আজ শুক্রবার। পবিত্র জুমাবার। আজকের বিষয় ‘হযরত ফাতেমা (সা.আ.)-র জীবনী’। শীর্ষবিন্দু পাঠকদের জন্য এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন ‘ইসলাম বিভাগ প্রধান’ ইমাম মাওলানা নুরুর রহমান।
হযরত ফাতেমা ( রাঃ ) -এর জন্ম হযরত ফাতেমা জোহরা ( রাঃ ) -এর নাম জানেনা এমন লোক পৃথিবীর মধ্যে কোথাও পাওয়া যাবেনা । একথা সর্বজন স্বীকৃত। কেননা তার সঠিক পরিচয় সম্পর্কে প্রতিটি মুসলমান জানার কথাও।
যেহেতু তিনি হলেন সাইয়েদুল কাওনাইন পেয়ারা রাসূলুল্লাহ হযরত মুহাম্মদ ( সাঃ ) এর নয়নের মনি কলিজার টুকরা ও সৈয়দ বংশের উৎস ধারা। কেবল এটুকু বলেই তার সঠিক পরিচয় উপস্থাপনা করা মানেই হল তার সম্পর্কে জানা সম্পূর্ণতা হল না যেহেতু তিনি ছিলেন খিলাফতে রাশেদার চতুর্থ খলিফা ইসলামের বীর সৈনিক শেরে খোদা হযরত আলী ( রাঃ ) প্রিয়তমা মহীয়সী।
নাম: ফাতেমা
ভূমিকা: মা’সূম • আসহাবে কিসা
উপনাম: উম্মু আবিহা • উম্মুল আইম্মা • উম্মুল হাসান • উম্মুল হুসাইন • উম্মুল মুহসিন
জন্ম তারিখ: ২০ জামাদিউস সানি, বে’সাতের পঞ্চম বছর
জন্মস্থান: মক্কা
শাহাদাত: ৩ জামাদিউস সানি, ১১ হি.
দাফনের স্থান: অজ্ঞাত
বসবাসের স্থান: মক্কা • মদীনা
উপাধিসমূহ: যাহরা -সিদ্দিকা শাহিদা -তাহেরা -রাযিয়া -মারযিয়া -মুবারাকা – বাতুল
পিতা: সাঈয়্যদুল মুরসালিন মোহাম্মদ সাঃ
মাতা: হযরত খাদিজা সাঃ
সন্তান: হাসান . হোসাঈন.যয়নাব .উম্মে কুলসুম
জীবনকাল: মতভেদ রয়েছে: শিয়া মতানুসারে ১৮ বছর
রাসূলুল্লাহ (সা.) চল্লিশ বছর বয়সে নবুওয়াতপ্রাপ্ত হন। এরপর মহান আল্লাহর নির্দেশে গোপনে তিন বছর মানুষকে ধর্মের দিকে দাওয়াত দিতে থাকেন। তিন বছর পর তিনি প্রকাশ্যে নিজের আত্মীয়-স্বজন ও মক্কাবাসীকে ধর্মের পথে দাওয়াত দেন। রাসূলের গোত্র বনু হাশিমের মধ্য থেকে তাঁর চাচা আবু লাহাব তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে। আর মক্কার নেতৃস্থানীয় কুরাইশরা সকলে রাসূলের সাথে শত্রুতা শুরু করে।
এর মধ্যে রাসূলের পুত্রসন্তানরা মারা গেলে কাফির-মুশরিকরা রাসূলকে নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকে। আস ইবনে ওয়ায়েল রাসূলকে ‘আবতার’ (লেজকাটা) বা নির্বংশ বলে গালি দেয়। সে বলত,‘আরে মুহাম্মাদের তো কোন পুত্রসন্তান নেই,সে মরে গেলে তার নাম নেয়ার মতো ও কেউ থাকবে না।’
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এ কথায় খুব কষ্ট পেতেন। মহান আল্লাহ্ তাঁর এ কষ্ট দূর করার জন্য যে অমূল্য নেয়ামত তাঁকে দান করেন তিনিই হলেন হযরত ফাতিমা (আ.)। এর প্রেক্ষিতেই পবিত্র কুরআনের সূরা কাওসার নাযিল হয়।
নামঃ ফাতেমা, সিদ্দীকা, মুবারিকাহ্, তাহিরাহ্, যাকিয়্যাহ্, রাযিয়্যাহ্, মারযিয়্যাহ্, মুহাদ্দিসাহ্ এবং যাহরা।
ডাক নামঃ উম্মুল হাসান, উম্মুল হুসাইন, উম্মুল মুহ্সিন, উম্মুল আয়েম্মা এবং উম্মে আবিহা।
