গত ১৯শে জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট সিলেটের রাজপথে দাপট দেখিয়েছে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তা এডিসি (ক্রাইম) সাদেক কাউসার দস্তগীর।
তিনি ছিলেন ছাত্র-জনতার আতঙ্ক। হাজারে হাজার গুলি বর্ষিত হয়েছে তার হাত ধরে। ঘটনা প্রবাহের সময় নগরের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ফটক, মদিনা মার্কেট, আখালিয়া সুরমা আবাসিক এলাকার গলির মুখে অ্যাকশন কর্মকর্তা হিসেবে তাকেই দেখা গেছে অগ্রভাগে।
১৯শে জুলাই। শুক্রবার। জুমার নামাজ শেষ হতেই বিএনপি’র মিছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিকই ছিল। অনেক সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত। এডিসি (ক্রাইম) সাদেক কাউসার দস্তগীরের নেতৃত্বে পুলিশের শতাধিক সদস্য সেখানে অবস্থানে ছিলেন।
ফটোসাংবাদিক এটিএম তুরাব সড়কের রেলিং এক হাত দিয়ে ধরে অন্য হাতে ক্যামেরা চালাচ্ছিলেন। এমন সময় হঠাৎ ‘বিগড়ে’ গেলেন এডিসি (ক্রাইম) দস্তগীর। কনস্টেবলের হাত থেকে একটি বন্দুক নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া শুরু করলেন। তার দেখাদেখি অন্য পুলিশ সদস্যরাও বৃষ্টির মতো গুলি ছুড়ে।
এদিন পুলিশের গুলিতে রক্ত ঝরে নগরের কোর্ট পয়েন্টে। উপস্থিত সাংবাদিকরা জানান- পুলিশের গোলাগুলির ফাঁকেই তাদের নজরে পড়েন নিহত হওয়া সাংবাদিক এটিএম তুরাব। রক্তাক্ত অবস্থায় বসে আছেন সড়কে। শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে গুলি লাগেনি। পরে হাসপাতালে নেয়া হলে তুরাব মারা যান। কিন্তু ওইদিনের ঘটনা ভুলতে পারছেন না সিলেটের মাঠের সাংবাদিকরা।
তারা জানিয়েছেন- পুলিশ কর্মকর্তা দস্তগীর অতি উৎসাহী হয়ে গুলি না ছুড়লে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারতো। কিন্তু তার গুলিই গোটা পরিস্থিতি বদলে দেয়। রক্তাক্ত হয় কোর্ট পয়েন্ট। প্রথমেই আক্রান্ত হন সাংবাদিক তুরাব। যেহেতু তিনি রেলিংয়ের কাছে ছিলেন, পেছনে যাওয়ার জায়গা ছিল না সে কারণে বুলেটের পর বুলেটে বিদ্ধ হন তিনি।
শেষ পর্যন্ত অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু ঘটে। এমন ঘটনা সিলেটের রাজপথে কখনোই ঘটেনি। সরাসরি আক্রান্ত হননি সাংবাদিকরা। কিন্তু সিলেটের এই পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন বেপরোয়া। তার বেপরোয়া আচরণের কারণেই ওইদিন রক্তাক্ত হয় নগরের কোর্ট পয়েন্ট এলাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন- সে শুধু গুলিবর্ষণই করেনি, শিক্ষার্থী ও জনতাকে অকথ্য গালিগালাজ করেছে। তার সঙ্গে পুলিশের ডিসি আজবাহার ও সিআরটি প্রধান মামুন ছিলেন বেপরোয়া। তবে দস্তগীরের আচরণেই সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ হয় শিক্ষার্থীরা। সে শিক্ষার্থী দেখলেই গুলিবর্ষণ করতো। ৫ই আগস্ট দুপুর পর্যন্ত প্রাণপণে সিলেটের ছাত্র আন্দোলনকে দমানোর চেষ্টা করেন দস্তগীর।
বিএনপি’র নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন; ৫ই আগস্ট নগরের কোর্ট পয়েন্টে বিজয় মিছিলের আগে দস্তগীরের নেতৃত্বে পুলিশ দল অবিরাম গুলিবর্ষণ করে। এরপর কোর্ট পয়েন্ট ও দরগাহ’র প্রধান ফটক পর্যন্ত গুলিবর্ষণ করে ছাত্র-জনতাকে পিছু হটানোর চেষ্টা করে।
পরে অবশ্য ছাত্র-জনতা দরগাহের ভেতরে ঢুকে রক্ষা পান। পট-পরিবর্তনে সিলেটে পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন দস্তগীর। তাকে ঘিরে সব ক্ষোভ ছিল ছাত্র-জনতার। এ কারণে সাংবাদিক আবু তুরাব হত্যা মামলায় তাকে উপরের সারিতে আসামি করা হয়েছে।
এ মামলার বাদী তুরাবের ভাই আবুল হাসান মো. আজরফ জানিয়েছেন- তুরাব মামলা নিয়ে পুলিশ অনেক নাটক করেছে। ৫ই আগস্টের আগে আমরা কোনো সহযোগিতা পাইনি। পরে অবশ্য মূল অভিযুক্তদের আসামি করে মামলা করা হয়েছে। আশা করছি তদন্তে সত্যতা মিলবে।
সিলেট বিএনপি’র একাধিক নেতা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় কোতোয়ালি থানার এসি থাকাকালে দস্তগীর ওই সময় বিএনপিসহ বিরোধীদের দেখলেই গুলি করতেন। এমনকি প্রকাশ্যে রাজপথে কর্মসূচি পালনের সময় অকথ্য গালিগালাজ ও অসভ্য আচরণ করতেন।
তারা বলেন, সিলেটে সমালোচিত এ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। সে যেখানেই থাকুক সিলেটে আসতে হবে। অপরাধের জন্য তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হবে। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগও তার নেই।
সাংবাদিকরা জানিয়েছেন, কয়েক বছর আগে সিলেটের আলোচিত সাবেক পুলিশ কমিশনার (বর্তমানে কারাবন্দি) মিজানুর রহমানের অন্যতম সহযোগী ছিল এই দস্তগীর। তখন তার নেতৃত্বেই সিলেটের এক সিনিয়র সাংবাদিককে হেনস্তা করা হয়েছিলো। ওই সময় আলোচিত হলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেল্টারে সিলেটে বহাল তবিয়তে ছিল এ পুলিশ কর্মকর্তা।
এদিকে- পট-পরিবর্তনের পর আত্মগোপনে চলে যান পুলিশ কর্মকর্তা দস্তগীর। তার বিরুদ্ধে সিলেটে দুটি হত্যা মামলা ছাড়া অন্তত ১০টি মামলা করা হয়েছে। ভুক্তভোগীরাই আসামি করে তার বিরুদ্ধে এ মামলা করেন। বিতর্কিত এই পুলিশ কর্মকর্তাকে ঘিরে যখনই সিলেটে ক্ষোভ, তখন প্রথমে তাকে পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছিলো। পরে তারা শেরপুরে পুলিশ ইন সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়।
সিলেটের প্রতাবশালী এ পুলিশ কর্মকর্তা বসবাস করতেন নগরের শিবগঞ্জের সাইফা সামিট টাওয়ারে। ওই বাসা ছেড়ে গোপনে তিনি সিলেট ছেড়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান- ৫ই আগস্টের পর থেকে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে কখনোই প্রকাশ্যে দেখা যায়নি। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন আত্মগোপনে।
Leave a Reply