শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ১১:২৮

গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সংবাদ: যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিভক্ত বাংলাদেশ

গার্ডিয়ানে প্রকাশিত সংবাদ: যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বিভক্ত বাংলাদেশ

 

২৩শে ফেব্রুয়ারি লন্ডনের প্রভাবশালী অনলাইন গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্প্লিট অ্যাজ ভায়োলেন্স এস্কেলেটস ওভার ওয়ার ক্রাইমস প্রটেস্টস’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়  যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সহিংসতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে পড়ছে।

যারা মনে করেন শাহবাগের আন্দোলন ভুল এবং যারা এই পক্ষকে ইসলামবিরোধী মনে করেন তাদের মধ্যে এই ব্যবধান বাড়ছে। এতে আরও বলা হয়, এর আগে নাজমুল হোসেন কখনও কোন প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দেন নি। কিন্তু গত প্রায় পক্ষকাল ধরে ৪৫ বছর বয়সী এই বাংলাদেশী ব্যাংকার নিয়মিত অল্প সময়ের জন্য হলেও শাহবাগ স্কয়ারে যান। সেখানকার গণজাগরণ থেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধী রাজনীতিবিদদের ফাঁসি দাবি করা হচ্ছে। শনিবার তিনি তার ৬ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে এসেছিলেন ওই গণজাগরণে। তার হাতে ছিল একটি ব্যানার- ‘রাজাকারের ফাঁসি চাই’। ওই শিশুটির হাতে ছিল একটি খেলনা বন্দুক। নাজমুল হোসেন বলেন, তার এক নিকট আত্মীয়কে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে। যারা হত্যা করেছে এবং যারা সেই ঘাতকদের সহায়তা করেছে তাদেরকে আমি ক্ষমা করে দিতে পারি না।

শহরের অন্যদিকে ৫৮ বছর বয়সী এক কাঠ ব্যবসায়ী শামসুজ্জামান। শাহবাগ নিয়ে আলোচনা উঠতেই তিনিও একই রকম ক্ষোভ প্রকাশ করলেন। তবে তার কারণ ভিন্ন। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধ একটি বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশে তো আরও অনেক সমস্যা আছে। তিনি বলেন, ওই বিক্ষোভে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা নাস্তিক। তারা ইসলাম, আল্লাহ ও মহানবী (সা.)-কে অবমাননা করেছে। এখন এই দু’পক্ষের মধ্যে বিভক্তি তীব্র হয়েছে। শুক্রবার থেকে সহিংসতায় সারা দেশে কমপক্ষে ৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে দু’জন বিরোধীদলীয় সদস্য। স্থানীয় পুলিশ নিশ্চিত করেছে, তারা পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন। শুক্রবার রক্ষণশীল ইসলামপন্থিদের জুমার নামাজের পরে এই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল ইসলামপন্থি দলগুলো হরতাল আহ্বান করে। বিরোধীদলীয় নেতাদের ওপর অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগের অভিযোগে তারা এই হরতালের ডাক দেয়। তবে পুলিশ বলেছে, তারা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল। বাংলাদেশের অতীতের মধ্যে একে অন্যের প্রতি যথেষ্ট অবিশ্বাস জন্ম হয়েছে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের যোদ্ধা মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় শক্তির কাছে হেরে যায়। ওই যুদ্ধে ভারত হস্তক্ষেপ করেছিল। এ যুদ্ধে কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হন। যারা চেয়েছিলেন বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ থাকুক তাদের হাতে এর অনেকে নিহত হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালে ওই যুদ্ধের সময় নৃশংসতা তদন্ত করে বিচারের জন্য যুদ্ধাপরাধ আদালত গঠন করেন। তার মতে, এতে যেসব পরিবার যুদ্ধে তাদের নিকটজনকে হারিয়েছেন এবং যারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের ক্ষত মুছে যাবে। কিন্তু বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর প্রধান খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন- শেখ হাসিনা আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করছেন। এর মধ্য দিয়ে হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করছেন।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যে ১০ ব্যক্তিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করেছে তারা সবাই বিরোধী রাজনীতিক। এর মধ্যে ৮ জন জামায়াতে ইসলামীর প্রভাবশালী নেতা। এরা বিএনপির মিত্র এবং বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থি দল। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিভিন্ন  মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপের এই বিচার কার্যক্রমকে রাজনীতিকীকরণ ও প্রক্রিয়ার মধ্যে ত্রুটি আছে বলে এর সমালোচনা করা সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধ আদালত এখনও ব্যাপক জনপ্রিয়। গত মাসে এই আদালত জামায়াতে ইসলামীর সাবেক এক সদস্যকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন আদালত।

