রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৭

উম্মুল মুমিনিন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা:)

উম্মুল মুমিনিন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা:)

আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘উম্মুল মুমিনিন খাদিজা বিনতে খুয়াইলিদ (রা:) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।

মা খাদীজা (রাঃ) ছিলেন নবী সহধর্মিণীদের মধ্যে সর্বপ্রথমা ও সর্বশ্রেষ্ঠা, জান্নাতী মহিলাদের প্রধান হযরত ফাতিমাতুয যাহ্‌রার মহীয়সী মাতা। নবী মুহাম্মাদ (সা:)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর এই মহীয়সী নারী সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

তিনিই একমাত্র মহিলা যাঁকে দুনিয়া থেকেই জান্নাতের খোশ খবর জ্ঞাপন করা হয়েছিল। জাহেলী যুগের কোন প্রকার অন্যায় বা পাপ তাকে স্পর্শ করেনি বিধায় বাল্যকালেই তিনি ‘তাহেরা বা পবিত্রা’ উপাধিতে ভূষিতা হয়েছিলেন এবং এই নামেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন পরিচিতা ও খ্যাতনামা। রূপে-গুণে তিনি ছিলেন অতুলনীয়। সতী-সাধ্বী ও পতিব্রতা এই বিদুষী মহিলার গুণাবলী বর্ণনায় বুখারী ও মুসলিম সহ বিভিন্ন হাদীছ গ্রন্থে বহু সংখ্যক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে।

জন্ম ও বংশ পরিচয়:
হস্তী বর্ষের ১৫ বছর পূর্বে ৫৫৫ খৃষ্টাব্দে হযরত খাদীজা (রাঃ) মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর কুনিয়াত উম্মে হিন্‌দ ও লকব ছিল ত্বাহেরাহ। পিতা ছিলেন খুওয়ালিদ বিন আসাদ বিন আব্দুল উয্‌বা বিন কুছাই। তিনি কেবল একজন সফল ব্যবসায়ী ছিলেন না বরং তার বিশ্বস্ততা, গাম্ভীর্য, সাহস আর দূরদর্শিতার কারণে সমগ্র কুরাইশের মধ্যে ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্রী।

মাতা ফাতিমা বিনতে যায়েদা আমের বিন লুআই–এর বংশের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে তিনি যে বহু গুণ সম্পন্না ছিলেন, তার কন্যা খাদীজার (রাঃ) অনন্য সাধারণ গুণবত্তা থেকে তা অনুমান করা যায়।

শৈশব ও প্রাথমিক জীবন:
তৎকালীন প্রতিকুল পরিবেশে লেখা পড়ার কোন সুযোগ না পেলেও শৈশব কাল থেকেই হযরত খাদীজা (রাঃ) বুদ্ধিমতী ও নেকবখ্‌ত ছিলেন। এজন্যই হয়তবা আরব সমাজের অন্যান্য পরিবারে যখন নারীর স্থান ছিল একেবারেই নিম্নে, খুওয়াইলিদ পরিবারে খাদীজার (রাঃ) স্থান ছিল তখন অতি উচ্চে।

রাসূলের (সা:) সাথে বিবাহ:
মুহাম্মাদ (ছাঃ) মোহরানা স্বরূপ খাদীজা (রাঃ)-কে বিবাহের মোহর স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। এ সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসাবে ‘তাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫।

মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী (ইবনু হিশাম ১/১৮৭-৮৯; আল-বিদায়াহ ২/২৯৩-৯৪)। ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশী হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন।

ইতিপূর্বে পরপর দু’জন স্বামী মৃত্যুবরণ করায় মক্কার সেরা নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকটে বিয়ের পয়গাম পাঠান। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করেননি। এবার তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ-এর কাছে।

তখন উভয় পক্ষের মুরববীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দু’মাসের মাথায় সমাজনেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয় (ইবনু হিশাম ১/১৮৭, টীকা ১-২; হাকেম হা/৪৮৩৮, ৩/২০০; বিস্তারিত দ্রঃ সীরাতুর রাসূল ৭৩ পৃঃ)।

