শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০২:৩৮

মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর

মাওলানা সাঈদীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর

 

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বৃহস্পতিবার মাওলানা সাঈদীর উপস্থিতিতে জনাকীর্ণ আদালতে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর যুদ্ধাপরাধের মামলার এ রায় ঘোষণা করেন।

এ সময় ট্রাইব্যুনালের অপর দুই বিচারক বিচারপতি আনোয়ার-উল হক ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন উপস্থিত ছিলেন। বেলা ১১টা ১৯ মিনিট থেকে শুরু করে ১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত রায় পড়া হয়। ১২০ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের সদস্য আনোয়ারুল হক। পরবর্তী অংশ পাঠ করেন বিচারক প্যানেলের অন্য সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন এবং রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বলা হয়েছে,  মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগের মধ্যে ৮টি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮ ও ১০ নম্বর অপরাধে তার মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। দু’টি অভিযোগে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় বাকি ছয়টি অভিযোগ কোনোরূপ শাস্তির আদেশ দেয়া হয়নি। এ ছাড়া, বাকি ১১টি অভিযোগ প্রমাণ হয়নি মর্মে ট্রাইব্যুনাল তার আদেশে উল্লেখ করেন।

সাঈদীর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। তবে রাষ্ট্রপক্ষ ১৯টি অভিযোগের বিষয়ে সাক্ষী হাজির করে। অভিযোগগুলো হচ্ছে-

অভিযোগ-১: ১৯৭১ সালের ৪ মে। শান্তি কমিটির সদস্য হিসাবে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওইদিন সকালে পিরোজপুর সদর থানার মধ্য মাসিমপুর বাসস্ট্যান্ডের পেছনে একদল মানুষের জমায়েতের খবর জানিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সেখানে নিয়ে আসে। সেখানে সাঈদী ২০অজ্ঞাতনামা নিরস্ত্র ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করে। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(এ) ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

অভিযোগ-২: একইদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাঈদী তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে সহযোগীদের নিয়ে মাছিমপুর হিন্দুপাড়া চড়াও হয়ে ঘরবাড়ি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। ভীতসন্ত্রস্ত নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ পালাতে শুরু করলে প্রকাশ্যে তাদের উপর সাঈদীর দলবল এলোপাথাড়ি গুলি করে। যাতে খুন হন ১৩ জন। যাদের মধ্যে রয়েছে, শরত্ চন্দ্র মণ্ডল, বিজয় মিস্ত্রী, উপেন্দ্রনাথ, যোগেন্দ্রনাথ মিস্ত্রি, সুরেন্দ্রনাথ মিস্ত্রী, মতিলাল মিস্ত্রী, যজ্ঞেশ্বর মণ্ডল, সুরেশ মণ্ডলসহ  আরো অজ্ঞাতনামা ৫ ব্যক্তি। যা এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৩(২)(এ) ও ৩(২)(সি)(আই)ধারা অনুসারে মানবতার বিরুদ্ধে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অভিযোগ-৩: ওইদিন সাঈদীর নেতৃত্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল মাছিমপুর হিন্দু পাড়ায় গিয়ে মনীন্দ্র পসারী ও সুরেশচন্দ্র মণ্ডলের বাড়ি লুট করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। এরপর সাঈদী সরাসরি নিজে বিভিন্ন গ্রামে রাস্তা পাশের বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে বড় ধরণের ধ্বংসযজ্ঞ ঘটান। গ্রামগুলোর মধ্যে রয়েছে, কালিবাড়ি, মাছিমপুর, পালপাড়া, শিকারপুর, রাজারহাট, কুকারপাড়া, ডুমুরতলা, কালামতলা, নওয়াবপুর, আলমকুঠি, ডুকিগাথি, পারেরহাট এবং চিংড়াখালি। ধর্মীয় কারণে নিরস্ত্র মানুষের উপর এই হামলা চালানো হয়।
অভিযোগ-৪: একইদিনে পরিকল্পিতভাবে সাঈদী তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সদর থানার এলজিইডি ভবনের পেছনে ও ধোপাবাড়িরে সামনে হিন্দুপাড়া ঘিরে ফেলে। হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংসের জন্য তারা নির্বিচারে অজ্ঞাতনামা হিন্দু বেসামরিক মানুষের উপর গুলি করে। ধর্মীয় সম্প্রদায়কে ধ্বংসের উদ্দেশ্যে বন্দুকের গুলিতে হত্যা করা হয় দেবেন্দ্রনাথ মণ্ডল, যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, পুলিন বিহারী ও মুকুন্দ বালাকে। এই কাজ গণহত্যার পর্যায়ে পড়ে। এই গণহত্যার অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে সাঈদী আইসিটি আইনের ৩(২)(সি)(আই) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

