ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতনের পর থেকে ভারতে রয়েছেন শেখ হাসিনা। এরইমধ্যে তার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিলের আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিচারের দাবিও রয়েছে।
সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশ সরকার প্রত্যর্পণের আবেদন জানালে ভারত কি শেখ হাসিনাকে ঢাকার হাতে তুলে দেবে?
এ প্রশ্ন সামনে রেখেই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা। এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দিল্লিতে শেখ হাসিনার অবস্থান যে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা তা বুঝতে পারছে ভারত। এ জন্য তৃতীয় কোনো দেশে হাসিনাকে নিরাপদে রাখার একটা চেষ্টাও চলছে।
আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির তেমন কোনো গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করছে না ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এই চুক্তি করা হয়েছিল দু’দেশের মধ্যে জঙ্গি, পাচারকারী ও চোরাচালানিদের প্রত্যর্পণের উদ্দেশ্যে।
২০১৬ সালে এই চুক্তিতে বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়েছিল। কোনো দেশ যদি মনে করে, রাজনৈতিক কারণে কাউকে প্রত্যর্পণের দাবি জানানো হচ্ছে, তবে তারা দাবি মানতে বাধ্য নয়।
শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি ভারত যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ বলে মনে করে, সেখানে বলার কিছু থাকতে পারে না। আবার চুক্তির আরেকটি ধারায় রয়েছে, প্রত্যর্পণের পরে দীর্ঘ কারাবাস ও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলে অন্য পক্ষের দাবি খারিজ করা যাবে।
ঠিক কোন ‘স্ট্যাটাসে’ এখন ভারতে রয়েছেন শেখ হাসিনা?
বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাকে দিল্লির উপকণ্ঠে একটি আধাসামরিক বাহিনীর অতিথিনিবাস বা সেফ হাউসে একসঙ্গে রাখা হয়েছে। তবে এই মুহূর্তে তাদের ঠিকানা কী, সেটা সরকারিভাবে কখনো প্রকাশ করা হয়নি।
শেখ হাসিনা ঠিক কোন ‘ইমিগ্রেশন স্ট্যাটাসে’ ভারতে রয়েছেন, সে ব্যাপারেও এখনও পর্যন্ত ভারত সরকার সম্পূর্ণ নীরব রয়েছে।
অর্থাৎ তিনি কোনও বিশেষ ভিসায় ভারতে অবস্থান করছেন, না কি তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় (পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম) দেওয়া হয়েছে— এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকার আজ পর্যন্ত একটি শব্দও বলেনি।
দিল্লিতে একাধিক শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছেন, ভারতে শেখ হাসিনার এই মুহূর্তে অবস্থানের ভিত্তিটা হলো ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘সংশোধিত ট্র্যাভেল অ্যারেঞ্জমেন্ট’।
তবে এসবই শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্টের ভিত্তিতে বলা হচ্ছিল। এখন এই পাসপোর্ট বাতিল হলে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা নতুন প্রশ্ন।
এ বিষয়টির জবাবে দিল্লির একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, সেটাও বড় কোনো সমস্যা নয়, কারণ এই ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের ‘প্ল্যান বি’ বা ‘প্ল্যান সি’ প্রস্তুত রাখতেই হয়, এখানেও নিশ্চয়ই সেটা তৈরি আছে।
বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এখনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে প্রত্যর্পণের কথা দিল্লিকে বলা হয়নি। কিন্তু আগের সরকারের সব কর্তাব্যক্তির কূটনৈতিক পাসপোর্ট (লাল পাসপোর্ট) বাতিল করায় হাসিনাও সেই রক্ষাকবচ হারাচ্ছেন। সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রতিদিন একের পর এক মামলা করা হচ্ছে, যার অধিকাংশই হত্যা ও গণহত্যার মতো গুরুতর অভিযোগে করা।
এই পরিস্থিতিতে হাসিনাকে প্রত্যর্পণের দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির। তিনি বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২০১৩ সালে প্রত্যর্পণ চুক্তি হওয়ায় হাসিনাকে ভারত ঢাকার হাতে তুলে দিতে বাধ্য। ফখরুল জানিয়েছেন, প্রত্যর্পণের পরে খুনের আসামি হিসাবে হাসিনার বিচার করা হবে ঢাকার আদালতে।
তবে সরকারের কোনো পদে ফখরুল নেই। তাই হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে তার কথার জবাব ভারত সরকার দেয়নি। কিন্তু জবাব না দিলেও দিল্লিতে হাসিনার অবস্থান যে বাংলাদেশে ভারত-বিরোধিতা বাড়াবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিলক্ষণ তা বোঝে। এ জন্য তৃতীয় কোনো দেশে হাসিনাকে নিরাপদে রাখার একটা তোড়জোড়ও দিল্লি চালাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগির হাসিনাকে ফেরত চাইলেও বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে এই দাবির বিষয়ে এখনো কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত হয়নি। বিএনপি নেতৃত্বের একাংশ মনে করেন, হাসিনার প্রত্যর্পণের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়ার কথাই নয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ আইনশৃঙ্খলায় রাশ টেনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসার পরে হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে কাঠগড়ায় তুললে তবে বিএনপি রাজনৈতিক ফায়দাটি পাবে। হাসিনাকে ফেরানোর দাবি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসাবেও জনপ্রিয় করা যাবে। মির্জা ফখরুলের দাবি তাই খানিকটা ‘সময়ের আগে তোলা’ বলে মনে করছেন বিএনপি নেতৃত্বের এই অংশ।
তবে হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির তেমন কোনো গুরুত্ব রয়েছে বলে মনে করছে না ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মূলত এই চুক্তি করা হয়েছিল দু’দেশের মধ্যে জঙ্গি, পাচারকারী ও চোরাচালানিদের প্রত্যর্পণের উদ্দেশ্যে।
২০১৬ সালে এই চুক্তিতে বেশ কিছু সংশোধন আনা হয়েছিল। কোনো দেশ যদি মনে করে, রাজনৈতিক কারণে কাউকে প্রত্যর্পণের দাবি জানানো হচ্ছে, তবে তারা দাবি মানতে বাধ্য নয়। এখানে হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি ভারত যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ বলে মনে করে, বাংলাদেশের বলার কিছু থাকতে পারে না।
আবার চুক্তির আর একটি ধারায় রয়েছে, প্রত্যর্পণের পরে দীর্ঘ কারাবাস ও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলে অন্য পক্ষের দাবি খারিজ করা যাবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট হাসিনার গোটা পরিবার সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ার পরে ইন্দিরা গান্ধী তাদের দুই বোনকে আশ্রয় দেন। সময়ের ব্যবধানে ফের শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের এই সরকারের হাতে ভারত কখনোই তাদের ছেড়ে দিবে না। তাই তৃতীয় কোনো দেশে তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সরকারে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি নেই।
কিন্তু এতদিন সরকার-বিরোধী অবস্থানে থাকা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দলগুলি এ অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন করছে।
Leave a Reply