উপাধিঃ হযরত ফাতিমার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ উপাধি হল যাহরা,যাকিয়াহ,বাতুল ও রাযিয়া। চারিত্রিক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণে তিনি আরও কিছু উপাধিতে ভূষিত হন। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলঃ সিদ্দীকা, কুবরা, মুবারিকাহ্, আযরা, তাহিরা এবং সাইয়্যেদাতুন নিসা।
পিতাঃ ইসলামের মহা সম্মানিত রাসূল (সা.) হযরত মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল্লাহ্ (সা.)।
মাতাঃ ইসলাম গ্রহণকারী সর্বপ্রথম নারী, আল্লাহর রাসূল (সা.) এর সর্বপ্রথম স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা।
জন্মঃ আরবি জমাদিউসসানী মাসের বিশ তারিখে রোজ শুক্রবার,মহানবী (সা.) এর নবুওয়াত লাভের পঞ্চম বৎসরে, মক্কার প্রস্তরময় পর্বতের পাদদেশে, কা’বার সন্নিকটে, ওহী নাযিলের গৃহে, যে গৃহের অঙ্গন মহানবী (সা.) এর খোদাপ্রেমিক মুখের পবিত্র ছটায় আলোকিত হতো, যে গৃহকে ফেরেশতারা ভাল করে চিনতো এবং সেখানে প্রতিনিয়ত আসা যাওয়া করতো, যেখানে সকাল সন্ধ্যায় রাসূলে খোদার নামাজের গুঞ্জরন প্রতিধ্বনিত হতো এবং গভীর রাত্রিতে তাঁর তিলাওয়াতের আধ্যাত্মিক ধ্বনিতে জমিনের সাথে আসমানের সংযোগ স্থাপিত হতো, ইয়াতিমদের আশার কেন্দ্র, নিঃস্ব মানুষের সাহায্যকারী, বন্দী ও নিপীড়িতদের আশ্রয়স্থল, সেই গৃহে পয়গম্বর (সা.) ও হযরত খাদিজার গৃহে একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে।
সন্তানঃ ইমাম হাসান মুজতাবা,ইমাম হুসাইন সাইয়্যেদুশ শুহাদা,জয়নাব আল কুবরা,উম্মে কুলসুম,মুহ্সিন (তাঁর গর্ভেই মারা যায়)।
শাহাদাত: মহানবী (সা.) ইন্তেকালের পর বিভিন্ন রকম দুঃখ-কষ্ট হযরত ফাতেমার অন্তরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ তাঁর জীবনটাকে তিক্ত ও অসহ্য করে তুলেছিল। তিনি তাঁর সম্মানিত পিতাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং কখনো তাঁর বিচ্ছেদকে সহ্য করতে পারতেন না।
একদিকে তাঁর জন্যে পিতার বিয়োগ ব্যথা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। অপরদিকে আমিরুল মুমিনীনের খেলাফতের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের আচরণ হযরত ফাতিমা আয যাহরার রুহ্ ও দেহে সাংঘাতিক ক্ষতের সৃষ্টি করে।
আর এ মুছিবত ও দুঃখ কষ্ট ছাড়াও অন্যান্য ব্যথা বেদনা তাঁকে জর্জরিত করেছিল -যার অবতারণা থেকে এখানে বিরত থাকছি- এসকল কারণেই।
হযরত ফাতেমা (আ.) পিতার ইন্তেকালের পর সর্বদা ক্রন্দনরত ও শোকার্ত ছিলেন। তিনি কখনো তাঁর পিতার কবর যিয়ারতে গিয়ে অনেক কাঁদতেন। আবার কখনো শহীদদের কবরের পার্শ্বে গিয়ে আহাযারী করতেন।
নিজ গৃহে কান্না ও শোক পালন ব্যতীত অন্য কিছুই করতেন না। তাঁর ক্রন্দন ও রোনাজারীর ব্যাপারে মদীনাবাসীরা প্রতিবাদ করলে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর জন্যে ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থানের এক প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘর তৈরী করে দেন যা পরবর্তীতে ‘বাইতুল আহ্যান’ বা ‘শোকের ঘর’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে।