অভিযোগ-৫:স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পিরোজপুরের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সাইফ মিজানুর রহমান সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। এটা জানার পর তাকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেয় সাঈদী। সাঈদী ও তাঁর সহযোগী শান্তিকমিটির সদস্য মন্নাফ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে নিয়ে ৫ মে দুপুরে সামরিক যানে করে পিরোজপুর হাসপাতাল যান, যেখানে মিজানুর রহমান লুকিয়ে ছিলেন।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে সাঈদীর দলে একজন চিনিয়ে দিয়ে তাকে বলেশ্বর নদের তীরে নিয়ে যান। একই দিনে পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমেদ (লেখক হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের বাবা) এবং ভারপ্রাপ্ত এসডিও আবদুর রাজ্জাককেও কর্মস্থল থেকে ধরে সেখানে নিয়ে আসা হয়। খুনে বাহিনীর একজন সদস্য হিসাবে সাঈদীর উপস্থিতিতে এ তিন বেসামরিক সরকারি কর্মকর্তাকে গুলি করে লাশ বলেশ্বর নদে ফেলে দেওয়া হয়। সাঈদী সরাসরি এই তিন ব্যক্তির অপহরণ, হত্যায় অংশ নিয়েছে, যা একটি মানবতা বিরোধী অপরাধ।

অভিযোগ-৬: ৭ মে সাঈদীর নেতৃত্বে একদল শান্তি কমিটির সদস্য পিরোজপুর সদরের পারেরহাটে গিয়ে পাকিস্তানী আর্মিকে ওই এলাকায় স্বাগত জানান। তাদেরকে পারেরহাট বাজারে নিয়ে এসে সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষদের বাড়িঘর ও দোকান পাট চিনিয়ে দেন সাঈদী। পরে সাঈদী অন্যান্যদের সঙ্গে এ সকল বাড়ি ও দোকানে হানা দিয়ে মূল্যবান সম্পদ লুট করে। যার মধ্যে সেখানে মুকুন্দ লাল সাহার দোকান থেকে বাইশ সের স্বর্ণ ও রৌপ্যও লুট করেন সাঈদী। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণে সংগঠিত এই সব কার্যক্রম মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। যার আইনের ৩(২)(এ) ধারায় শাস্তিযোগ্য।

অভিযোগ-৭: ৮ মে বেলা দেড়টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে নিয়ে সদর থানার ভাদুরিয়া গ্রামের নুরুল ইসলাম খানের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম সেলিমের বাড়িতে হানা দেন। সেখানে নুরুল ইসলাম খানকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে চিনিয়ে দেন সাঈদী। পরে তিনি তাকে আটক করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেন। যারা তাকে নির্যাতন করে। বাড়ি লুটপাট করার পর যাওয়ার পূর্বে আগুন লাগিয়ে বাড়িটাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এটা আইনের ৩(২)(এ) এবং ৩(২)(জি) ধারা অনুসারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

অভিযোগ-৮: একইদিন বেলা ৩টায় সাঈদীর নেতৃত্বে তার সাঙ্গপাঙ্গরা পাক বাহিনীর সহায়তায় সদর থানার চিতলিয়া গ্রামের মানিক পসারীর বাড়িতে হানা দিয়ে তার ভাই মফিজ উদ্দিন এবং ইব্রাহিমকে  সহ দুই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে যান। সেখানে পাঁচটি বাড়িতে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া। সেনা ক্যাম্পে ফেরার পথে সাঈদীর প্ররোচণায় ইব্রাহিমকে হত্যা করে লাশ ব্রিজের কাছে ফেলে দেয়া হয়। মফিজকে ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে সাঈদী ও অন্যদের আগুনে পারের হাট বন্দরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ঘরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাঈদী সরাসরি অপহরণ, খুন, যন্ত্রণদানের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন। যার আইনের ৩(২)(এ) ধারা অনুসারে অপরাধ।