সিরিয়া থেকে যুবক নবীর (সা:) প্রত্যাবর্তনের পর হিসাব-নিকাশ করে আমানত সহ এত বেশী পরিমাণ অর্থ তিনি পেলেন, যা ইতিপূর্বে কোন দিনই পাননি। অধিকন্তু দাস মায়সারার কথাবার্তা থেকে হযরতের (সা:) মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, উন্নত চিন্তা-ভাবনা, আমানতদারী ইত্যাদি বিষয় অবগত হওয়ার পর তিনি এত বেশী প্রভাবান্বিত হন যে, নিজের দাসী নাফীসা বিনতে মুনাব্বিহ-এর মাধ্যমে হুযুরের (সা:) নিকট সরাসরি বিয়ের পয়গাম পাঠান।

রাসূলুল্লাহ (সা:) বিষয়টি পিতৃব্য আবু তালিবের সাথে আলোচনা করেন। আবু তালিব এ ব্যাপারে হযরত খাদীজার (রাঃ) পিতৃব্যের সাথে আলোচনার পর বিয়ের প্রস্তাব পেশ করেন। এক শুভক্ষণে আল্লাহ্‌র অনুগ্রহপ্রাপ্ত দুই বান্দা ও বান্দী পবিত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যান। এই বিয়ের মোহরানা ছিল ২০টি উট। এ সময় বিবি খাদীজার বয়স ছিল ৪০ বছর আর রাসূলুল্লাহ্‌র (সা:) বয়স ছিল ২৫ বছর। খাদীজার (রাঃ) জীবদ্দশায় রাসূলুল্লাহ্ (সা:) অন্য কোন মহিলাকে বিবাহ করেননি।

খাদিজা রা.-এর ইসলাম গ্রহণ:
রাসুল সা. কে নবুওয়াত প্রদান করা হলে সর্বপ্রথম রাসুল সা.-এর উপর ইমান আনেন হযরত খাদিজা রা.। এর বিবরণ সহিহ বুখারিতে হযরত আয়েশা রা.-এর সূত্রে এভাবে পাওয়া যায় যে,
আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর প্রতি সর্বপ্রথম যে ওহি আসে, তা ছিল ঘুমের মধ্যে সত্য স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে ভোরের আলোর ন্যায় প্রকাশ পেত।

তারপর তাঁর কাছে নির্জনতা প্রিয় হয়ে পড়ে এবং তিনি ‘হেরা’ র গুহায় নির্জনে থাকতেন। আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা এবং কিছু খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে যাওয়া- এইভাবে সেখানে তিনি একাধারে বেশ কয়েক রাত ইবাদতে নিমগ্ন থাকতেন। তারপর খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে আবার অনুরূপ সময়ের জন্য কিছু খাদ্যসামগ্রী নিয়ে যেতেন।

এমনিভাবে ‘হেরা’ গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহী এলো। তাঁর কাছে ফিরিশতা এসে বললেন, পড়ুন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: আমি বললাম, আমি পড়ি না। তিনি বলেন: তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন। আমি বললাম: আমি তো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমনভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হল।

এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন: পড়ুন। আমি জবাব দিলাম, আমি তো পড়ি না। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়ুন আর আপনার রব মহামহিমান্বিত। (৯৬: ১-৩)

তারপর এ আয়াত নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ফিরে এলেন। তাঁর অন্তর তখন কাঁপছিল। তিনি খাদিজা রা.-এর কাছে এসে বললেন: আমাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও, আমাকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দাও। তাঁরা তাঁকে চাঁদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। অবশেষে তাঁর ভয় দূর হল। তখন তিনি খাদীজা (রা.) এর কাছে সকল ঘটনা জানিয়ে তাঁকে বললেন, আমি নিজের উপর আশঙ্কা বোধ করছি।

খাদিজা (রা.) বললেন, আল্লাহর কসম, কখনো না। আল্লাহ্ আপনাকে কখনো অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারি করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।

