হঠাৎ করেই জুলাই মাসে সে সমীকরণ উল্টো মোড় নিয়েছে। তীব্র ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতন নিশ্চিত হয়েছে। এতে হাসিনার টানা ১৫ বছরের ক্ষমতার অবসান হয় এবং তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
ছয় মাস আগেও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতার মসনদ অটুট ছিল। এ বছরের শুরুতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী দলের সদস্য এবং ভিন্নমতকে রাজনৈতিকভাবে কারাবাস দিয়ে শেখ হাসিনা তার ক্রমবর্ধমান কর্তৃত্ববাদকে দীর্ঘ করার চেষ্টায় ছিলেন।
যদিও তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়তে রাজি হননি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন গণআন্দোলনে রূপ নেয় তখন হাসিনা শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের এই ন্যায্য আন্দোলনকে দমাতে দেশের নিরাপত্তাবাহিনীকে ব্যাবহার করেন।
ওমান অবজারভারের খবরে বলা হয়, আফ্রিকা এবং এশিয়ার মধ্যে সর্বশেষ বাংলাদেশের তরুণরাই পুরো রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দিয়েছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশ, যেমন পাকিস্তানেও গত ফেব্রুয়ারিতে তরুণদের আন্দোলনে সেনা সমর্থিত রাষ্ট্রকল্পের ভিত কেঁপে ওঠে।
সেসময় দেশটির সেনাবহিনী পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে বন্দি রেখে নির্বাচন করে এবং তারা তাদের মদদপুষ্ট সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে। যার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের তরুণরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। যদিও ইমরান খান সমর্থিত প্রার্থীরাই বেশি সংখ্যক আসনে জয় পেয়েছিলেন, কিন্তু তারা ক্ষমতায় যেতে পারেনি।
পরের মাসে আফ্রিকার দেশ সেনেগালেও তরুণদের বিক্ষোভ দেখা যায়। তরুণ ভোটাররা অভিযোগ করেন নির্বাচনের নামে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার অপহরণ করা হয়েছে। দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট বাসিরু দিওমায়ে ফায়ে এর আগে একজন সামান্য ট্যাক্স ইন্সপেক্টর হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে কারাগার থেকে বের হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তারুণ্যের শক্তিই এমন নজির স্থাপন করেছে। পরে জুন মাসে তরুণদের এই কম্পন শুরু হয় কেনিয়ায়। সেখানে বিক্ষোভকারীরা গর্বের সাথে নিজেদেরকে ‘জেন জেড’ হিসেবে পরিচয় দেন। প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া নতুন করের বোঝার বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভে নামেন তরুণরা।
বাংলাদেশের মতো সেখানেও আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা প্রাণঘাতী হামলা চালায়। এতে কয়েক ডজন নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হন। কিন্তু আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত রুটো তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারে বাধ্য হন। এখন আফ্রিকার আরেক দেশে নাইজেরিয়া ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় নুয়ে পড়ায় তরুণদের বিক্ষোভে প্রকম্পিত হচ্ছে।
এশিয়া ও আফ্রিকায় নতুন প্রজন্মের যে উত্থান শুরু হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, তরুণরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং বিরল নজির স্থাপন করছে। এটিই প্রথম প্রজন্ম যারা ইন্টারনেট ছাড়া নিজেদের জীবন কল্পনাও করতে পারে না এবং তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে শুধু লাইভ-স্ট্রিম করছে না তারা এখন রাস্তায় প্রতিবাদ করার জন্য সংগঠিত হচ্ছে।
তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার সহ উদ্ভাবনী কৌশল তৈরি করছে এবং যখন তাদের স্তব্ধ করার চেষ্টা করা হয় তখন ডিজিটাল বিক্ষোভের মাধ্যমে নতুন পথ তৈরি করছে তরুণরা। সরকারগুলো প্রযুক্তি-নিপীড়নের কৌশল ব্যবহার করেও তরুণদের রুখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তরুণদের এই জাগরণ দেশে ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক দল এবং চিন্তাকে চ্যলেঞ্জ করছে।
তারা পুরনো সব দল এবং মতবাদ ভেঙ্গে নতুন করে রাজনৈতিক প্রস্তাবনা পেশ করছে। পপুলিজম এবং কর্তৃত্ববাদকে উৎখাতে সক্ষম হচ্ছে এই তরুণরা। তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়ন যত বাড়ছে তারা ততই শক্তিশীলী হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে এই তরুণদের নির্ভীক এবং আপসহীন ব্যক্তিত্ব ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দুনিয়ায়।
জুলাই মাসে যখন হাসিনার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল তখন আইনশৃঙ্খলাবাহিনী এবং তার দলীয় নেতা-কর্মীদের হাতে চার শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন (এ সংখ্যা এখন সাত শতাধিক)। বাংলাদেশের এমন দৃশ্য ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
সেসময় তারা রাজাপাকশেকে যেভাবে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছিল, ২০২৪ সালেও বাংলাদেশের তরুণরা হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণে বাধ্য করেন।
Leave a Reply