[youtube id=”16hl86whJiQ” width=”600″ height=”350″]ভদ্রলোক শুধু হাসাতেই জানেন আর হাসতে জানেন। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস, নাটক, কল্পবিজ্ঞান কিংবা অন্যান্য লেখা যারা পড়েছেন তাদের মনে এমন বিশ্বাস ঢোকাই স্বাভাবিক। তার লেখা আশার খোরাক যোগায়, হাসির উপকরণ দেখায়। মন খারাপ করার, পরকাল নিয়ে টেনশন করার কিংবা হতাশার উপাদান কমই থাকতো তার লেখায়। অনেকের ধারণা ছিল, হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন কেবল সফলতার পিছে ছোটা একজন মানুষ। ধর্ম নিয়ে, পরকাল নিয়ে তিনি একটুও ভাবেন না। তিনি কেবল ভাবেন মরণসাগরের এই পারের তাত্ক্ষণিক সাফল্য, সুখ, বিলাসিতা এবং আনন্দ নিয়ে।
তাছাড়া এই নন্দিত কথাসাহিত্যিকের মৃত্যুর পর তার জানাজা হওয়া উচিত নয় বলে একটি শ্রেণী ইন্টারনেটে বিভিন্ন ব্লগে প্রচার শুরু করে। তারা হুমায়ূন আহমেদের তথাকথিক একটি সাক্ষাত্কারের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রচার করতে থাকে যে তিনি ধর্মে বিশ্বাস করতেন না! এজাতীয় শত শত লেখা পোস্ট করা হয় ইন্টারনেটে। এই প্রোপাগান্ডার খপ্পরে পড়ে অনেক হুমায়ূনভক্তও বিশ্বাস করতে শুরু করে সত্যিই তিনি ‘নাস্তিক’ ছিলেন!
কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করবে ক্যান্সার আক্রান্ত হুমায়ূন আহমেদ চিকিত্সার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যাবার পর সেখানকার একটি ঘরোয়া আড্ডার ভিডিও চিত্র দেখলে। লেখকের মৃত্যুর কিছুদিন আগের আড্ডার দৃশ্য এটি। লেখক যুক্তরাষ্ট্রে যাবার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা তার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তিনি তাদের সঙ্গে গল্প-গুজব করতেন। তেমনই একটি গল্পগুজবের আসরের ভিডিও এটি। আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা অজ্ঞাত। তাদের মধ্যে কেউ একজন মোবাইল ফোনে শখের বসে ভিডিও করেছেন এবং ভিডিওটি ইন্টারনেটে শেয়ার করেছেন। হুমায়ূন আহমেদ বেঁচে থাকলে এই ভিডিওটি মূল্যহীন হতো। তা নিয়ে কারো কৌতূহল থাকতো না। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তির মৃত্যুর পর ভিডিওটি এখন অমূল্য সংগ্রহে পরিণত হয়েছে। কারণ ভিডিও থেকে এমন এক হুমায়ূন আহমেদকে চেনা গেল, তার যে রূপটির কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতেন না। ভিডিওটি করা না হলে কেউ জানতেও পারতেন না সদা উত্ফুল্ল, বাস্তববাদী এবং সফলতার পেছনে ছুটে চলা হুমায়ূন আহমেদ ধর্মের বাণী, সৃষ্টিকর্তা, এবং পরকাল নিয়ে কতটা ভাবতেন। সৃষ্টিকর্তার উপর কতটা আস্থাশীল ছিলেন। মরণের কঠিন বাস্তবতা কত কঠোরভাবে উপলদ্ধি করতেন। আর কেবল হাসতে নয়, তিনি কাঁদতেও জানতেন। ভিডিওটি দেখে এটাও মনে হতে পারে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ের ব্যাপারে লেখক হয়তো কিছুটা হলেও সন্দিহানও ছিলেন।
মরিলে কান্দিস না আমার দায় : ভিডিওটির শুরুতে দেখা যায় আড্ডায় আলোচনা হচ্ছে গান প্রসঙ্গে। এতে দেখা যায় হুমায়ূন আহমেদ বলছেন, ‘আমরা বড় বড় মানুষের কথা শুনলাম। রবীন্দ্রনাথের কথা শুনলাম, নজরুলের কথা শুনলাম। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক সাধারণ মানুষ অসাধারণ গান লিখতে পারেন, অসাধারণ সুর দিতে পারেন।’