অভিযোগ-৯ : ১৯৭১ সালের ২ জুন সকাল নয়টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইন্দুরকানি থানার নলবুনিয়া গ্রামের আবদুল হালিম বাবুলের বাড়িতে হানা দিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র লুট এবং বাড়ি আগুনে ছাই করে দেয়। এটা ৩(২)(এ) ধারায় অপরাধ।

অভিযোগ-১০: একইদিন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যার মধ্যে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল মণ্ডল, বিসাবালি, সুকাবালি, সতিশবালা। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিসাবালীকে নারকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। বেসামরিক মানুষের বসবাসের বাড়িতে আগুন দেয়া নিপীড়নের শামিল। সাঈদী বাড়িঘর পোড়ানো, বিসাবালিকে হত্যা মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছেন। যা ৩(২)(এ) ধারায় অপরাধ।

অভিযোগ-১০:  একইদিন সকাল ১০টার দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে তার সশস্ত্র সহযোগীরা ইন্দুরকানি থানার উমেদপুর গ্রামের হিন্দুপাড়ার হানা দিয়ে ২৫টি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। যার মধ্যে চিত্তরঞ্জন তালুকদার, হরেণ ঠাকুর, অনিল মণ্ডল, বিসাবালি, সুকাবালি, সতিশবালা। সাঈদীর ইন্ধনে তার সহযোগীরা বিসাবালীকে নারকেলগাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করা হয়। বেসামরিক মানুষের বসবাসের বাড়িতে আগুন দেয়া নিপীড়নের শামিল। সাঈদী বাড়িঘর পোড়ানো, বিসাবালিকে হত্যা মাধ্যমে মানবতা বিরোধী অপরাধ করেছেন, যা ৩(২)(এ) ধারায় অপরাধ।
অভিযোগ-১১  : ২ জুন সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি ইন্দুরকানি থানার টেংরাখালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মাহাবুবুল আলম হাওলাদারের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান। সেখানে সাঈদী তাঁর বড় ভাই আবদুল মজিদ হাওলাদারকে ধরে নির্যাতন করে। এরপর সাঈদী নগদ টাকা, অলঙ্কারাদি ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে যান।

অভিযোগ-১২:  স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের একটি সশস্ত্র দল পারেরহাট বাজারের হিন্দুপাড়ায় গিয়ে ১৪ জন হিন্দুকে ধরে এক দড়িতে বেঁধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে হস্তান্তর করে। পরে তাদেরকে হত্যা করে লাল নদীতে ফেল দেয়া হয়।

অভিযোগ-১৩: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন মাস পর এক রাতে সাঈদীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটির সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে সদর থানার নলবুনিয়া গ্রামের আজহার আলীর বাড়িতে হানা দেয়। সেখানে আজহার আলী ও তার ছেলে সাহেব আলীকে ধরে নির্যাতন করা হয়। পরে সাহেব আলীকে অপহরণ করে সাঈদী, যার লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে।

অভিযোগ-১৪: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে এক সকারে সাঈদীর নেতৃত্বে ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার বাহিনী সদর থানার হোগলাবুনিয়ার হিন্দুপাড়া আক্রমণ করে। সেখানে শেফালী ঘরামি ও মধুসুদন ঘরামি ছাড়া বাকিরা সবাই পালিয়ে যায়। তখন রাজাকার বাহিনীর কিছু সদস্য শেফালী ঘরামির ঘরে দিয়ে তাকে ধর্ষণ করে। দলনেতা হওয়া সত্ত্বেও সাঈদী এই ধর্ষণে বাধা দেননি। পরে তারা এই হিন্দুপাড়ার ঘরে আগুন দিয়ে দেয়।

