বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ০১:৩১

এক দিনে এত মানুষ হত্যার ঘটনা এই প্রথম

এক দিনে এত মানুষ হত্যার ঘটনা এই প্রথম

/ ১২৮
প্রকাশ কাল: বৃহস্পতিবার, ৭ মার্চ, ২০১৩

 

হারুন-আর-রশিদ: ২৮ ফেব্রুয়ারি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ‘ফাঁসির রায়’ ঘোষণার পর দেশব্যাপী যে সহিংসতার ঘটনা ঘটে, তাতে প্রায় অর্ধশত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। স্বাধীনতার পর বিগত ৪১ বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় এক দিনে এত মানুষ নিহতের ঘটনা এই প্রথম। যেই হেতু নির্বিচারে পুলিশের গুলিতে এক দিনে এত মানুষের নিহত হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজীরবিহীন। ওই দিন বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতেও নিরস্ত্র মানুষগুলোকে ধাওয়া করতে গিয়ে পুলিশবাহিনী কিভাবে ধানক্ষেতে, রাস্তার পাশে বন্দুকের বাঁট দিয়ে আঘাত করে ফেলে দিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা কয়েছে সে মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে, গা শিউরে ওঠে। কোনো কোনো পত্রিকা এ ধরনের সংবাদ ছেপেছে সার্বিয়ার পৈশাচিক সৈন্যরাও বসনিয়ার নিরীহ মুসলিম জনতাকে এভাবে খুন করেনি। বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্ঘাত কাশ্মির ও ফিলিস্তিনে বিধর্মীদের অত্যাচারকেও হার মানিয়েছে। অনেকের অভিমত আমাদের দেশে যারা ৭১-এর পরও আত্মঘাতী হানাহানি ও সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়েছিলেন দলীয় বা ব্যক্তিস্বার্থে, তাদের সবাই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। যে ধর্ম ঐক্য, শান্তি ও ভ্রাতৃত্ববন্ধন দৃঢ় করার কথা শেখায়, সেই ধর্মের মানুষগুলোই আজ বেশি অনৈক্য ও অশান্তিতে ভুগছে নীতিহীন রাজনীতির কারণে। ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ চত্বরে যারা মাসব্যাপী রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিয়ে জনগণকে চরম দুর্ভোগে ফেলে আন্দোলন করছেন, তারাও মূলত এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের মানুষের অনুসারী। শাহবাগে যারা আন্দোলন করছেন তাদের মূল দাবি সরকার মেনে নিয়েছে, অর্থাৎ উভয় পক্ষের আপিলের সুযোগ সমানভাবে থাকবে। তার পরও আবেগ-উত্তেজনার উত্তাপ গোটা দেশে ছড়িয়ে দেয়ার যে হুঙ্কার দেয়া হচ্ছে, সেটা প্রকৃত অর্থে সমস্যাকে আরো তীব্র করবে, সঙ্ঘাতের পথকে প্রশস্ত করবে। এখন স্পষ্ট বোঝা যায়, সরকারের মদদে ও রাজনৈতিক স্বার্থে এই আন্দোলন দীর্ঘতর হচ্ছে। এ কথা পত্রপত্রিকায়ও উঠেছে। এ দিকে কষ্ট বাড়ছে সাধারণ মানুষের। এমনিতেই যানজটের দেশ বাংলাদেশ, তারপর যদি সবাই নগরীর রাজপথগুলোকে নিজেদের মতো করে আন্দোলনের মঞ্চ বানিয়ে রাখে, এতে কোনো সুযোগসন্ধানীপক্ষ লাভবান হলেও জনজীবন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন শুধু ব্যাহতই হবে। ক্ষতি হবে জনসাধারণের। একটি দেশে দুটো সরকার কী করে থাকে? সরকারও বা কিভাবে মেনে নেয় এটাকে? গণমাধ্যমে যেভাবে খবর প্রকাশিত হচ্ছে এবং আমরা স্বচক্ষে যেভাবে দেখছি, তাতে মানুষের মনে হচ্ছে, একটি দেশে এখন দু’টি সরকার। পতাকা অমুক দিন অর্ধনমিত থাকবে। অমুক দিন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা পালনের আদেশ-নির্দেশ আসছে শাহবাগ চত্বর থেকে। বিরোধী দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার বক্তব্যের প্রতিও হুঁশিয়ারি বার্তা দেয়া হচ্ছে। এখন বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা, শেয়ার বাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনির লুটপাটের টাকা ফেরত, গুম-খুন গ্রেফতার নির্যাতন বন্ধ করার জন্য লাখ মানুষ নিয়ে যদি কোনো চত্বর বানিয়ে ফেলে তাহলে দেশের অবস্থা কী হবে, সেটা সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের না বোঝার কথা নয়। প্রজন্ম চত্বরকে সরকার পাহারা দিচ্ছে। অথচ শিক্ষক সমাবেশকে মরিচের গুঁড়া দিয়ে এবং লাঠিপেটা করে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এসব পত্রিকায় উঠেছে। ‘তৌহীদি জনতার মঞ্চ’ বানানোর কথাও শোনা যাচ্ছে নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে। এ রকম একটি জটিল অবস্থা থেকে দেশকে বাঁচাতে পারেন প্রধানমন্ত্রী তার একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে। কারণ প্রধানমন্ত্রী কোনো দলের নন,  তিনি ১৬ কোটি মানুষের।