বোঝা গেল তিনি একজন সাধারণ গ্রাম্য মানুষের কথা বলছেন। তার নাম গিয়াসউদ্দিন। ২০ বছর ধরে গান লিখেছেন, সুর করেছেন, গেয়েছেন। কিন্তু তার মতো গ্রাম্য ‘হাতুড়ে’ গীতিকার ও সুরকার রেডিও-টিভিতে সুযোগ পাবেন না এটাই স্বাভাবিক। সুযোগ হয়নিও। এটা ছিল তার বড় দুঃখ। ঘটনাক্রমে তিনি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে একবার দেখা করার সুযোগ পেয়ে যান। তিনি লেখককে তার কষ্টের কথা জানান। অনুরোধ করেন রেডিও কিংবা টিভিতে তার পরিচিত কাউকে একটু সুপারিশ করে দেয়ার যাতে তিনি শিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে পারেন। এরপর তার নিজের লেখা ও সুর করা ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’ (মারা গেলে আমার জন্য কাঁদিস না) গেয়ে শোনান। গানটি শুনে নিজের ভেতরে পরিবর্তনটা বুঝতে পারেন হুমায়ূন আহমেদ। হারিয়ে যান অন্য এক জগতে। কারণ গানটি প্রত্যেকের জীবনে চরম বাস্তবতা। গান শুনে হুমায়ূন আহমেদ বিটিভির তত্কালীন জেনারেল ম্যানেজার নওজেশ আলী খানের কাছে একটা চিঠি লিখে অনুরোধ করেন গিয়াসউদ্দিনকে টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী করা যায় কি না। নওজেশ আলী খান লেখকের অনুরোধ রেখে গিয়াসউদ্দিনকে তালিকাভুক্ত শিল্পী করেন। কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হবার আনন্দ বেশিক্ষণ উপভোগ করতে পারেননি গিয়াসউদ্দিন। তিনি বাড়ি ফিরে গিয়েই মারা যান।
আড্ডায় এটুকু শোনানোর পর হুমায়ূন আহমেদ অতিথিদের বলেন, ‘এবার আমরা সবাই সেই গানটি শুনব। তিনি সোফায় বসে থাকা শাওনকে অনুরোধ করেন গানটি গাইবার জন্য। শাওন শুরু করেন। মরিলে কান্দিস না আমার দায়/ রে যাদুধন/ মরিলে কান্দিস না আমার দায়। সুরা ইয়াসিন পাঠ করিও/ বসিয়া কাছায়/ যাইবার কালে বাঁচি যেন/ শয়তানের ধোকা (থেকে)/ রে যাদুধন/ মরিলে কান্দিস না আমার দায়। বুক বান্দিয়া কাছে বইসা/গোসল করাইবা/ কান্দনের বদলে মুখে/ কলমা পড়িবা/ রে যাদুধন/ মরিলে কান্দিস না আমার দায়। কাফন পিন্দাইয়া যদি/ কান্দো আমার দায়/ মসজিদে বসিয়া রে কাইন্দো/ আল্লাহ’র দরগায়/ রে যাদুধন/ মরিলে কান্দিস না আমার দায়।
পিনপতন নীরবতার মধ্যে শাওন গেয়ে চলেছেন। কিন্তু এই গানটি শুরু করার পরই হুমায়ূন আহমেদ যেন কেমন হয়ে যান। চোখমুখে ফুটে ওঠে কিসে যেন ভয়। চেহারায় ভেসে ওঠে শিশুসুলভ সরলতার ছাপ। মৃত্যুর কঠিন বাস্তবতা যেন এই মুহূর্তে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারছেন ক্যান্সারে আক্রান্ত লেখক। তিনি সামনে পেছনে অস্থিরভাবে দুলছেন। গানের কথার সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সায় দিচ্ছেন। একপর্যায়ে কেঁদে ফেলেন তিনি! চশমা খুলে হাত দিয়ে দুই চোখ মোছেন।
শাওন গান শেষ করার পর দেখা যায়, সবাই যেন পাথর হয়ে গেছেন! তাদের ধাতস্ত হতে বেশ একটু সময় লেগে যায়। আড্ডায় উপস্থিত এক ভদ্রমহিলা বলেই ফেললেন, ‘গানটা শুনলে কলিজা টলিজা যেন ফাটি যায়’! শাওনকে দেখা যায় তিনিও বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন। উপস্থিত আরেক ভদ্রলোক বলছেন, যাওয়ার আগে সবাইরে কান্দাইয়া দিলা!