অভিযোগ-১৫: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে সাঈদীর নেতৃত্বে ১৫-২০ জনের রাজাকার দল হোগলাবুনিয়া গ্রামের তরণী শিকদার, নির্মল শিকদার, শ্যামকান্ত শিকদার, বাণীকান্ত শিকদার, হরলাল শিকদার, প্রকাশ শিকদারসহ ১০ জন হিন্দু নাগরিককে ধরে নিয়ে যায়। এদেরকে তুলে দেয়া হয় পাকিস্তানি সেনাদের হাতে, যারা এদেরকে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

অভিযোগ-১৬: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জন সশস্ত্র রাজাকার দল পারেরহাট বন্দরের গৌরাঙ্গ সাহার বাড়ি থেকে তাঁর তিন বোনকে অপহরণ করে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। সেখানে তাদেরকে আটকে রেখে তিন দিন ধরে ধর্ষণ করে পরে ছেড়ে দেয়।

অভিযোগ-১৭: সাঈদী ও তাঁর নেতৃত্বের সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পারেরহাটের বিপ্লব সাহার মেয়েকে তাঁর বাড়িতে আটকে রাখে। তারা ওই বাড়িতে গিয়ে নিয়মিত তাকে ধর্ষণ করত।

অভিযোগ-১৮: ভাগিরথি নামে এক নারী পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে কাজ করতেন। পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য দেওয়ার অভিযোগে সাঈদী তাকেও আটক করে নির্যাতন করেন। পরে তাকে হত্যা করে লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

অভিযোগ-১৯: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে “স্বাধীনতাযুদ্ধকালে সাঈদী জোর করে মধুসুদন ঘরামী, কৃষ্ট সাহা, ডা. গণেশ সাহা, অজিত কুমার শীল, বিপদ সাহা, নারায়ণ সাহা, গৌরাঙ্গ পাল, সুনীল পাল, নারায়ণ পাল, অমূল্য হাওলাদার, শান্তি রায়, হরি রায় জুরান, ফকির দাস, টোনা দাস, গৌরাঙ্গ সাহা, হরিদাস, গৌরাঙ্গ সাহার মা ও তিন বোন মহামায়া, অন্যরাণী ও কামাল রাণীসহ ১০০/১৫০ জন হিন্দুকে ধর্মান্তর করেন।

অভিযোগ ২০: নভেম্বর মাসের শেষের দিকে সাঈদী সংবাদ পান যে, হাজার খানেক মানুষ জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে যাচ্ছে। এরমধ্য কোনো একদিন সাঈদীর নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে ইন্দুরকানি গ্রামের তালুকদার বাড়িতে হামলা করে ৮৫ ব্যক্তিকে আটক করেন সেখানে ব্যাপক লুটপাট চালায়। পরে আটককৃতদের নিয়ে আসা হয় স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে। সেখান থেকে ফজলুল হক নামে এক রাজাকারের মধ্যস্থতায় ঘুষের বিনিময়ে ১০-১২ জন ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেয়া হয়। সেখানে আটক পুরুষদের নির্যাতন এবং খগেন্দ্রনাথ সাহার মেয়ে দীপালি, স্ত্রী নিভারাণী, রাজবল্লভ সাহার মেয়ে মায়ারাণীকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয়, যারা ক্যাম্পে ধর্ষণের শিকার হন।

মাওলানা সাঈদীর প্রতিক্রিয়া রায় ঘোষণার পর পরই এজলাসের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান মাওলানা সাঈদী। বিচারকদের উদ্দেশে বলেন, “মাননীয় আদালত, আপনারা আপনাদের শপথের ওপর দায়বদ্ধ থেকে বিচার করতে পারেননি। বরং শাহবাগের কতিপয় নাস্তিক-ব্লগার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এ রায় দিয়েছেন।” এ সময় আদালতে হট্টগোল শুরু হলে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা মাওলানা সাঈদীকে দ্রুত ট্রাইব্যুনাল হাজতে নিয়ে যায়।

আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া রায়ের পর এক প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছেন, এই রায়ের জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে।  আইনমন্ত্রী দাবি করেন, “আন্তর্জাতিক সবরকম মানদণ্ড বজায় রেখে রায় দেওয়া হয়েছে। আসামি পক্ষকে সব রকম সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়েছে।”

