পার্বত্য দুই জেলা রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে নতুন করে সংঘাতের খবর পাওয়া না গেলেও কাটেনি আতঙ্ক। ১৪৪ ধারা তুলে নেয়া হলেও স্বাভাবিক হয়নি দুই জেলার জনজীবন।
৭২ ঘণ্টার অবরোধের দ্বিতীয় দিন গতকালও দুই জেলায় বন্ধ ছিল দূরপাল্লার যানবাহন। তিন উপদেষ্টার পরিদর্শনের পরও খোলেনি অধিকাংশ দোকানপাট। পরিবহন ধর্মঘট ও অবরোধের কারণে রাঙ্গামাটিতে সাধারণ মানুষের যাতায়াতের চরম ভোগান্তি সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল সকাল থেকে রাঙ্গামাটি শহরে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া তেমন মানুষ বের হননি। যাদের জরুরি প্রয়োজন তারা হেঁটে কাজ সেরে বাড়িতে ফিরছেন। সকাল থেকে শহরে কোনো যানবাহন চলাচল করেনি।
রাঙ্গামাটি শহরে একমাত্র যোগাযোগমাধ্যম অটোরিকশাও চলাচল করতে দেখা যায়নি। এ ছাড়া রাঙ্গামাটি-চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি-কাপ্তাই-বান্দরবান রুটেও কোনো যানবাহন চলাচল করেনি। যান চলাচল বন্ধ থাকায় সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
এদিকে রোববার বেলা ১১টার দিকে রাঙ্গামাটি জেলার ১৪৪ ধারা তুলে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিদর্শন করা হচ্ছে।
এ সময় রাঙ্গামাটির রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শওকত ওসমান, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান, পুলিশ সুপার এস এম ফরহাদ হোসেন ও কোতোয়ালি থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী উপস্থিত ছিলেন।
রাঙ্গামাটিতে পাহাড়ি-বাঙালি সংঘর্ষে হতাহত, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় কোর কমিটির মাধ্যমে তদন্ত চালানো হবে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোশারফ হোসেন খান।
এই কোর কমিটি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো সরজমিন পরিদর্শনের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত প্রতি ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি কথা বলে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে। এবং প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
অপরদিকে রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক ঘটনায় এখন পর্যন্ত দুটি মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটির নবাগত পুলিশ সুপার ড. এস এম ফরহাদ হোসেন।
এই দুইটি মামলার আলোকেই রাঙ্গামাটিতে সংঘটিত সংঘর্ষের ঘটনার তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে জানিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, যারাই আইন হাতে তুলে নিয়েছে তাদেরকে কোনো ভাবেই ছাড় দেয়া হবে না। এই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে সকলকেই ভূমিকা রাখার আহ্বানও জানিয়েছেন পুলিশ সুপার।
এদিকে খাগড়াছড়ি শহরের বেশকিছু স্থানে অটোরিকশা চলাচল করলেও রাঙ্গামাটি শহরের অভ্যন্তরেও কোনো যানবাহন চলছে না। এতে বন্ধ রয়েছে দূরপাল্লা ও আঞ্চলিক সড়কের যান চলাচল।
খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন প্রান্তে আটকে আছে কাঁচামাল বহনকারী গাড়ি। আসতে পারছে না ফুয়েল চালিত গাড়িও। খাগড়াছড়ি বাজারে দোকানপাট খোলা থাকলেও ক্রেতাশূন্য দিন কাটছে অনেকের।
খাগড়াছড়ি বাজারে দেখা গেছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে সবজি, মাছসহ বিভিন্ন দোকানপাট খালি পড়ে আছে। অবরোধে গাড়ি চলছে না তাই তারা কোনো মালামাল আনতে পারছেন না।
খাগড়াছড়ির একজন মাছ ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন সকালে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খাগড়াছড়িতে মাছ আনা হতো। অবরোধে কোনো গাড়ি চলছে না বিধায় কোনো মাছ আনা যাচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ী ভোক্তাসহ সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।
একজন সবজি বিক্রেতা জানান, খাগড়াছড়িতে লাখ লাখ মানুষের বসবাস। তাদের চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা থেকে গাড়ি ভরে সবজি আনা হতো। এখন সবজি আনা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে অনেক কাঁচামাল পচে যাচ্ছে।
এদিকে খাগড়াছড়িতে আলোচিত মামুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। ১৯শে সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে নিহতের স্ত্রী মুক্তা আক্তার বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
আসামি হলো- গাড়িচালক মো. শাকিল (২৭), মো. রফিকুল আলম (৫৬) ও মো. দিদারুল আলম (৪৮)। খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন মৃধা মামলা হওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, ১৯শে সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৮টার দিকে নিহতের স্ত্রী মুক্তা আক্তার মামলাটি করেছে। আসামিদের গ্রেপ্তারে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, বর্তমানে খাগড়াছড়ি অনেক শান্ত রয়েছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালি মিলে শান্তি কমিটি করে সম্প্রীতি বজায় রাখতে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
সম্প্রতি পাহাড়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে আমরা আর সেটার পুনরাবৃত্তি চাই না। আমরা সবাই মিলেমিশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রেখে চলতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।
পাহাড়ের ঘটনার প্রতিবাদে গত শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড় মোড় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে ‘বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে ৭২ ঘণ্টার এ অবরোধের ডাক দেয়া হয়। কর্মসূচিতে সমর্থন দিয়েছে সংঘাত ও বৈষম্যবিরোধী পাহাড়ি ছাত্র আন্দোলন নামের সংগঠন।
এ ছাড়া পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টও (ইউপিডিএফ) অবরোধে সমর্থন দেয়। শনিবার সকাল ৬টা থেকে সড়ক ও নৌপথ অবরোধ চলছে।
খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা বাস-মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী সদস্য মো. আবদুল মোমিন বলেন, পরিবহন শ্রমিক, সাধারণ যাত্রীদের জীবনের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।
পার্বত্য যানবাহন মালিক সমিতির সভাপতি নির্নিমেষ দেওয়ান বলেন, তাদের কোনো গাড়ি চলাচল করছে না। এতে গাড়ির সঙ্গে সংযুক্ত অনেক কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন।
খাগড়াছড়ি পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বলেন, অবরোধের কারণে জেলায় কোনো ধরনের সহিংসতা ঘটেনি। শহরে দোকানপাট এবং গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক। প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা টহলে রয়েছে।
Leave a Reply