হযরত যাহরা (আ.) প্রতিদিন সকালে হাসানাইন তথা ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে সাথে নিয়ে সেখানে চলে যেতেন আর রাত পর্যন্ত কবরগুলোর পাশে কান্নাকাটি করতেন। রাত্রি হলেই আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁকে কবরস্থান থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আর এ কাজ তাঁর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
রাসূল (সা.)-এর সাথে বিচ্ছেদে হযরত যাহরার ব্যথা বেদনা ও দুঃখ কষ্ট এত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে নবী (সা.)-এর যে কোন স্মৃতিই তাঁকে কান্নায় জর্জরিত ও অস্থির করে তুলতো।
হযরত রাসূল (সা.) এর মুয়াযযিন হযরত বেলাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে,নবী (সা.)-এর তিরোনের পর আর কোনদিন কারো জন্যে আযান বলবেন না। একদিন হযরত যাহরা (আ.) বললেন : “আমার পিতার মুয়াযযিনের কণ্ঠে আযান শুনতে মন চায়”।
এ সংবাদ হযরত বেলালের কর্ণগোচর হলে তিনি তড়িৎগতিতে এসে হযরত ফাতেমার সামনে আযান দিতে দাঁড়িয়ে যান। যখন হযরত বেলালের কণ্ঠে আল্লাহু আকবারের ধ্বনি উচ্চারিত হলো তখন হযরত ফাতেমা চোখে আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না।
আর যখন হযরত বেলালের আযান ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’-তে পৌঁছায় তখন হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উপস্থিত লোকজন হযরত বেলালকে বললেন: “থামুন! রাসূলের কন্যা মারা যাচ্ছেন।”
তারা মনে করেছিলেন যে,হযরত ফাতেমা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। হযরত বেলাল আযান অসম্পূর্ণ রেখে ক্ষান্ত হলেন। যখন হযরত ফাতেমার চৈতন্য ফিরে আসলো তখন হযরত বেলালকে আযান সম্পূর্ণ করার জন্যে বললেন। কিন্তু হযরত বেলাল তাঁর খেদমতে আরজ করলেন: “হে নারীদের নেত্রী! আমার আযানের ধ্বনি শ্রবনের ফলে আপনার প্রাণনাশের আশংকা করছি।
অবশেষে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর অসহনীয় মর্মপীড়া এবং তাঁর উপর আরোপিত দুঃখ-কষ্ট তাঁকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শয্যাশায়ী করে ফেললো। পরিশেষে এ আঘাত ও দুঃখ-কষ্টের কারণে একাদশ হিজরীর জামাদিউল উলার তের তারিখে, কারো মতে জামাদিউসসানী মাসের তৃতীয় দিনে অর্থাৎ হযরত নবী করীমের তিরোধানের মাত্র পঁচাত্তর অথবা পঁচানব্বই দিনের ব্যবধানে তিনি চিরদিনের জন্যে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের অন্তরসমূহকে চিরদিনের জন্যে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন।
কবরঃ রাজনৈতিক এবং তাঁর অসিয়তের কারণে অন্ধকার রাত্রে গোপনে আমিরুল মু’মিনীন তাঁর দাফনকার্য সম্পন্ন করেন। আজ অবধি তাঁর পবিত্র কবরের চিহ্ন উদঘাটিত হয় নি।
Leave a Reply