অ্যাটর্নি জেনারেলের প্রতিক্রিয়া রায় ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এজলাসকক্ষ থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, “এটা ঐতিহাসিক রায়। এই রায় স্বাধীনতার চেতনার পক্ষে। এর ফলে ৩০ লাখ শহীদ শান্তি পাবে।”

মহাজোটের প্রতিক্রিয়া রায় ঘোষণার পরপরই ১৪ দল আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘১৪ দলের পক্ষে আমরা ন্যায় বিচার আশা করেছিলাম। জনগণ সেই ন্যায় বিচার পেয়েছে।’ এ সময় তিনি গণজাগরণ সৃষ্টিকারী তরুণ প্রজন্ম ও দেশবাসীকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করার জন্য ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানান।

ব্যারিস্টার রাজ্জাকের প্রতিক্রিয়া মাওলানা সাঈদীর প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ঘোষিত রায়কে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।  ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, “এই রায়ে আমরা স্তম্ভিত। যে সাক্ষ্য প্রমাণ দেয়া হয়েছে তাতে মৃত্যুদণ্ড দূরে থাক, এক মিনিটেরও সাজা হওয়ার কথা নয়।” আজ বেলা আড়াইটায় ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় প্রেস ব্রিফিংয়ে ব্যারিস্টার রাজ্জাক এ মন্তব্য করেন। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “রায়ের বিরুদ্ধে আমরা সংক্ষুব্ধ। আমরা আপিল করব।”

জামায়াতের প্রতিক্রিয়া রায় প্রত্যাখ্যান করে জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, “এ রায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত। সরকারের মদদপুষ্ট বিচারক দিয়ে এই রায় দেয়া হয়েছে।” এর বিরুদ্ধে শিগগিরই কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে বলে তিনি জানান।

শাহবাগে উল্লাস ফাঁসির রায় ঘোষণার পর উল্লাস প্রকাশ করছেন শাহবাগের আন্দোলনকারীরা।  বিভিন্ন বিজয় সূচক স্লোগানে মুখরিত হয় গণজাগরণ চত্বর।

পেছনে ফিরে দেখা বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীর দায়ের করা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একটি মামলায় মাওলানা সাঈদীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত বছরের ১১ই জুলাই সাঈদীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। ১৪ই জুলাই তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। অভিযোগের বিষয়ে শুনানি শেষে ৩রা অক্টোবর মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এই মামলার আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। সাঈদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনকালে মুক্তিযুদ্ধকালে পিরোজপুর জেলায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ এবং এ ধরনের অপরাধে সাহায্য করা ও জড়িত থাকার ঘটনায় ২০টি অভিযোগ আনা হয়।

মামলার কার্যক্রম ২০১১ সালের ৭ ডিসেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষের ২৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ৮ এপ্রিল থেকে নয় কার্যদিবসে জবানবন্দি দেন রাষ্ট্রপক্ষের শেষ সাক্ষী ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. হেলালউদ্দিন। ৭ মে থেকে আসামিপক্ষ তাঁকে ৪৮ কার্যদিবস জেরা করে। ২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত আসামিপক্ষে ১৭ জন সাফাই সাক্ষ্য দেন। ৬ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখা হয়। কিন্তু স্কাইপ কেলেঙ্কারির কারণে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান পদ থেকে বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করেন এবং বিচারপতি এটিএম ফজলে কবির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। স্কাইপ কেলেঙ্কারির পরিপ্রেক্ষিতে মাওলানার সাঈদীর মামলা পুনর্বিবেচনার দাবি জানান আসামীপক্ষ। কিন্তু গত ৩ জানুয়ারি শুনানি শেষে আসামিপক্ষের আবেদন খারিজ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে আদালত রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষকে আবার মামলার সারসংক্ষেপ ও আইনি বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। সে অনুসারে দ্বিতীয় দফায় দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ২৯ জানুয়ারি ট্রাইব্যুনাল আবার রায় অপেক্ষাধীন (সিএভি) রাখেন। গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টায় বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল আজ রায়ের দিন ধার্য করেন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024