এরপর তাঁকে নিয়ে খাদীজা (রা.) তাঁর চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নাওফিল ইবনে আব্দুল আসাদ ইবনে আব্দুল উজ্জার কাছে গেলেন, যিনি জাহিলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানি ভাষা লিখতে জানতেন এবং আল্লাহর তাওফীক অনুযায়ী ইবরানি ভাষায় ইনজীল থেকে অনুবাদ করতেন।

তিনি ছিলেন অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ এবং অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা (রা.) তাঁকে বললেন, হে চাচাতো ভাই! আপনার ভাতিজার কথা শুনুন। ওয়ারাকা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাতিজা! তুমি কী দেখ? রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা দেখেছিলেন, সবই খুলে বললেন। তখন ওয়ারাকা তাঁকে বললেন, ইনি সে দূত যাঁকে আল্লাহ্ মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। আফসোস! আমি যদি সেদিন যুবক থাকতাম।

আফসোস! আমি যদি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বের করে দেবে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন: তাঁরা কি আমাকে বের করে দিবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ, অতীতে যিনিই তোমার মত কিছু নিয়ে এসেছেন তাঁর সঙ্গেই শত্রুতা করা হয়েছে।

সেদিন যদি আমি থাকি, তবে তোমাকে প্রবলভাবে সাহায্য করব। এর কিছুদিন পর ওয়ারাকা (রা.) ইন্তিকাল করেন। আর কিছুদিন ওহী স্থগিত থাকে। – [ আল জামিউস সহিহ- ইমাম বুখারী রহ. (সহীহ বুখারী) হাদিস নং: ৩ আন্তর্জাতিক নং: ৩ – ৪]

রাসুল সা.-এর দুঃখের দিনে ছায়া হিসেবে পাশে ছিলেন খাদিজা রা.। কাফেররা যখন রাসুল সা. কে নানাভাবে কষ্ট দিতো তখন হযরত খাদিজা রা. সাহস যোগাতেন। দুঃখ-কষ্টে সর্বদা পাশে থাকতেন।

যখন কুরাইশরা রাসুল সা. ও তার গোত্রকে আবু তালেব উপত্যকায় দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত অবরোধ করে রেখেছিল। তখন হযরত খাদিজা রা. পুরো সময়টাতে রাসুল সা.-এর সাথে আবদ্ধ অবস্থায় ছিলেন। সেখানে তীব্র ক্ষুধা নিবারণের জন্য গাছের পাতা পর্যন্তও খেতে হয়েছিল।

সন্তানাদি:
হযরত খাদিজা রা.-এর গর্ভে বেশ কয়েকজন সন্তান জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম স্বামী আবু হালাহর ঔরসে জন্ম হয় হালাহ ও হিন্দ এর। দ্বিতীয় স্বামী আতিকের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন হিন্দা নান্মী নামে এক কন্যা সন্তান। রাসুল সা. এর ঔরসে জন্ম গ্রহণ করেন দুই জন ছেলে এবং চার জন কন্যা সন্তান।

রাসুল সা. এর ঔরসে জন্মানো সন্তানদের নামের তালিকা নিম্নে প্রদান করা হলো:
•        কাসিম। তার নামেই রাসুল সা.-এর উপনাম আবুল কাসিম।
•        জাইনাব।
•        আব্দুল্লাহ।
•       .রুকাইয়া।
•       উম্মে কুলসুম।
•       ফাতিমা জাহরা।

ইন্তেকাল:
রাসুল সা.-এর সঙ্গে বিবাহের পর খাদিজা সা. দীর্ঘ পঁচিশ বছর জীবিত ছিলেন। ইসলামের শুরুর দিকে রাসুল সা.-এর উত্তম সঙ্গিনী হিসেবে পাশে ছিলেন। নবুওয়াতের ১০ম বছর হিজরতের তিন বছর পূর্বে ৬৪ বছর ০৬ মাস বয়সে পরকালের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তখন পর্যন্ত জানাজা নামাজের বিধান অবতীর্ণ না হওয়ার বিনা জানাজাতে তাকে দাফন করা হয়। ৫ দাফন কাজে রাসুল সা. স্বয়ং শরিক ছিলেন।




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024