বেঁচে থাকো আরো ৫০ বছর : এই পর্যায় আড্ডা শেষ হয়। সবাই যার যার ঘরে ফেরার জন্য উঠে দাঁড়ান। একজন বলেন, আমরা হুমায়ূন আঙ্কেলের জন্য সবাই নামাজ পড়ে দোয়া করব যাতে উনি আরো ৫০ বছর বেঁচে থাকেন। শাওন বলে ওঠেন, ইস্ মাত্র ৫০ বছর? স্ত্রীর কথা শুনে হুমায়ূন আহমেদ এবার গানের ঘোর কাটিয়ে তার মুখের বিষন্নতার মেঘ সরিয়ে হেসে ওঠেন। আয়ু প্রার্থনা একটু কম করা হয়ে গেছে মনে করে প্রার্থনাকারী এবার বলেন, এটা মিনিমাম। আসলে এরপর তিনি বলেন, আমাদের পুরো জীবদ্দশাতেই আঙ্কেলকে পাশে পেতে চাই।
কলিজা-টলিজা গলে শেষ! : ভিডিওতে দেখা যায়, অতিথিরা বিদায় নেয়ার আগ মুহূর্তে হুমায়ূন আহমেদ তার আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘আমি স্লোয়ান ক্যাটারিংয়ের ডাক্তার স্টিফেন আরভিচকে আমার সব মেডিক্যাল কাগজপত্র দেখালাম। তিনি মনোযোগ দিয়ে প্রথমে আমাকে দেখলেন, তারপর কাগজপত্র সব দেখলেন। এরপর আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘ডক্টর, অ্যাম আই গোয়িং টু ডাই (আমি কি মারা যাব)?’ ডাক্তার বললেন, ‘ইয়েস, ইউ আর গোয়িং টু ডাই (হ্যাঁ, আপনি মারা যাবেন)!’ হুমায়ুন হাসতে হাসতে বলেন, ‘ডাক্তারের কথা শুনে আমার তো কলিজা টলিজা গলে শেষ!’ একটু থেমে তিনি আবার বলেন, ‘আমার অবস্থা বুঝতে পেরে ডাক্তার আরভিচ ভাবলেন, এত কড়া রসিকতা করা ঠিক হয়নি।’ তিনি হেসে দিয়ে বললেন, ‘শোনো বাছা! আমরা সবাই (একদিন) মরতে যাচ্ছি! কিন্তু আমি তোমাকে এত তাড়াতাড়ি মরতে দেব না।’ হুমায়ূন আহমেদ ধড়ে প্রাণ ফিরে পান। বুঝতে পারেন বাঁচার আশা শেষ হয়ে যায়নি।
সুরা বনি ইস্রাইলের আয়াত : মৃত্যু নিয়ে আলাপচারিতা শুরু হবার পর এক পর্যায়ে হুমায়ূন আহমেদ তার সবকিছুই সৃষ্টিকর্তার ওপর সপে দেন। তিনি বোঝাতে চান, সবাইকে একদিন পৃথিবীর মায়া ছাড়তে হবে। এটা আমোঘ সত্য। তিনি বলেন, সুরা বনি ইস্রাইলের একটা আয়াত আমার খুব পছন্দ। আয়াতটির অর্থ হচ্ছে, আমি তোমাদের প্রত্যেকের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলিয়ে দিয়েছি।’ এরপর তিনি আবেগজড়িত গলায় বলেন, ‘কাজেই আমাদের ভাগ্যে যা ঘটবে তার সব কিছুই মহান আল্লাহ তা’লার সিদ্ধান্ত।’
নন্দিত এই কথাসাহিত্যিক এবার সবার অলক্ষ্যে চলে আসা চোখের পানিটা অতিথিদের কাছ থেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। আবারও টিস্যু দিয়ে চোখ মোছেন। ডাক্তার হাজার আশার বাণী শোনালেও, কোটি টাকা খরচ করলেও তার ব্যাপারে উপরওয়ালার সিদ্ধান্তটাও তিনি বুঝে ফেলেছিলেন কি না কে জানে! -প্রতাপ চন্দ্র
Leave a Reply