দেশকে যারা ভালোবাসেন, দেশে আরেকটি ’৭১ ঘটনা ঘটুক এটা তারা চাইতে পারেন না। কারণ বাংলাদেশের বন্ধু যেমন আছে, তেমনি শত্রুর সংখ্যাও কম নয়। ’৭১-এর ঘটনার দিকে যারা দেশটাকে ধাবিত করাতে চান, তারা বর্তমানে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতোই ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষকেই উসকে দিচ্ছেন অজান্তে হলেও। দেশপ্রেমিক কোনো মানুষ এ ধরনের পরিস্থিতি কামনা করতে পারেন না। শান্তিকামী সব মানুষ দু’বেলা ডাল-ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে চান। দেশে অশান্তি ও সহিংসতা বিরাজ করলে দু’বেলা অন্ন জোগাড় করা সাধারণ মানুষগুলোরই কষ্ট হবে। রাজনৈতিক নেতাদের ছেলেমেয়েরা এ দেশে থাকে কমই, এক কথায় তাদের আস্থা বিদেশে। অতি অল্প সময়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যাওয়ার দেশটাই বাংলাদেশ, বিশেষ করে একশ্রেণীর রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ীদের জন্য। মৃত্যুর শেষ দিন পর্যন্ত সাধারণ মানুষই এ দেশ আঁকড়ে পড়ে থাকবেন অতীতের মতো।

ছাত্রদের কাজ পড়াশুনা করা, বিচার বিভাগের কাজ স্বাধীনভাবে বিচার করা। এখন সেই বিচার যদি কোনো মহলের দ্বারা বিঘিœত হয়, তাহলে বিচারকদের ইস্তফা দেয়ার মতো অবস্থা দাঁড়ায়। ঠিক তদ্রুপ কোনো চত্বর থেকে যদি সরকারি আইনের মতো নির্দেশ-আদেশ আসতে থাকে এবং তা যদি জনগণকে ভয়ে হলেও মানতেই হয়, তাহলে সরকার আর ক্ষমতায় থাকার অর্থ থাকে না। একটি দেশে দু’টি সরকার বা সমতুল্য কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে না। এক মাস ধরে বাংলাদেশে যে দৃশ্য আমরা দেখছি, তা গণতান্ত্রিক কোনো রাষ্ট্রে ঘটেছে বলে জানা নেই। ফাঁসির রায়ের দিন বাঁধভাঙা উল্লাসে তাদের মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে আমাদের রায় বিচার বিভাগ মেনে নিয়েছেন অর্থাৎ আমরা যা চেয়েছি তা পেয়েছি। এরাই সরকারদলীয় কর্মীদের মতো যদি হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে সরকারের কী অবস্থা হবে। এদের কিভাবে সামাল দেবে। ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দল দমনে সরকার যেখানে ব্যর্থ, সেখানে তারুণ্যের উচ্ছ্বাস থেকে এমন কোনো দাবি যদি তারা করে বসে, যেটা সরকারের পক্ষে মেনে নেয়া অসম্ভবÑ তাহলে সরকার তখন কী করবে; সেটাও সরকারকে ভাবতে হবে আগে ভাগেই। বিপদ আসতে সময় লাগে না। কথায় আছে অতি চালাকের গলায় দড়ি। সরকার নিজেকে যদি মনে করে তারাই সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমানÑ তা হলে বিরাট ভুল করা হবে। অতীতে যারা তা করেছিল তাদের অবস্থা, কী হয়েছিল ইতিহাসেই তা লেখা আছে। সরকার সে ইতিহাস জেনেও কেন ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছেÑ এটাই জাতির ভাবনার বিষয়। মতলববাজ ও সুবিধাবাদী কারো বুদ্ধিতে যদি প্রধানমন্ত্রী চলেন, তাহলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকতে পারে। নিজের বুদ্ধিই বড় বুদ্ধি।

