের সাথে সমঝোতা (Compromise) করতে রাজী হয়ে যাও, এ উদ্দেশ্যই এ কাজ করা হচ্ছে।
অতপর সাধারণ মানুষকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার জন্য বিরুদ্ধবাদীদের মধ্য থেকে একজন গন্যমান্য ব্যক্তির কার্যকলাপ তুলে ধরা হয়েছে। এ ব্যক্তিকে মক্কাবাসীরা খুব ভাল করে জানতো।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূত-পবিত্র নৈতিক চরিত্রও তাদের সবার কাছে ষ্পষ্ট ছিলো। মক্কার যেসব নেতা তাঁর বিরোধিতায় সবার অগ্রগামী তাদের মধ্যে কোন ধরনের চরিত্র সম্পন্ন লোক শামিল রয়েছে তা যে কেউ দেখতে পারতো।
এরপর ১৭ থেকে ৩৩ আয়াত পর্যন্ত একটি বাগানের মালিকদের উদাহরণ পেশ করা হয়েছে। আল্লাহর নিয়ামত লাভ করেও তারা সে জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেনি। বরং তাদের মধ্যকার সর্বোত্তম ব্যক্তিটির কথাও তারা যথাসময়ে মেনে নিয়নি।
অবশেষে তারা সে নিয়ামত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। যখন তাদের সবকিছুই ধ্বংস ও বরবাদ হয়ে গিয়েছে তখনই কেবল তাদের চেতনা ফিরেছে। এ উদাহরণ দ্বারা মক্কীবাসীকে এভাবে সাবধান করা হয়েছে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রসূল করে পাঠানোর কারণে তোমরাও ঐ বাগান মালিকদের মতো পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছো। তোমরা যদি তাকে না মানো তাহলে দুনিয়াতেও শাস্তি ভোগ করতে থাকবে। আর এ জন্য আখেরাতে যে শাস্তি ভোগ করবে তাতো এর চেয়েও বেশী কঠোর।
এরপর ২৪ থেকে ৪৭ আয়াত পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে কাফেরদেরকে বুঝানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কখনো সরাসরি তাদেরকে লক্ষ করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। আবার কখনো রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। আসলে সাবধান করা হয়েছে তাদেরকেই। এ সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলো, আখেরাতের কল্যাণ তারাই লাভ করবে যারা আল্লাহভীতির ওপর ভিত্তি করে দুনিয়াবী জীবন যাপন করেছে।
আল্লাহর বিচারে গোনাহগার ও অপরাধীদের যে পরিণাম হওয়া উচিত আল্লাহর অনুগত বান্দারাও সে একই পরিণাম লাভ করবে এরূপ ধ্যান-ধারণা একেবারেই বুদ্ধি-বিবেক বিরোধী। কাফেরদের এ ভ্রান্ত ধারণা একেবারই ভিত্তিহীন যে, তারা নিজের সম্পর্কে যা ভেবে বসে আছে আল্লাহ তা’আলা তাদের সাথে অনুরূপ আচরণেই করবেন।
যদিও এ বিষয়ে তাদের কাছে কোন নিশ্চয়তা বা গ্যারান্টি নেই ।আজ এ পৃথিবীতে যাদেরকে আল্লাহর সামনে মাথা নত করার আহবান জানানো হচ্ছে তারা তা করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন তারা সিজদা করতে চাইলেও করতে সক্ষম হবে না। সেদিন তাদেরকে লাঞ্ছনাকর পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। কুরআনকে অস্বীকার করে তারা আল্লাহর আযাব থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারে না। তাদেরকে যে অবকাশ দেয়া হচ্ছে তাতে তারা ধোঁকায় পড়ে গেছে। তারা মনে করছে এভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা ও অস্বীকৃতি সত্ত্বেও যখন তাদের ওপর আযাব আসছে না তখন তারা সঠিক পথেই আছে।
অথচ নিজের অজান্তেই তারা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা করার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই।কারণ তিনি দীনের একজন নিঃস্বার্থ প্রচারক। নিজের জন্য তিনি তাদের কাছে কিছুই চান না। তারা দাবী করে একথাও বলতে পারছে না যে, তিনি রসূল নন অথবা তাদের কাছে তাঁর বক্তব্য মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ আছে।
Leave a Reply