৫ই ফেব্রুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। এতেই শাহবাগের বিক্ষোভের স্ফুরণ ঘটে। তারপর থেকে, লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষ শাহবাগে সমবেত হচ্ছেন। তাদের সবার দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এই সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমান এ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুবিধা রেখে সংশোধিত আইনে স্বাক্ষর করেছেন। এর ফলে প্রতিবাদীদের দাবি অনুযায়ী, সরকার যাদেরকে কম সাজা দেয়া হবে তাদের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবে। এ আইনের ফলে সরকার পুরো সংগঠনকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে নিষিদ্ধ করতে পারবে। তারপরও প্রতিবাদীরা তাদের চাপ অব্যাহত রেখেছে। তারা বলেছে, যতক্ষণ যুদ্ধাপরাধ আদালত থেকে অভিযুক্ত সবাইকে ফাঁসি দেয়া না হবে ততক্ষণ তারা সেখানে অবস্থান করবেন। তারা বেশ কিছু দাবি সামনে তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা, ইসলামী গ্রুপের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাজেয়াপ্ত করা। শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম মুখ, বামপন্থি রাজনৈতিক দলের নেত্রী লাকি আকতার (২৩) বলেন, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে ৪০ বছর যাবৎ প্রতিবাদ করছি। আমরা চাই যারা পাকিস্তানিদের সহযোগী ছিল তাদের ফাঁসি দেয়া হোক ও তাদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক বাতিল করা হোক। ওই রিপোর্টে বলা হয়, অতীতের উত্তেজনা বাংলাদেশের বর্তমানে কিভাবে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে তার প্রকাশ শাহবাগ।

রাজনৈতিক ভাষ্যকার ও সাবেক একজন সম্পাদক এবিএম মূসা বলেন, এই প্রতিবাদের আদর্শগত একটি ভিত্তি আছে। সবাই বিশ্বাস করেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। এ জন্য সেই সব সহযোগীর বিচার হতে হবে। শনিবার শাহবাগে জমায়েত হয় বিপুল সংখ্যক প্রতিবাদী মানুষ। এ সময় রাজাকারদের ফাঁসি দাবি করা হয় স্লোগানে। তারা বলেন, একাত্তুরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেক বার।

যুদ্ধাপরাধ আদালতের বিরুদ্ধে রাজপথে সহিংসতা ঘটিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তারা বলছে, তারা অন্যের দোষের ফল ভোগ করছে। এ দলের নেতা শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, রাজনৈতিক অবস্থান ও যুদ্ধাপরাধের মধ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন অনেক মানুষ। তিনি বলেন, এখন থেকে ৪২ বছর আগে রাজনৈতিক অবস্থান যারা নিয়েছিলেন তাদের মাত্র শতকরা ৫০ ভাগ এখন দলে সক্রিয়। হয়তো তাদের কেউ কেউ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হোক তা চান নি। কিন্তু এটাই যুদ্ধাপরাধের জন্য যথেষ্ট নয়। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে। এদেশে নিবন্ধিত একটি রাজনৈতিক দল। জাতীয় সংসদে রয়েছে এ দলের প্রতিনিধি।

জেনেভাভিত্তিক আইনি পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জাস্টিস (আইসিজে) যুদ্ধে যে ক্ষত হয়েছে বাংলাদেশের তা সারিয়ে উঠতে সুষ্ঠু বিচার প্রয়োজন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের নির্যাতিতরা যাতে ন্যায়বিচার পান তা নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই বিচার হতে হবে একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিচারকরা যদি গণবিক্ষোভে ভীত হয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন তাহলে তা ন্যায়বিচার হবে না। তাতে আরেক দফা সহিংসতা ছড়িয়ে পড়বে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, এমন সতর্কতার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে শাহবাগের প্রতিবাদী জনতা।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিষয় বাংলাদেশের সংবাদপত্রে, রেডিও-টেলিভিশনে, ওয়েবসাইটে প্রচারিত হচ্ছে যথাযোগ্য মর্যাদায়। এর মধ্য দিয়ে শাহবাগের প্রতিবাদী তরুণ সমাজকে অপ্রত্যাশিত একত্রিত করছে। লাকি আকতার বলেন, জনগণ তাদের রায় দিয়ে দিয়েছে। এখন তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব আদালত ও রাজনীতিবিদদের ওপর। বিশ্লেষকরা বলেন, এই প্রতিবাদ থেকে সরকার সুবিধা নিচ্ছে। তারা অর্থনৈতিক ও তাদের শাসন পদ্ধতি নিয়ে বিরোধী দল যে প্রচারণা চালিয়েছিল তা থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে। গত বছর নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সাংবিধানিক উপায়ে বাতিল করে দেয় শেখ হাসিনার সরকার। এর ফলে বিরোধী দল আগামী বছরের শুরুর দিকে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছে।

ঢাকা ট্রিবিউনের সম্পাদক জাফর সোবহান বলেন, এখন আমাদের নজর দিতে হবে আগামী বছরের নির্বাচনের দিকে। একই সঙ্গে সরকার ক্ষমতায় থেকে কি কি কাজ করেছে তাও দেখতে হবে। পাশাপাশি বিরোধীদের দাবিও আমলে নিতে হবে। এখন নির্বাচন নিয়ে এক রকম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এর পরে রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয় তা-ও দেখার বিষয়।

ব্লগারস নেটওয়ার্কের সমন্বয়ক আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, শাহবাগের এই আন্দোলন শাহবাগ থেকেই শুরু হয় নি। আমরা বছরের পর বছর ধরে ধর্মীয় মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি ব্লগে। তবে শাহবাগ সফল হয়েছে। কারণ, বেশির ভাগ মানুষই যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ক্ষুব্ধ। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেশকে মেরুকরণ করেছে। এর ফলে যারা নিজেদের গ্রগতিবাদী হিসেবে প্রকাশ করেন তাদের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে।

 




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮  
All rights reserved © shirshobindu.com 2012-2024