রাসূল সা:-এর বিরুদ্ধে জঘন্য কটাক্ষ করায় নাস্তিক্যবাদী ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে দেশের ওলামা-মাশায়েখরা ২৮ ফেব্রুয়ারি সরকারকে শেষ আলটিমেটাম দিয়েছিলেন; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়নি কাউকে। অথচ এই দাবি জামায়াতের ছিল না। এই দাবি ছিল বিভিন্ন ইসলামি দলের, তথা মুসলিম জনতার। এই দাবির জন্য মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত ৬ জন শহীদের ক্ষতিপূরণদানের জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন তারা। ব্লগারদের শাস্তি আর ক্ষতিপূরণ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিক্ষোভ প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়েছে। সঙ্ঘাত-নৈরাজ্যমূলক দাবানলের মতো তা যদি গোটা দেশকে গ্রাস করে ফেলে, তাহলে দেশের মানুষ মূলত সরকারকে এ জন্য দায়ী করবেন।

একটি পরিবারের অভিভাবক যেমন মা-বাবা, তেমনি একটি রাষ্ট্রের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ। পরিবারে অঘটন ঘটলে সবাই যেমন দোষারোপ করে বাবা ও মাকে, তেমনি রাষ্ট্রের কোনো বড় ধরনের ক্ষতি হলে দায়ী করবে প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দকে। প্রবাদবাক্য আছে ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। অন্যথায় ফল হবে নেতিবাচক। জাতিকে বিভক্ত ও সহিংস করার সব ধরনের তৎপরতা বন্ধে সরকারি উদ্যোগ চাই, পৃষ্ঠপোষকতা নয়। যে জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকে না, সে জাতি বহিঃশক্তির আগ্রাসনের রোষানলে পতিত হয় সহজেই। আমাদের অতীত ইতিহাস সে কথারই প্রতিধ্বনি করছে বারবার। ইতোমধ্যেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পত্রপত্রিকা লিড নিউজ ছাপাচ্ছে : বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ লেগেছেÑ এই বলে। ইউরোপ-আমেরিকার পত্রপত্রিকায় একই ধরনের বক্তব্য আসছে। তারা এসব কথা বলতে সাহস পাচ্ছে, কারণ আমরা বিভক্ত। এর সুযোগ নিচ্ছে তারা। জাতীয় ইস্যু শুধু নয়, সব মত ও ধর্মকেও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে হবে। ভিন্ন মতকে সহ্য করার নামই গণতন্ত্র। একটি গণতান্ত্রিক দেশে ভিন্ন মতকে দমন করতে চাইলে সেটা সহিংস রূপ নেবে। সবাইকে ঐকমত্যে আনার প্রচেষ্টা সরকারকেই অগ্রণী হয়ে গ্রহণ করতে হবে। কে কোন ধর্মের মানুষ সেটা বড় কথা নয়, কে কোন মতের সেটাও বিবেচ্য বিষয় নয় রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও ধর্মদ্রোহিতা ছাড়া অন্য কোনো মতের বিরুদ্ধাচরণ করা অগণতান্ত্রিক আচরণে পড়ে। কে কোন দলের অনুসারী সেটা বড় কথা নয়Ñ আমি রাষ্ট্রের শাসক, আমার কাছে সবাই মানুষ হিসেবে বিবেচিত হবে। মানুষকে অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণ-বৈষম্য থেকে রক্ষা করাই গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব। আমরা এই দায়িত্ববোধই বর্তমান সরকারের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি। –লেখক :

গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট




Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *



পুরানো সংবাদ সংগ্রহ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  
All rights reserved © shirshobindu.com 2023